অমলেন্দু চক্রবর্তীর আকস্মিক মৃত্যুর সাড়ে চার বছর বাদে তাঁর গদ্যসংগ্রহ বেরল। তাঁর পাঠক, পরিচিতিজন এ-বই হাতে পেয়ে আবার স্মৃতিমেদুরতায় বিষণ্ণ হলেন। দশটি বিভাগে (আত্মপ্রসঙ্গে, কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে, সাহিত্য ভাবনায়, নাটক ও নাট্যসাহিত্য প্রসঙ্গে, ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে, বিবিধ প্রসঙ্গে, রিপোর্টাজ ও অন্যান্য, ‘অজাতশত্রু’-র ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’ বিভাগ, ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’-র কলমে এবং ‘মাস্টারমশাই’ ছদ্মনামে) বিন্যস্ত প্রবন্ধ-নিবন্ধের এই সংকলন গোটা মানুষটিকে তাঁর যুক্তি-অযুক্তি, ঠিক-ভুল, অভিমান-কৌতুকবোধ, আস্থা-বিশ্বাস, আস্থাহীনতা-বিশ্বাসভঙ্গ সমেত উপস্থিত করেছে। গল্প-উপন্যাসের সৃজন তার সৃজনের নিয়মেই গল্পকার-ঔপন্যাসিকের চতুষ্পার্শ্বে যে আড়ালটুকু বানাতে চায়, তেমন আড়াল এখানে নেই। আর তা নেই বলেই, যাঁরা এখনও অমলেন্দুর আকস্মিক মৃত্যুর আবর্ত থেকে পুরোপুরি বেরোতে পারেননি, তাঁরা বিষাদগ্রস্ত হবেন বইটি পড়তে পড়তে।
‘আত্মপ্রসঙ্গে’ অংশের ‘আকালের সন্ধানে-র সন্ধান’ বা ‘প্রসঙ্গ ‘যাবজ্জীবন’: আমার জীবনবন্দি’র মতো লেখায় পাঠকের নাগালে আসে আকালের সন্ধানে এবং যাবজ্জীবন উপন্যাস দুটি গড়ে ওঠার আনুষঙ্গিক বহু তথ্য এবং মুহূর্ত। আবার, ‘মাস্টারমশাই’ ছদ্মনামে লেখা ‘মাধ্যমিক শিক্ষা: যা চলছে’ কিংবা ‘বিবিধ প্রসঙ্গে’র অন্তর্গত ‘শিক্ষা সংকট: শিক্ষকের ভাবনা’, ‘নির্মাণে সংকল্প চাই’ পড়লে যেন স্পষ্ট হয়, কেমন করে হুগলির গুড়াপ গ্রামের, কলকাতার খিদিরপুর একাডেমির মাস্টারমশাই অর্জন করেছিলেন ‘পঞ্চাশটি মানবশিশু, একজন দেবদূত’-এর মতো বিশিষ্ট গল্প লিখবার অধিকার। পাশাপাশি আছে ‘ন-এরা দুই শরিক, শ-এরা তিন’, ‘বিজ্ঞান-মন’, ‘পথ যদি একটাই’ বা ‘তেপান্তর ডিঙিয়ে এসে’-র মতো নিবন্ধ। আপাতনীরস বিষয়ের পরতে-পরতে আন্তরিক মায়া-মমতা বিছিয়ে দেন মাস্টারমশাই, জীবনের দুরূহ প্রশ্নকে পৌঁছে দিতে চান স্কুল-পড়ুয়াদের কাছে। আর কখনওই শিক্ষকতার অধিকারে ভুলে যান না যে, আজীবন তিনি শিক্ষার্থীও বটে। ‘খেলা যদি খেলা না হয়’-এর সংবেদন পাঠকের মনে ফিরিয়ে আনে অমলেন্দুর ‘উদ্বাস্তু’ গল্পটির স্মৃতি। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলায় হার-জিত সমর্থকদের উত্তেজনাকে কতখানি বিভ্রান্ত করে, দেশাত্মবোধকে কেমন ঢেকে ফেলে ভুল অর্থে, তারই জন্য হাহাকার ছিল ‘উদ্বাস্তু’ গল্পে। নিবন্ধটি যেন সেই গল্পের প্রস্তুতিপর্ব।
বিষাদ থেকে উল্লাস, পরাজয় কিংবা জয়, সংযম অথবা ক্রোধ, সর্বত্রই যেন চিন্তার সুতোয় কেমন জট পাকিয়ে গেছে। ওই জটের জটিলতা যে অমলেন্দু সর্বদা খুব অব্যর্থ চিনতে আর চেনাতে পারছেন, তা নয়। কিন্তু অমলিন শুদ্ধতায় ওই জটিলকে সম্ভাষণ করতে চাইছেন বার-বার। সে চাওয়ার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই। কোনও দিনই ছিল না। নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ‘অজাতশত্রু’ নামে সাহিত্য প্রসঙ্গে লেখা নিবন্ধগুলি কিংবা ‘বাংলার সাহিত্য’র মতো প্রবন্ধ নিশ্চয় গদ্যের চলনে এবং বিষয়ের বিন্যাসে পঁচিশ-অনূর্ধ্ব যুবকের ‘লেখাজোকার হাতমশকরা’রই হদিশ দেয়। তবু বিষয় নির্বাচন থেকে প্রবন্ধের পরিণতি পর্যন্ত চিন্তকের এবং লেখকের খাঁটি আর জিজ্ঞাসু মনের খোঁজ মেলে।
দু’টি বিভাগে বিন্যস্ত সাহিত্য-সংক্রান্ত চব্বিশটি লেখা অমলেন্দু চক্রবর্তীকে চিনবার পক্ষে একান্ত জরুরি। অগ্রজ, সমসাময়িক এবং অনুজ কথাসাহিত্যিকদের লেখার পাঠে তাঁর সশ্রদ্ধ সমর্পণ, সভ্য অ-সহমত পোষণ আর সস্নেহ প্রশ্রয় স্পষ্ট। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অসীম রায় থেকে লুত্ফর রহমান, অংশুদেব পর্যন্ত সকলের সৃজনেই তাঁর সমান অভিনিবেশ। তিনি যেমন আফসার আমেদের প্রথম গল্প-সংকলনের মর্মস্পর্শী ভূমিকা লেখেন, তেমনই দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘...শুধুমাত্র লেখকেরই চ্যালেঞ্জ নয়... এ-উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা...পাঠকের নিজেরও চ্যালেঞ্জ। (৮০ পৃষ্ঠা)। নাটক দেখা কি শেষ দিকে কমে গিয়েছিল অমলেন্দুর? নাটক আর নাট্য-সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থিত লেখাগুলির সর্বশেষটি প্রথম বেরিয়েছিল গত শতকের আশির দশকের গোড়ার দিকে। তবে বালুরঘাটের ‘ত্রিতীর্থ’ নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনা নিয়ে যখন তিনি লিখেছিলেন, তখন ‘ত্রিতীর্থ’ শহর কলকাতায় আজকের মতো চেনা নাম ছিল না। নতুন কাজের দিকে অমলেন্দু সাগ্রহে তাকাতে জানতেন। নতুন প্রজন্মের কোনও প্রচেষ্টায় সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলেই তাদের প্রশ্রয় দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। গুড়াপের বা খিদিরপুরের পুরনো ছাত্ররা, বাগবাজারের ‘চেতনা’ গোষ্ঠীর সদস্যরা তাঁর এই স্বভাবকে নিশ্চয় খুব ভাল চিনতেন।
‘ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে’ শিরোনামে গ্রন্থিত ছ’টি প্রবন্ধের মধ্যে ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্য: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা’য় পাওয়া যায় ১৯৩৯ সালে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার ‘হিটলার সংখ্যা’ প্রকাশের প্রায় অজানা খবর (২৭৭ পৃষ্ঠা); তখনও পর্যন্ত প্রায় অনালোচিত এবং খুবই অল্পপঠিত জগদীশ গুপ্তর ছোটগল্পের বিশিষ্টতার উল্লেখ মেলে ১৯৬০ সালে লেখা প্রবন্ধে (৫০ পৃষ্ঠা)। শ্রীবটুক ছদ্মনামে শম্ভু মিত্র ‘চাঁদ বণিকের পালা’র অংশমাত্র তখন প্রকাশ করেছেন, ১৯৬৮-তে অমলেন্দু লিখেছেন, ‘এ নাটক বাংলা নাটকের ভবিষ্যতের অন্যতম সম্ভাব্য পথনির্দেশ।’ (২০৩ পৃষ্ঠা)। আশা-ভরসার উপাদানে যাঁর এমন ঐকান্তিক আগ্রহ, সংস্কৃতির যে-কোনও ক্ষেত্রে বিশিষ্টের প্রতি, সংবেদনের প্রতি যাঁর এত সম্ভ্রম, উত্কৃষ্টের উজ্জ্বলতায় যাঁর এত আস্থা, তাঁর সমকালীন চতুষ্পার্শ্ব ক্রমাগতই তাঁর মনকে নিরাশ্রয় করেছে।
গদ্যসংগ্রহ, অমলেন্দু চক্রবর্তী।
দে’জ পাবলিশিং, ৫৫০.০০
ভূমিকায় অলোক রায় তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষটির সেই বেদনার্ত মনের আভাস দিয়েছেন। ১৯৪৫-এ রোগক্লিষ্ট বালককে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সকের বিধান মেনে অভিভাবকরা পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। তার পর আর বেশি দিন ছেড়ে আসা দেশটা স্বদেশ থাকেনি, গোটা পরিবার এসে পড়ে এ পারে। অনুকূল দৈনন্দিনের শরিক ছিলেন না অমলেন্দু। তাঁর দুরূহ অথচ সদাহাস্যময় জীবনযাপনের যে ঋজু চিত্র, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, আস্থা এবং আস্থাভঙ্গের যে আন্তরিক বিন্যাস সুলিখিত ভূমিকাটিতে মেলে, তা পাঠককে এই গদ্যসংগ্রহ-এর পাঠ তৈরি করবার পথ বলে দেয়।
পাঠক যেন নতুন করে বোঝেন, ১৯৭৩-এর ‘স্বদেশ সংসারে’ কাহিনি থেকে ২০০০ সালে ‘উদ্বাস্তু’র মতো গল্পে পৌঁছনোর যন্ত্রণা। তাঁর লেখা নিয়ে যাদের জীবনে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই, সেই গোষ্ঠবিহারী কিংবা রাধিকাসুন্দরী কোন যুক্তিতে, কোন আবেগে বার-বার এসে পড়ে অমলেন্দুর সৃজনের কেন্দ্রে, সেই কার্যকারণেরও এক ইঙ্গিত যেন গড়ে ওঠে। ভূমিকার অন্তিমে বহুবিচিত্র গদ্যগুলির সংগ্রহ এবং সংকলনের জন্য প্রিয়দর্শী চক্রবর্তীকে পাঠকদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অলোক রায়। সংকলনের একান্ত মানানসই ভূমিকা-লেখককে খুঁজে নেওয়ার জন্য আর জরুরি ‘নির্ঘণ্ট’-এর জন্যেও প্রিয়দর্শীকে ধন্যবাদ।
এ সংকলন জুড়ে অমলেন্দু চক্রবর্তীর জীবনভর বহুবিচিত্র দেখাশোনা, চেনা-জানার হদিশ পান পাঠক। সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চিত্রশিল্পে, শিক্ষার অবস্থায় এবং ব্যবস্থায়, সমাজের পরিবেশে এবং চলনে, রাষ্ট্রের সরবতায় এবং নীরবতায়, আদর্শের বিশিষ্ট লালনে, আবার নির্লজ্জ স্খলনে— অমলেন্দুর সব দেখাশোনাই শেষ পর্যন্ত নিজের সময়কে বহন করবার আর্তি, নিজেদের সত্যি-মিথ্যাকে যাচাই করবার তাগিদ। ওই বহন অথবা যাচাই যে সর্বদা নির্ভুল ছিল, এমন নয়।
অভ্রান্তের দাবিও তাঁর ছিল না। তবে, আর্তি আর তাগিদ ছিল বড় নির্ভেজাল। আর সেখানেই সম্ভবত তাঁর বেদনার মূল উত্স। এই গদ্যসংগ্রহ-এর পাঠ হয়তো সেই বেদনাকেই সম্মান জানানোর নামান্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy