সময় যখন ‘কিছু ভাল লাগছে না’-র সংক্রমণ ছড়ায়, এবং কোনও ওষুধেই নিরাময় নেই— সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রাপালা, মেলা, সবই বিড়ম্বনা মনে হয়— তখন, সুজন, আপনি যেখানকার বাসিন্দা হোন, যা-ই হোক আপনার বৃত্তি, আপনি একটা পশ্চিম বাংলা ঘুরে আসুন, ঠিকানা বাতলে দিচ্ছি, সঙ্গে নিরাময়ের গ্যারান্টি।
বসতটির নাম চেঁচাই। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন থানায়, বালুরঘাট শহর থেকে অল্প রাস্তা, আপনার ব্যয়সামর্থ্য অনুযায়ী যানবাহন পেয়ে যাবেন। পাকা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে, দু’পাশে ফসল, আপনি যেতে যেতে ধান না থাকতে পারে, হয়তো সর্ষে থাকবে, অথবা ফাঁকা, কিন্তু পথের দু’ধারে অগুনতি গাছ থাকবে— গ্রামেরই এক ‘যুগলপ্রসাদ’, নিমাই তিগ্গা-র পোঁতা। বিভূতিবাবুর আরণ্যক-এর যুগলপ্রসাদ, ভুলে যাননি তো?
থেকে যান একটা বা দুটো রাত, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরেই থাকার ব্যবস্থা, একটা মাটির ঘরে— লাগোয়া স্নান-শৌচের ব্যবস্থা। এটা ছিল পুরনো স্কুলবাড়ি, সর্বশিক্ষা মিশনের কল্যাণে পাকা বাড়ি এসে এটাকে অপ্রয়োজনীয় করে দেওয়ার আগেই বদলে ফেলা হল চমৎকার অতিথিশালায়। পুরনো এ নিকেতন অতীতের মুগ্ধ সংরক্ষণ নয়, বরং নতুনের আবহের অঙ্গ। সে নতুনের আগমনে স্কুলের ছোট্ট মাঠের চার পাশে ফুল, পাতা, গাছ; স্কুলের ঠিক বাইরেটাতে গ্রামবাসীদের দেওয়া জায়গায় স্থানীয় আদিবাসী যুবক সংঘের সংযোগে একটা ছোট্ট সবুজ বাগান, স্কুলের মিড ডে মিলের জন্য। পাঁচিলের বাইরে সার দিয়ে গাছগাছালি, বেড়া নেই, গ্রামবাসীরাই রক্ষা করেন গরুছাগলের গ্রাস থেকে, গরুর মুখে ‘গোমাই’ লাগিয়ে রাখেন স্কুলের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়।
পাখির ডাকে যদি ঘুম না-ও ভাঙে, কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুদের কলরবে আপনাকে উঠতেই হবে, ক্লাবের পক্ষ থেকে আয়োজন, সকাল সন্ধ্যা বাচ্চাদের পড়াতে বসানোর। ছোট্ট গ্রাম চেঁচাই, মাত্র বাহান্ন পরিবার, পাশের পর্বতপুর পাড়ায় আরও বিশ ঘর, বেশির ভাগ আদিবাসী, কয়েক বংশ রাজবংশী ও বৈষ্ণব। এঁদের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলুন, জেনে নিন কোন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় তাঁদের এই ইস্কুল, যেখানে পাঁচ-ছয় বছর আগেও দশ-বারোটা ছাত্রছাত্রী ছিল না, সেটা হয়ে উঠল এক আশ্চর্য বিদ্যায়তন, যেখানে বাহান্নটি শিশু বাস্তবিকই মানব সক্ষমতা অর্জনের চর্চায় মগ্ন। একটু পরেই হাজির হবেন পবিত্র মোহান্ত, যিনি শুধু চেঁচাই নয়, গোটা এলাকায় শিক্ষা প্রসারে সমর্পিত; আসবেন সহকারী শিক্ষক সঞ্জীব মজুমদার। প্রত্যক্ষ করুন, কী ভাবে পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রভেদ মুছে গিয়ে চলতে থাকে শিক্ষার এক সর্বাত্মক অনুশীলন, পড়া-লেখা-অঙ্ক কষা ছাড়াও ব্যায়াম, সংগীত, অঙ্কন। প্রতিটি শিশু পরিচ্ছন্ন, বিদ্যালয়ের কোনও কোণে এক বিন্দু মালিন্য নেই, একটা কাগজের টুকরো পড়লেও ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে কোনও শিশু, দারিদ্রের অভিশাপ যাদের নিষ্পাপ চোখমুখ থেকে স্নিগ্ধতা কেড়ে নিতে পারেনি। ঝকঝকে রান্নাঘরে মিড ডে মিল-এর পাচিকাদের মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস। ব্যবহৃত জল বৈজ্ঞানিক ভাবে পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে, শৌচালয়গুলো পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তৈরি— শিশুরা নিজেরাই পরিষ্কার রাখে, শিক্ষকও হাত লাগান এই শিক্ষায়! চতুর্দিকে শিশুদের নিজস্ব সৃষ্টি— লেখা, আঁকা, হাতের কাজ। আর আছে তাদের খাতা-পেনসিল কেনার জন্য ‘আমার দোকান’। বিক্রেতা নেই, পাহারাদার নেই, শিশুরা দাম জানে, দরকার মতো জিনিস নিয়ে দামটা একটা বাক্সে ফেলে দেয়, ‘পাই পয়সার হিসেব মিলে যায়’।
আসলে মিলটা অন্যত্র: শিক্ষকদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের মিল, যা শিশুদের সঙ্গে শিক্ষকের মিলটাকে এমন একটা উপলব্ধির ব্যাপার করে তুলেছে। এই মিল থেকে গ্রামবাসী যেমন এসেছেন স্কুলের কাছে, তেমনই স্কুল পৌঁছে গেছে তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে, নানা ভাবে। একটাই শুধু নিদর্শন দেখুন, গোটা গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয়েছে শৌচালয় এবং সেগুলো কেবল প্রকল্পের টার্গেট পূরণ করে না, ব্যবহৃত হয়। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর সরকারি ঘোষণার এবং মন্ত্রী-সান্ত্রিরা ঝাড়ু-হাতে ছবি তোলার বহু আগেই স্কুলের প্রভাবে এ গ্রামে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত। শুধু দৈহিক নয়, প্রসারিত মানসিক স্বচ্ছতায় গ্রামবাসীরা গড়ে তুলেছেন এমন এক সমাজ, যেখানে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে কয়েকটি বাড়ি মিলে যৌথ রান্নাঘর গড়ে তোলার। হয়তো বা ইউটোপিয়া, কল্পসমাজ, হয়তো বা সোভিয়েত অভিজ্ঞতা ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু মানুষই তো পারে কল্পনা করতে, কল্পনা আছে বলেই প্রাণ আছে— যে প্রাণ একটা গ্রাম, একটা স্কুল ছাড়িয়ে, এখনও অলক্ষ্যে, বিস্তৃত হচ্ছে পশ্চিমবাংলার প্রান্তে, প্রান্তান্তরে।
প্রান্ত ধরে এগিয়ে যান মণিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, আরও এগিয়ে শূলপাণিপুর, দেখুন শিক্ষার স্থানিক আয়োজনে স্কুলগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ সংহতি কেন্দ্রে। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসুন হিলি— ঐতিহাসিক শ্রীগোহালি, একদা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিপুষ্ট যে লোকালয় রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বেচ্ছাচারে শ্রীহীন, কিন্তু সেখানেও স্কুলে স্কুলে যৌবনের উন্মেষ। পর পর দেখতে পাবেন চকদাপট, ফেরুসা, নোয়াপাড়ায় কত বিরুদ্ধতা অতিক্রম করে একটা শিক্ষাসমাজ জেগে উঠছে। আরও এগিয়ে ঘুরে আসুন কুশমণ্ডি ব্লকে। আপনাকে অবাক হতেই হবে, চোখকে প্রতারক মনে হবে হয়তো বা। কিন্তু যে নিশ্ছিদ্র ‘না’-রাজ্যের বাসিন্দা আমরা, যেখানে ভাঙাটাই রীতি, গড়াটা চিন্তাবাহুল্য, সেখানে চিন্তা ও কর্মের পারস্পরিকতায় পরিবর্তনের যে অদ্ভুত সংজ্ঞা তৈরি করছেন এক দল মানুষ, সেটা অনুভব করাটাও সৌভাগ্যের। আমাদের সুযোগ হল এ রকম তিন কুড়ি মানুষের কথা শোনার। বালুরঘাট শহরে, এক সান্ধ্য বৈঠকে, যা শেষ হতে হতে প্রায় মাঝরাত। শিক্ষকরাই এর কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আছেন অনেক সমমর্মী— যাঁরা অর্থ, শ্রম ও সময় দিয়ে নিজেদের এই সমাজীকরণের হকদার করে তুলেছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, প্রান্তিক চাষি, খেতমজুর, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বা কর্মচারী।
কী তাঁদের প্রেরণা? কেন তাঁরা ভবিষ্যতের একটা বৃহত্তর শুভ-র মায়াবী আকর্ষণে বর্তমানে ‘অযথা’ ক্লেশ বরণ করে নিচ্ছেন? এর একটা কোনও উত্তর নেই, কেননা লোক অনেক, মনোবৈচিত্রে যাঁরা বিশিষ্ট। লবটুলিয়া বইহারের যুগলপ্রসাদের ধারাবাহক নিমাই তিগ্গা গাছ লাগিয়ে চলেন প্রকৃতির টানে, সেই টানে স্কুলের সঙ্গে তাঁর সংযোগ। শিক্ষিকা স্বাগতা মিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেরণা তাঁর শিশুরা, যারা প্রত্যেকেই ‘দেবতার আলাদা আলাদা রূপ’। শিক্ষক বিদ্যুৎ দাস স্কুলের দেওয়াল জুড়ে নিখুঁত এঁকে যান ‘সহজ পাঠ’, এটা ‘আমার সামাজিক দায়িত্ব’ বলে; মুক্তিনাথ হালদারের শৈল্পিক স্পর্শে কাদামাটি থেকে উঠে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ, খাতার পাতায় ফুটে ওঠে পাখি, ফুল, এমনকী বাঘের মুখাবয়ব— ‘শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শেখে নানা কিছু’, এটাই তাঁর প্রণোদনা। বিচিত্র প্রতিভার শিক্ষকরা নিজেদের নিংড়ে দিতে চান, ‘নেশার টানে— শিক্ষকতার পেশাটা যতক্ষণ নেশা না হয়ে ওঠে, ততক্ষণ সেটা পেশাও হয় না’, জানান পবিত্র, মনোজ, মিলন, রতনের মতো শিক্ষকরা। আবার, ব্যবসায়ী দুর্জয় কুণ্ডুর অকুণ্ঠ ত্যাগ স্বীকার কেবল বন্ধুত্বের টানে; তাঁর বন্ধুরা যে কর্মোদ্যোগের শরিক, সেখানে তিনিও এক অংশীদার। আপনিও, সুজন, এই প্রতিবদ্ধতায় শামিল হতে পারেন। কিছু যদি না-ও করতে পারেন, অন্তত আত্মীয়ের মতো নিকট থেকে এই অমৃতবর্ষা বোধায়ত্ত করতে পারেন।
শিক্ষাই তো অমৃত, যাকে আমরা দূরে ঠেলে বেছে নিয়েছি বিষপাত্র। রাজনেতা, সমাজমাণিক্যদের পশ্চাদনুসরণ করে যে অমৃতকে আমরা অবজ্ঞা করেছি, অবহেলা করেছি, সেই পাপ দূর করতে শুধু পশ্চিম দিনাজপুরের কোটরে নয়, বাংলার নানান প্রকোষ্ঠেই বোধহয় এক বিপ্রতীপ ধারার প্রবাহ: যে বাংলাকে মনে হয় ঘোর অনৈতিকতার পাঁকে নিমজ্জিত, পাপের কলস পরিপূর্ণপ্রায়, সেই বাংলাতেই আপাততুচ্ছ, জনারণ্যে স্বাতন্ত্র্যবিহীন একদল মানুষের একটা অন্য সমাজ আমাদের আহ্বান করছে।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরতি পথে একটু ঢুকে পড়ুন মালদার মানিকচক শিক্ষা নিকেতনে, কিংবা কোতোয়ালির কাছে গোপেশ্বর সাটিয়ার হাইস্কুলে। ‘কিচ্ছু ভাল লাগছে না’ নিরাময়ের অনেক কিছু পেতে পারেন। একটু আভাস দিই: হাইস্কুলগুলোতে গেলেই শোনা যায়: বাচ্চারা প্রাইমারিতে কিছু শিখে আসে না, আমরা কী করব? অভিযোগটা সম্পূর্ণ নিরাধার তো নয়, বাস্তবিকই এমন অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যেখানে বর্ণপরিচয়টুকু না ঘটিয়েই শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার আখড়ায়। শুধু সরকারি স্কুল নয়, অধুনা একমেবাদ্বিতীয়ম্ বলে ‘মেনে নেওয়া’ প্রাইভেট স্কুলেও এমন দশা বিরল যে নয়, তা নরহাট্টাতেই দেখতে পাবেন। কিন্তু, যেমনটা বললেন মানিকচক শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক জ্যোতিভূষণ পাঠক, ‘পাপ যে-ই করুক, ফলটা তো সমাজকেই ভোগ করতে হবে। তাই, এ থেকে মুক্তির দায়টা সকলেরই।’ সেই বোধে তাঁরা পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া যে-অংশটা ‘কিছু শিখে আসেনি’, তাদের আলাদা করে পোক্ত করে নিচ্ছেন, যাদের ভিতর থেকে কিছু দিনের মধ্যেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঔজ্জ্বল্য। একই উপলব্ধি নরহাট্টার প্রধান শিক্ষক রাজীবকুমার ঘোষালের।
রাষ্ট্রের কি ভূমিকা নেই? আছে, কিন্তু করুণ ভাবে যান্ত্রিক। সেখানে মন নেই, মানুষ নেই। আর সে কারণেই সমাজের ভূমিকা এত জরুরি। তার অঙ্কুরোদ্গম আপনি দেখতে পারেন। হৃদয় ও বুদ্ধির অপূর্ব সংমিশ্রণে অত্যুজ্জ্বল সব মানুষদের সঙ্গেই আপনার দেখা হবে, যাঁরা ‘দিব্যজ্ঞানের চেয়ে কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভর করে’ নিজেদের কাজটা করে চলেছেন। এক দিকে রাষ্ট্রীয় যান্ত্রিকতার বাধা, অন্য দিকে পরিচিতজনদের তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গবিদ্রুপ উপেক্ষা করে। এঁদের কর্মক্ষেত্র বাংলা। কিন্তু যাদের তাঁরা গড়ে উঠতে সাহায্য করছেন, তারা ইতিমধ্যেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে অন্য ভারতবর্ষের। চেঁচাইতে শিশুদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে সমবেত উপলব্ধি: ‘ওয়ান লিট্ল, টু লিট্ল, থ্রি লিট্ল ইন্ডিয়া’। ‘টেন লিট্ল ইন্ডিয়া’তে পৌঁছে তা আবার ফিরে আসছে ‘ওয়ান’-এ। স্কুলে একটা মাইক আছে। সারা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় লাউডস্পিকার, যেমনটা চিনা উপন্যাসে পড়ি। তবে সে দেশে লাউডস্পিকারের বাণী নিয়ন্ত্রণ করত পার্টির লোকাল কমিটি, এখানে সে কাজ করেন গ্রামের মানুষ নিজেরাই। শিশুদের অনেক ভারত থেকে এক ভারতের কল্পসংগীত ধ্বনিত হয় গোটা গ্রামে।
আপনি এবং আমরা, যারা লোকসমাজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিনিধি, তারা সকলেই এই অসামান্যের অনুশীলনে কিছু-না-কিছু যোগ করার সুযোগটা যেন না হারাই। পরশপাথর খুঁজে ফেরা খ্যাপাদের দলটাই তো পরশপাথর, তার পরশ পাওয়াটাই এক বিপুল আত্মসমৃদ্ধি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy