এই ফ্রেমটাই উজ্জ্বল হয়ে থাকুক। শি চিনফিং এবং নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
এ বার দিল্লি থেকে নয়, শাহি দিল্লির সমাচার জানাচ্ছি বেজিং থেকে!
কূটনীতির মারপ্যাঁচ যে কী জটিল সেই অভিজ্ঞতার কথাই জানাব আপনাদের। এক দিকে বারাক ওবামার প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত সফর, তার পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মে মাসে আসছেন এই বেজিং সফরে। তার আগে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এসেছেন চিন সফরে।
দু’বছর আগে চিন এবং ভারতের মধ্যে একটা মিডিয়া ফোরাম তৈরি হয়েছিল। তখন সলমন খুরশিদ ছিলেন বিদেশমন্ত্রী। চিনের সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে এসেছিল। সে সময় ভারত আতিথেয়তা দিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল দু’পক্ষেই এই প্রতিনিধি দল কাজ করবেন। এর পর নরেন্দ্র মোদী এলেন। কিন্তু তিনি আসার পর চিন ও ভারতের এই ফ্রন্টে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়। একে তো নির্বাচনের আগেই নরেন্দ্র মোদী অরুণাচলে গিয়ে চিন সম্পর্কে বেশ গরম গরম কথা বলেছিলেন। আবার চিনের দিক থেকেও গরম গরম বিবৃতি থামেনি মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও। লাদাখে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। নেপালে ও মায়ানমারে চিনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের গত সেপ্টেম্বরে চিনে আসার কথা ছিল। তা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর ভারত সফরের পর আবার চাকা ঘুরতে থাকে। আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সেরে, তার আগে জাপান সফর সেরে মোদীও এ বার চিনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করছেন।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের মিডিয়া ফোরাম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা চালু হয়েছে। এ বার চিনের আতিথেয়তা গ্রহণ করে ভারতীয় সাংবাদিকদের দল এখন বেজিংয়ে। এমন নয় বেজিংয়ে সুষমা স্বরাজ বিদেশমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর চূড়ান্ত করতে এসেছেন এই সফরেই। এই ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বেজিংয়ে এসেছি। ভারত-চিন মিডিয়া ফোরামের আলোচনা সভার একটি অধিবেশন সঞ্চালন করার দায়িত্বও ছিল আমার উপর। সেই অধিবেশন সঞ্চালন করতে গিয়ে বলেছিলাম, দু’টো দেশের মধ্যে যে বিতর্ক ও ঝগড়াঝাটি, তাকে দূরে সরিয়ে রেখে সংবাদমাধ্যমের উচিত দু’দেশের আর্থিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দেওয়া। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের ক্ষত যে দু’দেশের মধ্যে একটা অবিশ্বাস তৈরি করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এখন আমরা বসবাস করছি ২০১৫ সালে। ইতিহাসের সেই বোঝা আর বয়ে বেড়ানো উচিত নয়। আমাদের উচিত ভবিষ্যতের সম্পর্ক রচনার জন্য এটা নিশ্চিত করা যে, অতীতের বোঝা যেন অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। এমন কথাও বলেছিলাম, সাংবাদিকরা ইতিহাস তৈরি করতে পারেন না। কিন্তু দু’দেশের সুসম্পর্ক ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করতে পারেন। এই মন্তব্য যখন করেছিলাম, তখনও জানতাম না যে এটা নিয়েও একটা তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে যেতে পারে। সোমবারের ‘চায়না ডেইলি’ কাগজে বিরাট করে এই সংবাদ পরিবেশন করা হয়। সংবাদের শিরোনাম হয়, প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন এক ভারতীয় সংবাদপত্রের দিল্লির সম্পাদক বলছেন, বহু দশকের অবিশ্বাস দূরে সরিয়ে রেখে এগোনো প্রয়োজন।
বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। ছবি: এএফপি।
পরের দিন, অর্থাত্ সোমবার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্যেও কিছু দক্ষিণপন্থী প্রতিনিধি প্রবল চটে যান। তাঁরা বলেন, অতীত ভুলে যাওয়া মানে কি কেবল ইতিহাস বিস্মৃত হতে হবে? আমরা কি অরুণাচলও ভুলে যাব? আমলাতন্ত্রের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। খবরের কাগজটি পড়ে বুঝতে পারি যে আমার বক্তব্যের সবটা না ছাপায় প্রেক্ষাপট বুঝতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। ফলে পর দিন আবার বিশদ ভাবে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি। আসলে চিনের সংবাদপত্রগুলিও তাদের সুবিধামতো কিছু অংশ প্রকাশ করেছে। চিনা ভাষায় অনুবাদেও সমস্যা হতে পারে। ইতিহাসের বোঝাকে ভুলে যাওয়া মানে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশে ভারতের অধিকারকে অস্বীকার করা নয়। ভারতে সিকিমের অন্তর্ভুক্তিকে চিন মেনে নিয়েছে। তার পরে যদি কোনও মানচিত্রে চিন তা ভুল ভাবে প্রকাশ করে তবে তার প্রতিবাদ জানাতে হবে। কিন্তু যেটা আমি বলতে চাইছি সেটা হল, পরিস্থিতি যেখানে যেমন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু, ১৯৬২ সালে যুদ্ধের জন্য চিন বিরোধিতাকে মূলধন করে কূটনীতি রচনা বোধহয় ভারতের বিদেশনীতি হতে পারে না। নরেন্দ্র মোদী সেটা করছেনও না। করছেন না বলেই তো মিডিয়া সম্মেলন হচ্ছে। করছেন না বলেই তো প্রধানমন্ত্রী এপ্রিল-মে মাসে চিনে আসছেন। চিনের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে কৈলাস মানস সরোবরে যাওয়ার ছাড়পত্র চিন দিচ্ছে। কার্গিলের যুদ্ধ ধরলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চার বার যুদ্ধ হয়েছে। এখন যখন দুই দেশ পরমাণু শক্তিধর, তখন সেই যুদ্ধের কথা মনে রেখে সংঘাতের পথে অটল থাকা উচিত কাজ না কি আলোচনার মধ্যে দিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়া চালানো উচিত কাজ? বরং আমি বলব, সীমান্ত নিয়ে বিবাদ থাকলেও সেটি নিয়ে পৃথক আলোচনা চলছে। কিন্তু তার জন্য তিনি কখনও দু’দেশের আর্থিক সম্পর্ক বা বাণিজ্য বন্ধ করে দেননি। যেমনটা করে পাকিস্তান।
১৯৬২। চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা গ্যাংটকে। —ফাইল চিত্র।
এই মিডিয়া ফোরামের প্রস্তাবটা অবশ্য এসেছিল সম্ভবত চিনের কাছ থেকেই। ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রভাব বিস্তারেও চিন অনেক বেশি সক্রিয়। এমনকী, চিন থেকে ‘পুবের জানালা’ বলে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আরও অবাক হয়ে গেলাম যখন এক জন চিনা মহিলা এসে আমায় প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আনন্দবাজার পত্রিকার জয়ন্ত ঘোষাল? আমি রোজ আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইনে পড়ি। সেই চিনা মহিলার নাম শ্রীমতি ইউয়ান। তিনি এই পত্রিকাটির সম্পাদক। এ রকম বহু চিনা ছেলেমেয়ে বাংলা শিখে এই পত্রিকা চালাচ্ছে। মূলত বাংলাদশের জন্য এই পত্রিকাটি তৈরি হয়েছে। চমত্কার এই পত্রিকাটি তথ্যে ঠাসা, সুসম্পাদিত। এমনকী, মোদী-ওবামার ভারত সফরও অত্যন্ত সবিস্তার রিপোর্টিং করা হয়েছে। পরে জানলাম শুধু বাংলা নয়, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় চিন এই রকম পত্রপত্রিকা প্রকাশ করছে। বহু দিন ধরে তারা ইংরেজি চর্চা করেনি। এখন ইংরেজিতে বই ও পত্রিকা প্রকাশ করছে। বুঝতে পারছে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে কিন্তু ভারত সরকার এখনও চিনের মতো অতি সক্রিয় নয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রে আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত অন্য অনেক কিছু নিয়ে। চিনের প্রকাশ্য বিরোধিতার পথ বর্জন করে আমাদের উচিত বন্ধুত্বের পথে হেঁটে ভারতের শক্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। জগত্সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে গেলে সংঘাতের পথে নয়, সেই মৈত্রীর পথই নিতে হয়। সম্রাট আকবর থেকে সম্রাট অশোক— ইতিহাসের উত্তরাধিকার কিন্তু সে কথাই বলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy