নীল মুখোপাধ্যায়ের বইটি আসলে ইংরেজি ভাষায় লেখা বাংলা উপন্যাস। এখানে পুলিশের মারে রক্তাক্ত হতে হতে নকশাল সুপ্রতীক ভাবে, ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো/ তোমার ওই দেবালয়ে প্রদীপ করো।’ কোথাও আবার বিউলির ডাল কিংবা সর্ষে বাটা দিয়ে মাছ রান্না। ভবানীপুরে এই ছাদের মেয়ের সঙ্গে ওই ছাদের ছেলের কথা চালাচালি। ননদ বউদিকে বলে, ‘ছোটলোক, বেহালার মেয়ে। বেহালা থেকে মেয়ে আনা যায়, কিন্তু তার মন থেকে বেহালা তোলা যায় না।’ ভবানীপুর-বেহালা শ্রেণিবৈষম্য থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রন্ধনপ্রণালীর অনুপুঙ্খ একেবারেই বাঙালির নিজস্ব।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র নীলের এই উপন্যাস নকশাল আন্দোলন নিয়ে। গত বছর একই থিম ঘিরে বেরিয়েছিল ঝুম্পা লাহিড়ির দ্য লো ল্যান্ড। কিন্তু ঝুম্পার উপন্যাসের অর্ধেকই ছিল বস্টন ও লঙ আইল্যান্ডের জীবন। নীলের বিশাল উপন্যাস কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের কলকাতা এবং ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি ছাড়ায়নি।
ঘটনাচক্রে ঝুম্পা এবং নীল কেউই সত্তর দশকের আন্দোলন দেখেননি। এটি তাঁদের আগের প্রজন্মের ঘটনা। পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বায়িত বাঙালির দেখার রাজনীতিটি অন্য রকম। গত প্রজন্ম আগে নকশাল আন্দোলনে প্রতিবাদী নায়ককে খুঁজে পেত। এখানে ভবানীপুরের ছেলে মেদিনীপুরের গ্রামে গিয়ে জোতদার খতম করে, শেষে কাকিমার গয়না চুরি করে বোমা, পাইপগান কেনে। এবং সেই গয়না চুরিতে বাড়ির বর্ষীয়ান ভৃত্য মদনকে চোর সাজায়। মদন তাকে বলেছিল, ‘আপনার জন্য মা কান্নাকাটি করেন। অচেনা অজানা জনসাধারণের চেয়ে কি নিজের লোকদের ভাল করাটাই ভাল নয়, বাবু?’ প্রেসিডেন্সি কলেজের নকশাল নেতা সুপ্রতীকের মেজাজ গরম হয়ে যায়। কাজের লোক তাকে রাজনৈতিক ন্যায়-অন্যায় শেখাচ্ছে!
দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তিমানস এবং দ্বন্দ্বদীর্ণ বাঙালি সমাজকেই বারংবার খুঁজেপেতে দেখান নীল। অপরের জীবনে কি সত্যিই আমরা কোনও দিন প্রবেশ করতে পারি? বেলপাহাড়ির গ্রামে ভূমিহীন খেতমজুরের কুঁড়েঘরে শুয়ে সুপ্রতীকের চিন্তা, ‘এই লোকগুলি আমাদের সম্বন্ধে কী ভাবে? শহুরে বাবু, টাকা আছে... এতই যখন জানে, বিপ্লব-টিপ্লব না আউড়ে আমাদের কিছু টাকা দেয় না কেন?’ ধান রোপণ থেকে ফসল কাটা প্রতিটি কাজেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে আরবান গেরিলা বুঝতে পারে, ‘সময় কাটতে চায় না, সময়ের ভার এখানে বিশাল। চাষিরা শুধু দারিদ্রে নয়, থমকে-যাওয়া সময়ের ভারেও নিষ্পেষিত।’ বাবা নকশাল ছেলেকে বলেন, ‘আমাদের মুখে চুনকালি দিচ্ছ। দুনিয়ার সামনে আর মুখ দেখানোর জো নেই।’ ছেলে ভাবে, ‘বাবা কি সত্যিই দুনিয়া চেনেন? না কি, নিজের সামাজিক অবস্থানের কথা ভাবছেন? যে যার অবস্থান থেকেই তো দুনিয়া বিচার করে।’ নীল মুখোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে কোনও বিপ্লবী নায়ক খুঁজতে চাননি। সত্তর দশকের সমসাময়িকতা, পরিবার ও সমাজের চাপে দীর্ণ বাঙালি যুবকই তাঁর উপজীব্য। সেখানেই এই উপন্যাস পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা।
বাঙালি পরিবারের ভেতরে যে কত ছুঁচোর কেত্তন, বারংবার দেখিয়েছেন নীল। দক্ষিণ কলকাতার ২২/৬ বসন্ত বসু রোডের চারতলা বাড়িতে এই উপন্যাস শুরু। ধনাঢ্য পরিবার, কাগজ তৈরির কারখানা রয়েছে। ক্রমে দেশভাগ, ব্যবসাবুদ্ধি না রেখে বিশাল অঙ্কের ঋণ, কারখানায় সিপিআইএমের ইউনিয়নবাজি ইত্যাদি কারণে তিন পুরুষের ব্যবসা ডুবতে থাকে। কার লকারে কত সোনা তা নিয়ে শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। পাড়ায় কেউ একটা ঘটনার ইঙ্গিত পেলেই হল! ‘দুনিয়া এখানে এ ভাবেই চলে। তোমার হাতে শূন্য, মৃত সময়। তাই অন্যের জীবনে উঁকি মারার সুযোগ পেলেই হল,’ ষাটের দশকের কেচ্ছাভুক বাঙালি সমাজে এ ভাবেই কামান দেগেছেন লেখক। এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে উত্থানের উপায়? ঔপন্যাসিক ভেবেছেন, প্রতিভা। বাড়ির অবহেলিত শিশুটি মৌলিক সংখ্যা নিয়ে ভাবে, স্কুল শেষ করার আগেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক। শেষে অঙ্কের নোবেল ‘ফিল্ডস মেডেল’ জয়। এই জায়গাটি বেশ কাঁচা। একদা ‘দুঃখজয়ীর জয়যাত্রা’ গোছের বাংলা উপন্যাসে প্রতিভাবান দরিদ্র শিশু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হত, এখন সিলিকন ভ্যালিতে যায়!
উপন্যাসের শেষে ২০১২-য় পলামুর জঙ্গলে মাওবাদীরা রেললাইনে ফিশপ্লেট সরায়। তাদের নেতা জানায়, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনের প্রতীকদা এ ভাবে ফিশপ্লেট সরানো শিখিয়েছিল। ফিশপ্লেট সরানোই নকশাল আন্দোলন থেকে মাওবাদীদের প্রাপ্ত উত্তরাধিকার? এতেও শেষ হল না। পলামুর জঙ্গল বেয়ে তখন কলকাতা-অজমেঢ় এক্সপ্রেস ছুটে আসছে। অজমেঢ়ের ট্রেন পলামু লাইন দিয়ে ঘুরে যাবে কোন দুঃখে?
তবে নতুন দৃষ্টিটিও অনস্বীকার্য। নকশাল আন্দোলন নিয়ে আগের প্রজন্মের রোমান্টিক বিপ্লববাদী সাহিত্য যা বলেনি, এখানে ভৃত্য মদন সুপ্রতীককে সেই কথাটি শুনিয়েছে: ‘বড়বাবু, দুনিয়া বদলায় না। বদলানোর চেষ্টা করতে করতে আপনি নিজেকে শেষ করে দিতে পারেন, কিন্তু পৃথিবী এক রয়ে যাবে।’
দ্য লাইভ্স অব আদার্স, নীল মুখার্জি। র্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়া, ৫৯৯.০০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy