টুঙ্গি ‘বিওপি’।
আকাশভাঙা রোদ্দুরে ডাইনে-বাঁয়ে এলিয়ে পড়ে আছে বর্ডার রোড। রাস্তার গলা পিচে ব্যাঁকাত্যাড়া ছায়া ফেলে দেশ আগলাচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া।
সারি সারি শিরীষের ছায়ায় বিএসএফের তন্দ্রাচ্ছন্ন আউটপোস্ট। উর্দির অনুশাসনে কি সীমান্তের লক্ষ্মণরেখা অটুট রাখা যায়!
এ পারের শামুখখোল ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় ও পারের শালুক-পদ্মের বিস্তীর্ণ জলায়। কাঁটাতারের সীমানা ভেঙে ও পারের কৌতূহল উড়ে আসে এ পারে “আপনাগো দ্যাশে কি এই বার পদ্ম ফুলের সরকার অইবো নাহি?”
জেলা কুষ্ঠিয়া, বাংলাদেশ। গ্রামের নাম উথলি। কাঁটাতারের ওপার থেকে আলম শেখের আর্তি “যে-ই আসুক, দ্যাখবেন কর্তা আমাগো সম্পক্কটা য্যানো ঠিকঠাক থাহে!”
হু হু লু বইছে। বাংলাদেশ সীমান্ত ছুঁয়ে বহিরগাছি, বগুলা, দর্শনার রাস্তায় গাছে গাছে বৈশাখের দুপুরে পতপত করে উড়ছে ফ্লেক্স হাস্যমুখ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
পুঁটিমারি সীমান্তের কাছে স্তব্ধ আমবাগান। পুরনো শতরঞ্জির দু’প্রান্তে পাটের দড়ি বেঁধে গ্রামীণ হ্যামক। দোলনায় বসে পাঁচ মাসের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মণিমালা বিশ্বাস প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা এই মোদীবাবু লোকটা কেমন গো, ভাল?”
নিস্তব্ধ দুপুরে ডুবে থাকা টুঙ্গির সেই গ্রাম থেকে প্রশ্নটা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম। ভীমপুরের সুপ্রভাত বিশ্বাস এ বার ‘মোদীবাবু’র দলেরই প্রার্থী। বলছেন, “তা মোদীবাবু কেমন মানুষ কী করে বোঝাই বলুন তো! এটুকু বলতে পারি, ওঁর জন্য আমাদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে।”
ভাজনঘাট, নোনাগঞ্জ, মাজদিয়া মোদীবাবুকে কোনও দিন চাক্ষুষ করেনি। সীমান্তের এই হদ্দ জনপদগুলির উপরে তাঁর ‘ভারত পরিক্রমা’র চপার অচিরে ছায়া ফেলবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবু সীমান্তের গাঁ-গঞ্জে হোর্ডিং, ফ্লেক্স কিংবা প্রশস্ত কাটআউটে দিব্যি ঘরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর এই আটপৌরে জনপ্রীতিতেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন তিনি। অশোক চক্রবর্তী।
দেশ ভাগের যন্ত্রণা নিয়ে ১৯৫০ সালে রেলের জমিতে গড়ে ওঠা কুপার্স ক্যাম্পের বাস্তুহারা কলোনিতে তাঁর দরমার দেওয়াল আর টালির চালার বাড়িটা সদ্য পাকাপোক্ত করেছেন অশোকবাবু। সীমান্ত উজিয়ে আসা উদ্বাস্তু জনতার পাট্টার দাবিতে কুপার্সের মাটি কামড়ে দিনের পর দিন অনশন করেছেন এই সিপিএম নেতা। খোলা বারান্দায় বসে স্বগতোক্তির মতো তিনি আউড়ে চলেন, “চুপিসারে সীমান্ত পেরিয়ে এই কুপার্সের মাঠে ক্যাম্প গড়েছিলাম। রাতভর বৃষ্টিতে গাছতলায় ভিজতাম, স্বপ্ন দেখতাম একটু আশ্রয়ের। সেই কুর্পাসের ঘরে ঘরে এখন দুপুরে কান পেতে শুনুন, টিভিতে চলছে, ‘সাস ভি কভি বহু থি’।”
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে কুর্পাসের ‘মন’টাও কি বদলে গিয়েছে?
শরণার্থী তকমা ঘোচেনি। বাস্তুহারারা তবু যেন শরণ নিয়েছেন বিজেপিরই। কোন বিজেপি? প্রচারে যারা বারবারই অনুপ্রবেশকারীদের তল্পি গোছানোর হুমকি দিয়েছে। এমনকী খোদ প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীও। এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে যে, বিজেপির হুমকির লক্ষ্য কি শুধুই অনুপ্রবেশকারীরা, নাকি সমস্ত উদ্বাস্তু? তার পরেও মোদীবাবু?
ঘর-গেরস্থালি ছেড়ে আসা বাস্তুহারারা কখনওই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের বাইরে অন্য কোনও পরিচয়পত্র পাননি। সীমান্তের মানুষজনের সেই ক্ষোভকেই এ বার ‘টাকার জোরে’ কিনছে ‘কর্পোরেট বিজেপি’ সমস্বরে এমনই অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। অশোকবাবুর আক্ষেপ, “শুধু কংগ্রেস-তৃণমূল নয়, এ বার তো আমাদের কর্মীদেরও টাকা দিয়ে কিনতে চাইছে বিজেপি। অনেকে ফাঁদে পা-ও দিচ্ছে। টাকার জোর কি কম কথা? আসলে কুপার্সের এই প্রজন্মের কাছে বামেদের সেই আন্দোলন এখন রূপকথার গল্প।”
বীরনগরের তস্য গলির মধ্যে অবশ্য কোনও ‘রূপকথা’ নেই। বরং আপাদমস্তক সাংসারিক টানাপোড়েন। মায়ের সঙ্গে রোড-শো-এ সামিল হবে সে-ও। বায়না জুড়েছে সিপিএম প্রার্থীর সাড়ে ছ’বছরের ছেলে।
মা, আমি রোড-শো’তে যাব।
--না বাবা রোদ লেগে যাবে।
না, আমি যা-বো-ও-ও!
—অমন করে না, জানো আমাদের গাড়ি ভেঙে দিতে পারে। তখন কী হবে? হলুদ স্যান্ডো গেঞ্জি। টুকটুকে লাল হাফ-প্যান্ট। হাওয়াই চটি। বাঁশের কঞ্চির মাথায় লাল পতাকাটা আছড়ে ফেলে পা দাপিয়ে নাছোড়বান্দা বালকের দাবি, “যাই না মা, কিচ্ছু হবে না।” ‘ভাঙচুরের’ চিত্রনাট্যে একেবারেই সায় নেই তার।
আড়ংঘাটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা, স্নেহের আড়ালে তাঁর নিতান্তই পুঁচকে-পুত্রের সামনে যতই ‘সন্ত্রাসের’ ছায়াছবি তুলে ধরুন, তিনি নিজেও বিলক্ষণ জানেন, ‘কিচ্ছু হবে না’। তবু, ছেলে ভোলাতে কিছু কিছু গাওনা গেয়ে রাখতে হয়। অর্চনা বিশ্বাস, সিপিএম প্রার্থী, তা জানেন। সংসার সামলে দিল্লি যাওয়ার জন্য কোমর বাঁধা অর্চনা ধরিয়ে দেন, “তিন বছর আগে, বিধানসভা নির্বাচনে রানাঘাট উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলাম। তখন তো ছেলে সবে সাড়ে তিন। তার ছোটটা হাঁটি হাঁটি পা-পা। আমার তো সাজানো বাগান নয় ভাই, সংসার সামলেই সব করতে হয়।”
বাগানটা অঙ্কের হিসেবে বাস্তবিকই সাজানো যাঁর, রানাঘাট বাস স্ট্যান্ডে চোখ ধাঁধানো রোড-শো শুরুর আগে তিনি অবশ্য বলছেন, “এমনটা তো আগে দেখিনি, একটু অস্বস্তি তো হচ্ছেই।” সে কী, কেন?
তাপস মণ্ডল। মোহনপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রানাঘাট কেন্দ্রে শাসক দলের প্রার্থী বলছেন, “রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন করেছি। তবে লোকসভায় লড়াইয়ের সঙ্গে ক্যাম্পাস-রাজনীতির তফাত তো আছেই।”
সাতটা বিধানসভার ছ’টাই তৃণমূলের দখলে। দল বদল করে শান্তিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে শাসক দলে ভেড়ায় সেখানে অবশ্য পুনর্নির্বাচন। দলীয় কর্মীরা প্রত্যয়ী, “আরে বাবা ওটা তো নিয়মরক্ষার নির্বাচন। এই বাজারে তৃণমূল ছাড়া আর কেউ জিততে পারে?” কংগ্রেস বোর্ড গড়লেও গত কয়েক মাসে বীরনগর, কুপার্স এবং শান্তিপুরের পুরপ্রধানরা ভোল পাল্টে সদলবল নাও ভিড়িয়েছেন ঘাসফুলের ঘাটে। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ফুটেছে একচ্ছত্র ঘাসফুল। তা হলে অস্বস্তি কীসের?
তেরঙা অজস্র বেলুন, খান পনেরো মিনিডর ট্রাক, হলুদ ধুতি-গেঞ্জি পরা দুদ্দাড় আদিবাসী নাচ সামনে রেখে ঝলমলে হুডখোলা জিপে উঠেই চশমার কাচ মুছছেন তাপসবাবু। দলীয় কর্মী খেই ধরিয়ে দেন, “দাদা জোড়হাত...।” ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলিয়ে বুকের কাছে হাত জড়ো করেন তাপস মণ্ডল। পিছনে, সিন্থেসাইজার সুর ধরে, “ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি...।”
আর ‘তিনি’? গ্রাম-গঞ্জ, আবাদি মাঠ, কচুরিপানায় আচ্ছন্ন জলাজমি, তারকাঁটায় আড়াআড়ি ছিন্ন সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা রানাঘাট কেন্দ্রের সঙ্গে যিনি ওতপ্রোত ভাবে রয়েছেন, নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর সিংহ বলছেন, “সীমান্তের এই জেলায় দলটাকে বুক দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি ভাই। কিছু তো ফেরত পাবই! আমি ছেলেদের বলেছি, ভয় নেই। রাস্তায় নেমে কাজ কর, প্রার্থী প্রতাপকান্তি রায়ের পাশে থাক। আমি আছি।”
জাতীয় সড়কের কোলেই তাঁর দোতলা ঠিকানায় কোণের ঘরে জানলার পাশে বসে আছেন শঙ্কর। নাগাড়ে বেজে চলেছে মোবাইল। বলছেন, “ক্ষমতায় থাকা মানেই কি শক্তি প্রয়োগ করতে হবে? মারধর করতে হবে? সারাদিন ফোন আসছে, ছেলেরা মার খাচ্ছে তবু মাঠ ছাড়ছে না।” তাঁর অনুমান, শান্তিপুরের মতোই বীরনগর কিংবা কুপার্সেও পুরপ্রধানদের ‘ডিগবাজি’ ভাল চোখে দেখেননি স্থানীয় মানুষ। নির্বাচনে তাঁরা ‘কড়া’ উত্তর দেবেন। আর বিজেপি? কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন শঙ্কর। তারপর বলেন, “বলতে খারাপ লাগলেও, বাস্তব এটাই, সীমান্ত এলাকায় বিজেপি’র একটা হাওয়াটা বইছে।”
সে হাওয়ায় কাঁটাতার উজিয়ে পাখিরা দেশ বদল করে।
সীমান্তের রং-ও কি বদলে যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy