ও পারেও। আমেরিকায় দাঁড়িয়ে মেক্সিকো দর্শন। ২৪ অগস্ট, ২০১৫। ছবি: লেখক।
বর্ডার বলতে তেমন কিছু নয়। কোনও নো ম্যানস ল্যান্ডও নেই। এমনকী উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম ও পারের বাড়িঘর, লোকজন দিব্য নিত্য জীবন চালাচ্ছে। অপলক তাকিয়ে ছিলাম। কেবল উঁচু উঁচু ডান্ডা দিয়ে তৈরি করা কিছুটা সীমান্ত। আর কিছু জায়গায় দেওয়াল। এ দিকের জীবন আর ও দিকের যাপনের মধ্যে, কই, তেমন কোনও তফাত তো নেই!
তখন অবশ্য ভাবিনি, পাঁচ বছরের একরত্তি সোফি ক্রুজের মা-বাবা এই বর্ডার পেরিয়েই এসেছিলেন কি না! যে সোফি ওয়াশিংটনের তাবড় নিরাপত্তার বেড়া ডিঙিয়ে পোপের হাতে একটা চিঠি তুলে দিতে পেরেছে। যার আকুল আর্তি ছিল: আমার মা-বাবার মতো আরও অনেক অভিবাসীকে প্লিজ মেক্সিকোয় ফেরত পাঠিয়ে দিয়ো না। ওখানে আমাদের কেউ নেই। কাউকে চিনি না। আমার জন্ম এখানেই। এটাই আমার দেশ। আর এ দেশে আমায় রেখে মা-বাবাকে পাঠিয়ে দিলে, আমার কী হবে? আমার মা-বাবা ভাল লোক। তারা এখানে খেটে খাওয়া মানুষ। ওদের মতো আরও ভাল লোক এখানে রয়েছে।
পোপ জড়িয়ে ধরেছিলেন সোফিকে। কতটা ভরসা বা আশ্বাস দিতে পেরেছেন, জানি না। তবে তাঁর ভাষণে তিনি বলেছেন, বেআইনি অভিবাসী মানেই অপরাধী নন, তাঁরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা মানুষ। অনেকেই বহু বছর আগে এ দেশে জীবনের সন্ধানে এসে, থেকে গিয়েছেন। এই দেশটাকে আপন করে নিয়েছেন। তাঁদের উৎখাত করে দেওয়া মানবিক নয়।
ঠিক এমন কথাই তো শুনেছিলাম নোগালেস শহরে, অগস্ট মাসে, টোনি এস্ত্রাদা’র মুখে। তিনি সান্টা ক্রুজ কাউন্টির শেরিফ। আমেরিকার অ্যারিজোনা প্রদেশের টুসন শহর থেকে ঘন্টাখানেক-এর রাস্তা নোগালেস। এই নোগালেস দেখতে যেতে হবে, নোগালেস নিয়ে তর্ক করতে হবে, নোগালেস নিয়ে সমবেদনা জানাতে হবে, নোগালেস নিয়ে ভয় পেতে হবে আর ‘গোটা’ নোগালেসকে ভালবাসতে হবে। কেন? কারণ নোগালেস এমন একটা শহর, যার বুক চিরে চলে গিয়েছে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত। যে শহরের এ দিকে আর ও দিকে লোকে একই ভাষা বলে, একই খাবার খায়, একই গান গায়, একই স্বপ্ন দেখে। অথচ মাঝখানে কাঁটাতার। যে কাঁটাতারের এক দিকে একটা থিতু জীবনের হাতছানি, অন্য দিকে খুব কষ্টে দিনযাপনের গ্লানি। আর তাই নোগালেসের যে দিকটা আমেরিকায়, যে দিকে হাজার পঞ্চাশেক লোকের বাস, সেই দিকে বেআইনি পথে রোজ বর্ডার পার করে হাজার হাজার মেক্সিকান অভিবাসী আসে ও পারের সোনোরা-নোগালেস থেকে, যেখানে প্রায় লাখ পাঁচেক লোকের বসতি।
টোনি এস্ত্রাদার অফিসে আমরা গিয়েছিলাম মেক্সিকান অভিবাসী আর বর্ডার-স্টেট-এর মানুষজনের জীবনধারার কথা শুনতে। শুনছি আর অবাক হচ্ছি। টোনি এই সান্টা ক্রুজ কাউন্টির শেরিফ প্রায় তেইশ বছর। আবার লড়বেন। এখানকার লোকজনের ভাল-মন্দের ভার খুব যত্নে তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। কখনও কড়া, কখনও নরম হয়ে সামলেছেন তাঁদের। আমেরিকার নাগরিক, কিন্তু তিনি বেআইনি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নন। ‘যে সব মানুষ, বাচ্চা, মহিলা, বুড়ো কী যুবক, যারাই ও পার থেকে আসে, তাদের অবস্থার কথা কেউ জানে ভাল করে? জানে কি, কেন তারা এত সমস্যা, এত বিপদ পেরিয়ে এ দিকে চলে আসতে চায়? মানুষ একটু বাঁচার তাগিদে আইন ভেঙে এ পারে আসে। কাগজপত্র নেই বলে অমানুষের মতো আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না।’
অথচ, আমেরিকা তখন উত্তাল ২০১৬’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে নামা ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর গরম গরম বক্তৃতা নিয়ে। ট্রাম্প বলেছিলেন, সমস্ত বেআইনি অভিবাসীদের মেক্সিকো ফেরত পাঠানো হোক। কারণ মেক্সিকো থেকে আসে কেবল অপরাধীরা, কেউ ড্রাগ ডিলার, কেউ রেপিস্ট কেউ বা গ্যাংস্টার। কিন্তু বাস্তব তো অন্য কথা বলে। মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসীদের বেশির ভাগই আমেরিকায় রোজগারের আশায় এসেছে। থেকে গিয়েছে, সংসার পেতেছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে। আমেরিকাই এখন তাদের দেশ হয়ে গিয়েছে। আজ হঠাৎ করে এত বছরের থিতু জীবন থেকে উপড়ে ফেললে মানুষগুলো যাবে কোথায়? আবার সেই নিঃস্ব, সর্বহারায় পরিণত হবে? জীবনে পুরো ফেল?
সমস্যা আছে ঠিকই। এই সীমান্ত দিয়েই বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার হয় আমেরিকায়। এবং সেটা আমেরিকা ও মেক্সিকোর বড় একটা সমস্যা। সীমান্ত বরাবর প্রচুর সুড়ঙ্গ গড়ে উঠেছে। আর সেই সব সুড়ঙ্গ দিয়ে পাচার হচ্ছে মাদক। তা থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাংস্টার লড়াই। টোনিও তো বার বার বলছিলেন, ড্রাগ পাচার আটকাতে পারলে মেক্সিকান অভিবাসীদের পক্ষে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে সবার ওপর খাঁড়া নেমে আসবে, সেটা তো ঠিক ধর্মের কথা হল না! যারা বৈধ নাগরিক, তাদের মধ্যে মাদক পাচারকারী কিংবা ধর্ষণকারী কিংবা গ্যাংস্টার কি নেই?
তবে এ তো গেল একটা দলের কথা, যারা বেড়াজাল টপকে, রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে এসেছিল। আর এক দলের কী হবে? যারা এখানে জন্মেছে, আমেরিকান আদবকায়দায় বড় হয়েছে, আমেরিকান শিক্ষা পেয়েছে? আজ তারা হঠাৎ মেক্সিকান অভিবাসীর ছেলেমেয়ে হওয়ার অপরাধে দ্বীপচালান হয়ে যাবে? না ঘর কা, না ঘাট কা হওয়ার অনিশ্চয়তায় ভুগছে বিরাট সংখ্যক শিশু থেকে কিশোর— বেআইনি মেক্সিকান অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা। সোফি ক্রুজ তাদেরই প্রতিনিধি। অথচ ২০০১ সালে এদের জন্যই প্রস্তাবিত হয়েছিল ড্রিম অ্যাক্ট। ‘ড্রিম’, ভেঙে বললে ডেভেলপমেন্ট, রিলিফ অ্যান্ড এডুকেশন ফর এলিয়েন মাইনর্স। ষোলো বছরের কম বয়সে আমেরিকায় আসা, অন্তত পাঁচ বছর টানা আমেরিকায় বসবাস করা, ন্যূনতম একটা শিক্ষা পাওয়া এবং, হ্যাঁ, ভাল নৈতিক চরিত্রের, অভিবাসীদের আমেরিকান সমাজে ও অর্থনীতিতে গ্রথিত করে নেওয়ার জন্যই এই আইন। যারা এই শর্ত মেনে চলবে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। আর বোঝাই যায়, ঠিকঠাক একটা জীবনের সুযোগ পেলে এই অভিবাসীরা ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’-এর যথার্থ শরিক হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু মার্কিন সেনেট সেই বিল পাশ করেনি। অভিবাসীদের— ‘ড্রিমার’দের— সমস্যা মেটেনি। এদের কোনও কলেজ ভর্তি নিতে চায় না, এদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বরাদ্দ করে না, আরও অনেক বৈষম্য পদে পদে সইতে হয় এদের। মোদ্দা কথা, একটা ঠিকঠাক জীবনের দিকে এগোতে পায় না এরা। শুধু তো আইন আর বিল সব কিছু বদলাতে পারে না। মানুষের মন না বদলালে সমাজ বদলায় না, আর সমাজ না বদলালে আইন কিস্যুটি করতে পারে না।
তবে অ্যারিজোনা এই ড্রিমারদের নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান এদের প্রাইভেট কলেজে পড়ার সুযোগ কিংবা প্রাইভেট সংস্থায় থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে। তার কারণও আছে। অর্থনৈতিক কারণ। দু’দিকের অর্থনীতি স্বাভাবিক বন্ধনে জড়িয়ে আছে, সীমান্ত তার কাছে হার মেনেছে। এ সীমান্ত ঠিক যেন পূর্ণ-সীমান্ত নয়। এক বেলার অভিজ্ঞতায় তেমন কোনও কড়াকড়ি নজরেও পড়ল না। শুনলাম সাংবাদিকরা নাকি কেবল পাসপোর্ট পকেটে প্রায় রোজ এ পার ও পার করেন। ব্যবসায়ীরাও। অ্যারিজোনার ব্যবসাও অনেকটা মেক্সিকো-নির্ভর। আর তাই মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর দাম যখন পড়ল, তখন চিন্তার ভাঁজটা কিন্তু অ্যারিজোনা সরকারের কপালেও পড়েছিল। এতটা সহজ পারাপারের সুযোগ থাকলে, সেখান দিয়ে যে বেআইনি লোকজন আসবে, এ আর আশ্চর্য কী! শুধু অভিবাসীর জোগান নয়, চাহিদাও তো আছে। এরা না থাকলে সমাজের সমস্যা হবে। ফার্মে কম পয়সায় কারা কাজ করে? ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কম পয়সায় কারা খেটে মরে? হোটেলে বেল-বয়ের কাজ কারা করে? রাস্তার ধারে রোড-সাইড ফুড-কার্ট কারা চালায়? বেশির ভাগ তো এদের মতো মানুষরাই চালায়। এই অভিবাসীরা এখন আমেরিকার প্রয়োজনীয় কর্মী। তা হলে? এদের থেকে সুবিধেটুকু নেব আর অসুবিধেটুকু আঁচিয়ে ফেলে দেবে, তা কি হয়?
হয় না বলেই বোধ হয় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলে চলেছেন, অভিবাসীদের ব্যাপারটা মার্কিন প্রশাসনকে মানবিক ভাবে বিচার করতে হবে। যারা বেআইনি ভাবে সীমান্ত পার করার চেষ্টা করছে তাদের নিশ্চয়ই আটকানো হবে। যে সব অভিবাসী অপরাধ করছে, দেশের আইনে তাদের বিচার হবে। কিন্তু যারা এত বছর ধরে আমেরিকায় রয়েছে, এই দেশকে আপন করে নিয়েছে, এই সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে, তাদের এখন এই দেশ থেকে উৎখাত করা অন্যায়। এবং সব থেকে বড় সত্যটা আমেরিকাবাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি: আমেরিকা কিন্তু অভিবাসীদেরই দেশ। সে ইতিহাস ভুলে গেলে ইতিহাস লজ্জা পাবে।
তা হলে, সোফি ক্রুজ, এ বার যদি তোমায় বা তোমার মা-বাবাকে কেউ অবৈধ অভিবাসী বলে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে, তুমি সেই আগমার্কা মার্কিন নাগরিককে জিজ্ঞেস করতে পার, ‘তুমি কোথা হইতে আসিয়াছিলে? ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স? কোন দেশটা তোমার ছিল— আসলে?’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy