শরিফ বিরোধী বিক্ষোভ। ইসলামাবাদে। ছবি: এএফপি
সিএনএন আর বিবিসি-তে দেখছিলাম, লাহৌর থেকে ইসলামাবাদে এসে ইমরান খান কী ভাবে নওয়াজ শরিফের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছেন। ভয়ের চোটে নওয়াজ ইসলামাবাদ থেকে লাহৌরে মডেল টাউনে নিজের বাড়িতে এসে বসে আছেন বিপুল নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ইমরান খানই কি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ? ইমরান খানই কি আগামী দিনে প্রধান বিরোধী নেতা পিপিপি-র সৈয়দ খুরশিদ আহমেদ শাহকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে প্রধান বিরোধী নেতা হয়ে উঠছেন? ১৯৯৬-তে তাঁর তৈরি দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’-ই (পিটিআই) হয়ে উঠবে অদূর ভবিষ্যতের শাসক দল?
পাকিস্তান সম্পর্কে সম্প্রতি দু’টি বই পড়লাম। বই দু’টির বিষয়বস্তু আলাদা। কিন্তু আজকের পাকিস্তানকে বুঝতে এই দু’টি বই-ই হল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি পিটার ওবোর্ন-এর ‘উন্ডেড টাইগার আ হিস্ট্রি অফ ক্রিকেট ইন পাকিস্তান’। আর দ্বিতীয়টি ‘দ্য পাকিস্তান মিলিটারি ইন পলিটিক্স: ওরিজিনস, ইভোলিউশন, কনসিকোয়েন্সেস’। লেখক ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি ১৯৪৭ সালে লাহৌরে জন্মান। এখন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানের এমিরেটাস-অধ্যাপক। পাকিস্তানে সেনা বিশেষজ্ঞ বলে তিনি বিশেষ পরিচিতি। আর পাকিস্তানের ক্রিকেট-জাতীয়তাবাদ নিয়ে বইটির লেখক পিটার ওবোর্ন পাকিস্তানের টিভি-রেডিও এবং ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রধান রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
নওয়াজ শরিফ
ইমরান খান
পিটারের বক্তব্য, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর দেশের ক্রিকেট টিম গোটা বিশ্বের কাছে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করে। জাতীয় সংহতি তথা পাক জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রধান প্রতীক হয়ে ওঠে ক্রিকেট। এ এইচ কারদার, ফজল মেহমুদ, হানিফ মহম্মদ, মজিদ খান, জাভেদ মিঁয়াদাদ, আবদুল কাদির, ওয়াসিম আক্রম, সর্বোপরি ইমরান খান গোটা দেশের মানুষের কাছে ক্রিকেটের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী হিরো হয়ে যান।
১৯৯২-তে ক্রিকেট বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এক বিশেষ নজির তৈরি করল। উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের ক্ষেত্রে সে এক উজ্জ্বলতম দিন। মেলবোর্নে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ের নেতৃত্ব দেন ইমরান খান। লগন ছবিতে আমির খান যেমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদীর রোমান্টিসিজম দেখান ঠিক সে ভাবে ইমরানও দেশে জাতীয় হিরো হয়ে ওঠেন।
’৯৬ সালে ইমরান নিজের দল প্রতিষ্ঠা করেন। লাহৌরে ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে কথা বলে মনে হয়েছিল, ইমরান এক স্বপ্নরাজ্যে বাস করছেন। মুশারফের সেনাশাসন, পাকিস্তানের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক মাফিয়ারাজের অবসান ঘটিয়ে ইমরান এক স্বর্গরাজ্য স্থাপন করবেন, এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সেনাশাসনের সমর্থনে তিনি বিবৃতি দেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল অংশ নিলে নিজে বিপুল ভোটে জেতেন বটে, কিন্তু তাঁর দলের ফলাফল হয় খুবই খারাপ।
পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষ। ইসলামাবাদে। ছবি: এএফপি
তবে একটা কথা মানতেই হবে, ইমরান রণে ভঙ্গ দেননি। বরং তিনি বুঝেছেন সেনাবাহিনী পাকিস্তান রাজনীতির এক প্রধান চালিকাশক্তি। তাই সেনাবাহিনী-আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্রকে বাদ দিয়ে ইমরান চলতে চাইছেন না। ক্রিকেট জাতীয়তাবাদেরও অবক্ষয় পাকিস্তানে ভয়াবহ। পিটার ওবার্ন দেখিয়েছেন, পাক ক্রিকেট দুর্নীতি, বেটিং, জিহাদি-সন্ত্রাস, ম্যাচ-ফিক্সিং, এ সব নানা অভিযোগ অতীতের গৌরবকে ধূলায় লুন্ঠিত করেছে। ২০০৯ সালের পর থেকে তো হিংসার ভয়ও পাক ক্রিকেটারদের গ্রাস করে। ইমরান নিজেকে তাই ক্রিকেটচক্র থেকে দূরে এনেছেন।
ইশতিয়াক আহমেদ পাক সেনা সংক্রান্ত বইটিতে লিখছেন, ২০০৮-এর ডিসেম্বরে তিনি সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফের সঙ্গে দেখা করতে যান। তখন মুশারফ সবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি লেখককে বলেন, ১৯৭১ সালের কথা পাকিস্তান কখনওই ভুলতে পারে না। পাক সেনা যত দিন শক্তিশালী থাকবে তত দিন পাকিস্তান থাকবে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে গেলেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে যাবে। লেখক অবশ্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রয়োজন না কি পাক রাষ্ট্র ও সমাজে সামরিক সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন? আর একটি ধারণা হল, পাক রাষ্ট্র ও সমাজ ইসলামের দুর্গ। লেখক বলেছেন, হজরত মহম্মদও ব্যবসায়ীদের জন্য মূল্যবোধের কথা বলেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, তার চেয়েও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল যোদ্ধারা। তারাই ইসলামিক মূল্যবোধের সব থেকে বড় ধারক ও বাহক হয়ে উঠল। একে বলা হয়েছে, গ্যারিসন স্টেট কনসেপ্ট। সামরিক বাহিনীর এই এলিট ব্যবস্থা কী ভাবে রাজনীতির সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা ম্যাক্সওয়েবার নিজেও বুঝিয়েছিলেন। এ জন্যই পারভেজ প্রেসিডেন্ট হয়েও সেনাপোশাক কখনওই পরিত্যাগ করতে রাজি হননি।
তবে ইমরানের শেষ রক্ষা হবে কি না তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। কূটনীতিক ও পাক বিশেষজ্ঞরাও অনেকে বলছেন, ইমরানের পিছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন আছে। নওয়াজকে চাপে রাখতে সেনাবাহিনী ইমরানকে ব্যবহার করছে বটে, কিন্তু এখনই সামরিক অভ্যুত্থান করে নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে না। আপাতত সেনা নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইছে তারা। ইমরানের নয়া পাকিস্তানের স্লোগান পাক টিভিতে তার কর্মীদের ভাঙচুরে ম্লান হয়ে গিয়েছে। যে জন্য ইমরান ওদের দায়িত্ব নিতেও রাজি হননি। বলেছেন, ওরা আমাদের দলের কেউ নয়। ব্রিটেনের সাংবাদিক ও গবেষক ক্রিস্টোফার জেফ্রেলট মনে করছেন, ভাঙচুরের কারণে মধ্যবিত্ত সমাজের সমর্থন অনেকটাই হারিয়েছেন ইমরান। সে কারণেই এখন নয়া পাকিস্তানের স্লোগান তুলে গরিব মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু, এর ফলে ইমরানের অবস্থান অনেকটা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ গোছের।
প্রাক্তন আইএসআই প্রধান আহমেদ সুজা পাশা অবশ্য এখনও সক্রিয় এবং ইমরানকে সমর্থন করেছেন। মুশারফকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার যে চেষ্টা নওয়াজ করছিলেন সেটাও এখন সেনা-আইএসআই চাপে মুলতুবি রাখতে হবে নওয়াজকে। কিন্তু শেষরক্ষা হবে কি ইমরানের? না কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নওয়াজ আপাতত টিকিয়ে রাখবেন রাজপাট। কারণ, নওয়াজও এখন ঘরপোড়া গরু। কারগিলের ক্ষত আজ এক ভয়াবহ স্মৃতি, তাই ইমরান ভবিষ্যতে নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠতে পারেন বটে, কিন্তু আপাতত তার এই বিপুল বিক্ষোভ কতটা হাতে-গরম ‘নাফা’ দেবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy