কয়েক বছর অন্তর অন্তর বড় বড় নেতারা যে ভাবে আকাশ থেকে নেমে এসে কিছু দিন খুব দৌড়োদৌড়ি করে ছোট ছোট মানুষদের কাছে করজোড়ে ভোট চেয়ে বেড়ান এবং ভোট ফুরোলেই আবার ঊর্ধ্বগগনে ফিরে যান, এত কাল ধরে সেই অলীক কুনাট্য দেখার পরেও এ দেশের মানুষ নির্বাচন ব্যাপারটাকে মোটেও তুচ্ছ করেনি, বরং উত্তরোত্তর গুরুত্ব দিয়েছে— ভোটের সভায় ভিড় বেড়েই চলেছে, ভোটের বুথেও। সেটা আমাদের নির্বুদ্ধিতা বা সারল্যের প্রমাণ নয়, বরং কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক। পূর্ণচন্দ্র রোজ ওঠে না, তাই বলে কি পূর্ণিমা এলে মুখ ফিরিয়ে থাকব? আর, দিনে দু’বেলা ঘরে বাইরে কত অভিনয়কে অভিনয় জেনেও সবাই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি, শুধু রাজনীতি করছেন বলেই ওঁদের দোষ হয়ে গেল? সুতরাং, তিন মাস ধরে দিনে গড়পড়তা আড়াই হাজার কিলোমিটার ওড়াউড়ির পরে ভোটের পালা সাঙ্গ হতেই নরেন্দ্র মোদী যদি সিধে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অধিপতি সকাশে গমন করেন, তাতে আমার আপনার অভিমান করার কোনও কারণ নেই। আমাদের হল সারা, ওঁদের হল শুরু।
বিপদ সেখানেই। ওঁরা আস্তিন গুটিয়ে কাজে নামবেন সেটা সমস্যা নয়, আমরা ভোটের রেজাল্ট শুনে আচমন করে হাত গুটিয়ে নেব সেটাই সমস্যা। যাকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলে ডেকেছি, এই সমস্যার বীজ তার গভীরে নিহিত আছে। কথা ছিল, তন্ত্রটা আমাদের, কিন্তু আমরা তো আর সবাই সেটা চালাতে পারব না, তাই আমরা প্রতিনিধি পাঠাব, তাঁরা আমাদের হয়ে দেশ শাসন করবেন। প্রতিনিধি পাঠালেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে, এমন কথা ছিল না। সেই প্রতিনিধিরা কী করছেন এবং কী করছেন না সে-সব বিষয়ে অবিরত নজর রাখা, আমরা কী চাই এবং কী চাই না সে-সব কথা তাঁদের প্রতিনিয়ত জানিয়ে চলা, আমাদের চাওয়াগুলো আদায় করার জন্যে তাঁদের ক্রমাগত চাপ দেওয়া, এগুলোও আমাদের কর্তব্য ছিল। সেই কর্তব্য নাগরিক অধিকারেরই অঙ্গ। প্রজা থেকে নাগরিক হওয়া মানে তো কেবল পাঁচ বছর অন্তর বক্তৃতা শোনা আর বোতাম টেপা নয়।
কিন্তু কথা তো অনেক থাকে। ক্ষমতার লীলায় সেই কথামালা কোথায় হারিয়ে যায়। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিনিধিসর্বস্ব গণতন্ত্রে পরিণত হয়। জনপ্রতিনিধি শব্দটির মানে দাঁড়ায় জনগণকে শাসনে রাখার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি। নাগরিকের শরীরে প্রজার ভূত প্রবেশ করে, গুছিয়ে বসে। রাজারানিরা সময় মতো এসে ক’দিন তরজা শুনিয়ে যান, গণতন্ত্রের তরজা। ভূত শোনে, এনজয় করে, বোতাম টেপে, তার পর ঘুমিয়ে পড়ে। রাজারানিরা সিংহাসন গ্রহণ করেন, গণতন্ত্র চালান। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।
এই ঘুমটাই আসল বিপদ। বাইরের ঘুম নয়, অন্তরের ঘুম। আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, কারণ জেগে থাকতে চাই না। গণতন্ত্র সর্বদা জাগ্রত থাকার যে নির্দেশ দেয় তা আমাদের পছন্দ নয়, কারণ ওতে বিস্তর পরিশ্রম। তার চেয়ে অনেক সুবিধেজনক হল ক্ষমতাবানদের হাতে লাগামটা তুলে দেওয়া। সে হাত যত পেশিবহুল, যত আত্মপ্রত্যয়ী, আমরা তত নিশ্চিন্ত। আমাদের এই মানসিকতাকে পুঁজি করেই নায়কনায়িকাবৃন্দ মঞ্চে আবির্ভূত হন, ঘোষণা করেন: তোমরা আমাকে ভোট দাও, আমি তোমাদের মুশকিল আসান করে দেব। নির্বাচনী প্রচারে দাপুটে নেতা বা নেত্রীদের বলতে শুনবেন না, ‘আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, আপনাদেরও নিজের নিজের কর্তব্য পালন করতে হবে’। ও কথা মুখে আনাও পাপ, কারণ তা হলে নেতা বা নেত্রীর নিজের নিরঙ্কুশ প্রতিনিধিত্বের দাবিতে টোল পড়ে, ‘আমিই সব করে দেব’ ঘোষণার জোর কমে যায়। ওঁদের বিপুল অহঙ্কারের পিছনে আছে আমাদের বিপুল নির্ভরশীলতা। গণতন্ত্র পবিত্র ভোটাধিকার দিয়েছে, সেই অধিকার ব্যবহার করে আমরা পরিত্রাতা খুঁজে চলেছি।
অনেক সময় খোঁজার তাড়না বাড়ে। মনে পড়ে, ষাটের দশকের টালমাটাল সময়ে আশেপাশে অভিভাবকদের অনেককে বলতে শুনতাম ‘এদের দিয়ে হবে না, মিলিটারি দরকার’। তাঁরা পরিত্রাতা চেয়েছিলেন। অতঃপর— সেনাবাহিনীর খুব একটা প্রয়োজন হয়নি— সাদা পোশাকের নায়কনায়িকারাই সত্তরের শান্তিকল্যাণ এনে দেন। তার পর যত দিন গেছে, মিলিটারির মোহ দ্রুত বিলীন হয়েছে, সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক মস্ত সাফল্য, অবশ্যই। কিন্তু গণতন্ত্রের কক্ষপথেই লৌহমানবের দুর্মর আকর্ষণ থেকে থেকে প্রবল হয়ে ওঠে। গত কিছুকাল ধরে সেটাই হয়েছে। মনমোহন সিংহ এবং তাঁর চালিকাশক্তিরা তার দায় এড়াতে পারেন না। এক দিকে প্রশাসনিক অনাচারের মোকাবিলায় তাঁদের অকল্পনীয় অপদার্থতা, অন্য দিকে বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক নীতি রূপায়ণে তাঁদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা— দুর্বল এবং নিষ্ফল নেতৃত্বের যে রেকর্ড তাঁরা করে গেলেন, ভাঙা কঠিন হবে। তার ওপর নাগরিকরা দেখেছেন, নির্বাক প্রধানমন্ত্রী কেবল অসহায় নয়নে চেয়ে থাকেন, মুখ খুললে মনে হয় এর চেয়ে নীরবতাই শ্রেয় ছিল, আর শাসক দলের তরুণ সহসভাপতিকে দলের লোকেরা নায়কের ভূমিকা নেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করেন, তিনি কিছুতেই তা মানেন না বা মাতৃসত্য পালনের জন্য মানতে পারেন না, অথচ থেকে থেকে মঞ্চে আবির্ভূত এবং অন্তর্হিত হতে থাকেন। এই বিচিত্র দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে মানুষ ‘ত্রাহি সুপারম্যান’ জপ শুরু করে। অতঃপর ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ হুঙ্কার সহ মোদীর আগমন এবং— অ্যাকশনের অনিবার্য রিঅ্যাকশন— সে কী মা ভক্তি সে কী মা হর্ষ। নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, অন্তত নাগরিক সমাজের, বিশেষত তরুণ সমাজের এক বড় অংশের মনে ‘বলিষ্ঠ নেতৃত্ব’ এবং ‘কড়া প্রশাসক’-এর প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।
তাতে ক্ষতি কী? বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কড়া প্রশাসক তো ভাল জিনিস। মনমোহন সিংহ এবং তাঁর সরকার এই ভাল জিনিসগুলি সরবরাহ করতে পারেননি বলেই তো এমন বিপুল নিন্দার ভাগী হয়েছেন! নিশ্চয়ই। সমস্যা সেখানে নয়। ভয়টা অন্য। আত্মসমর্পণের ভয়। দাসখত লিখে দেওয়ার ভয়। একটা গণতান্ত্রিক দেশে শাসকের নীতি এবং আচরণের ওপর অতন্দ্র প্রহরা জারি রাখা যে নাগরিক সমাজের দায়িত্ব, তারা যদি শাসককে পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখতে চায়, সমাজের ভালমন্দের সব ভার সেই ত্রাতার ওপর ছেড়ে দিতে আকুল হয়ে ওঠে, তা হলে গা ছমছম করে বইকী। শাসকরা সেই আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন কি না, সেটা পরের কথা। প্রথম কথা হল, নাগরিকরা তাঁদের প্রহরীর ভূমিকা থেকে সরে এলে গণতন্ত্র অন্তরে অন্দরে কমজোরি হয়ে পড়ে। নির্বাচনের পথে ক্ষমতায় এসে একনায়ক হওয়ার সুযোগ থাকলেই সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে একনায়কের আবির্ভাব হবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেই, কিন্তু সেই সুযোগ তৈরি হওয়াটাই বিপদ। বড় বিপদ। নরেন্দ্র মোদী দিল্লির তখ্তে বসবেন কি না, বসলে কতটা নিশ্চিন্ত মনে বসতে পারবেন, তার উত্তর আমরা অচিরেই জানব। কিন্তু যে নাগরিক সমাজের কণ্ঠে ‘মোদী বুলাও, দেশ বচাও’ নিনাদ উৎসারিত হয়, তাকে গণতন্ত্রের প্রহরী ভাবা কঠিন।
এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে কর্পোরেট ভারত এই নিনাদের এপিসেন্টার, শেয়ার বাজারে তার বিপুল তরঙ্গ উত্তরোত্তর আপনবেগে পাগলপারা। এ নিয়ে রাগ করা অর্থহীন, আক্ষেপ নির্বোধ। কর্পোরেট দুনিয়া বরাবরই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব চায়, চেয়ে এসেছে, কী ১৯৭৫’এ, কী ২০১৪’য়। সেটাই তার ধর্ম। স্বধর্ম। তার কাছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়, সর্বজনীন শিক্ষা, খাদ্যের নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা— এ সবের নিজস্ব কোনও মূল্য নেই, মূল্য থাকার কোনও কারণও নেই। বরং গণতন্ত্রের হাজার ঝকমারির মধ্যে না গিয়ে যদি চটপট কাজ হাসিল করে নেওয়া যায়, দারুণ হয়। এই জন্যেই উন্নয়নের সাংহাই মডেলের বন্দনায় দুনিয়ার কর্পোরেট এক হয়েছেন। কিন্তু বিপদ ঘটে, যখন নাগরিক সমাজও সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, ভাবতে শুরু করে— এত গণতন্ত্র গণতন্ত্র করলে দেশের উন্নতি হবে না, ডেভেলপমেন্ট ব্যাপারটা বলিষ্ঠ নেতার হাতে ছেড়ে দিতে হবে, তা না হলে আমরা পিছিয়ে আছি, পিছিয়েই থাকব।
চার পাশে এই ভাবনা এখন খুব জোরদার। এ বারের নির্বাচনী প্রচারে ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নগুলিকে প্রবল বিক্রমে পিছনে ঠেলে দিয়ে উন্নয়নের যে ‘রেটরিক’টি ক্রমশই ফুলে ফেঁপে উঠেছে, সেটি আসলে ওই সাংহাইয়ের স্বপ্ন— চিন যা পারে, আমরা কেন পারব না? দ্বিতীয় ইউপিএ’র অকর্মণ্যতা এবং পায়ের তলায় আদর্শের জমিটা বেবাক হারিয়ে ফেলে বামপন্থীদের করুণ অন্তর্ধান এই ভাবনাকে প্রায় বিনা বাধায় দিগ্বিজয়ের সুযোগ দিয়েছে। সেই ভাবনার কাছে গণতন্ত্র মানে ভোট দেওয়া, ব্যস; বাকি কাজ যাঁরা ভোটে জিতলেন তাঁদের। সেই দর্শন এ বার তার রাজদণ্ড বের করবে, আমাদের হুকুম দেবে: অনেক গণতন্ত্র হয়েছে, যে যার বোতাম টিপেছ, এ বার রেজাল্ট দেখে নাও, তার পর নিজ নিজ কাজে মন দাও, যাঁদের হাতে দেশ চালাবার ভার দিয়েছ তাঁদের চালাতে দাও। প্রজার ভূত সেই আদেশ শুনে ঘুমিয়ে পড়বে, না কি জাগ্রত নাগরিক উঠে দাঁড়িয়ে বলবে ‘হুঁশিয়ার’— সেটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy