Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

প্রশ্ন জাগে আত্মনাশের দিকেই কেন ছুটে যায় মানুষ

‘এক্সপেরিমেন্টার’-এ অনুষ্ঠিত হল আশিস অভিকুণ্ঠকের ভিডিয়ো প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষসম্প্রতি ‘এক্সপেরিমেন্টার’-এ অনুষ্ঠিত হল আশিস অভিকুণ্ঠক-এর একটি ভিডিয়ো প্রদর্শনী। ১০৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিঙ্গল চ্যানেল ভিডিয়োটির শিরোনাম ‘রতি চক্রব্যূহ’। ২০১৩-তে তোলা এই ভিডিয়ো দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় দেখানো হয়েছে।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সম্প্রতি ‘এক্সপেরিমেন্টার’-এ অনুষ্ঠিত হল আশিস অভিকুণ্ঠক-এর একটি ভিডিয়ো প্রদর্শনী। ১০৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিঙ্গল চ্যানেল ভিডিয়োটির শিরোনাম ‘রতি চক্রব্যূহ’। ২০১৩-তে তোলা এই ভিডিয়ো দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় দেখানো হয়েছে।

উত্তর-আধুনিক দৃশ্যকলার প্রকল্পে ভিডিয়ো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমরা জানি চলচ্চিত্রভিত্তিক হলেও ভিডিয়ো আখ্যানধর্মী বা তথ্যমূলক চলচ্চিত্র নয়। ১৯৬৫ সালে পাশ্চাত্যের দুই শিল্পী নাম জুন পাইক ও অ্যান্ডি ওয়ারহোল প্রথম দৃশ্যকলার একটি মাধ্যম হিসেবে যখন ভিডিয়ো তৈরি করেছিলেন, তখন থেকেই এর উদ্দেশ্য ছিল চিত্র ভাস্কর্যের মতো প্রথাগত দৃশ্যমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে প্রকাশের নতুন অভিমুখ তৈরি করা। তার পর থেকে বিশ্ব জুড়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এই মাধ্যম নিয়ে। আমাদের দেশে ১৯৯০-এর দশক থেকে ভিডিয়ো নিয়ে নিবিষ্ট চর্চা হচ্ছে। চিত্রের দৃশ্যতার সঙ্গে এতে যুক্ত হয় সময়ের নতুন মাত্রা এবং আখ্যান ও নাটকীয়তার বিভিন্ন বিন্যাস। ফলে জীবন, সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতির অনেক অনালোকিত ক্ষেত্রের উপর আলো ফেলতে পারে এই মাধ্যম।

আশিস অভিকুণ্ঠক গবেষণামূলক চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছেন ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে। সংস্কৃতিমূলক নৃতত্ত্বের অধ্যাপনা করেছেন বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম মাধ্যমের অধ্যাপক।

রতি চক্রব্যূহ’ নামে আলোচ্য ভিডিয়োটিও তিনি বাংলা ভাষাতেই তৈরি করেছেন। আমরা এত দিন যে ধরনের ভিডিয়ো দেখে এসেছি, এর উপস্থাপনা ও ভাবনার ধরন তা থেকে একেবারেই আলাদা। এটি প্রচলিত আখ্যানধর্মী চলচ্চিত্রের মতোই দীর্ঘ কিন্তু প্রচলিত অর্থে এতে কোনও আখ্যান নেই। শুধু দীর্ঘ প্রবাহিত সংলাপ আছে, কিন্তু কোনও দৃশ্যের প্রবাহ নেই। যে সংলাপ প্রবাহিত হয়ে চলে ১৩টি দৃশ্যমান চরিত্রের মধ্য দিয়ে, তা অনেকটা কবিতার মতো। তা অতীত, বর্তমান, ইতিহাস ও পুরাণকল্প থেকে নানা ঘটনা তুলে আনে। সেই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে। তার ভিতর থেকে সত্যের আলো-ছায়া সন্ধার করে। কিন্তু সত্যের কোনও নির্দিষ্ট স্বরূপে পৌঁছয় না। কেবল এক অস্তিত্বের সংকটকে অনাবৃত করে যায়। এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত থেকে শুরু হয়। এবং অন্তিমে এক বিলয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। শিল্পী তাঁর ভূমিকা-স্বরূপ লেখায় একে বলেছেন: ‘আত্মবিনাশের পূর্বে মৃত্যুর নাটকীয় সংলাপ’।

কাহিনির যে একটি সামান্য রূপরেখা আছে, তা এরকম। একটি গণবিবাহের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। অনুষ্ঠান অন্তে ছ’টি সদ্যবিবাহিত যুগল এক চন্দ্রগ্রহণের মধ্যরাতে একটি জনবিরল মন্দিরে সমবেত হয়েছে। এই স্ত্রী পুরুষ মিলিয়ে ১২টি চরিত্র ছাড়াও রয়েছে একজন পুরোহিত। তারা বৃত্তাকারে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কথা বলছে নানা বিষয়ে। হিংসা, প্রেম, মৃত্যু, যৌনতা, ক্রিকেট, আত্মহত্যা, দেবদেবীর জীবন, ধর্ম, রাজনৈতিক হত্যা, অহিংসা, গাড়ি, রায়ট ইত্যাদি নানা বিষয় চক্রাকারে উঠে আসছে তাদের সংলাপে। চক্রাকারে অনেকটা শঙ্খিল গতিতে ক্যামেরা ঘুরছে। আমরা শুধু চরিত্রের মুখগুলোই দেখছি, তাদের অভিব্যক্তি দেখছি। এ ছাড়া কোনও দৃশ্যের বাস্তব উদ্ভাসিত হচ্ছে না। ফলে দর্শকের কল্পনায় তৈরি হচ্ছে এক কল্পিত বাস্তব। দর্শক নিজের মতো করে এর মূল্যায়ন করছেন। কথা ওঠে রামায়ণে সীতা ও রাবণের সম্পর্ক নিয়ে। বলা হয় রাবণ সীতাকে হরণ করেনি। সীতা স্বেচ্ছায় রাবণের সঙ্গে গেছে। রাবণকে সে ভালবেসেছে। রাবণ তাকে শারীরিক তৃপ্তি দিয়েছে, যা রামচন্দ্র দিতে পারেনি।

সংলাপ শুরু হয় সৃষ্টিতত্ত্ব দিয়ে। শুরুতে কী ছিল? শুরুতে কি শব্দ ছিল? প্রেম ছিল? তার পরে কী ভাবে প্রবাহিত হয়েছে এই সৃষ্টি? তাতে যৌনতার অবদান কতটুকু? সব যৌনতাতেই কি প্রেম থাকে? আত্মনাশের দিকে কেন ছুটে চলে মানুষ? এই চলচ্চিত্রটিও শেষ পর্যন্ত সব চরিত্রের আত্মনাশেই সমাপ্ত হয়। আজকের সভ্যতার সংকট মানব-অস্তিত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এই নিরাশার বার্তাই বহন করে এই ছবিটি। বলা হয়েছে শিল্পী অনুপ্রাণিত হয়েছেন লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’ ছবিটি থেকে। ছবিতে খ্রিস্টীয় পুরাণকল্পের সংকটকে আজকের প্রেক্ষাপটে পরিব্যাপ্ত করা হয়েছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE