Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

‘তাঁদের হৃদয় অবশ্য তুচ্ছ ছিল না’

আমাদের চেয়ে অনেক কম বয়সের যেসব কবিকে কাছ থেকে দেখেছি আমি, কিছু কম কিছু বেশি, তাদেরই মধ্যে কয়েকজনের কথা মাত্র বলতে পারলাম এখানে।’ প্রতিমা ঘোষ লিখেছেন তাঁর আপনজন ক’জন কবি-র (পাঠক, ১৫০.০০) ভূমিকায়। সঙ্গে এও জানিয়েছেন: ‘ব্যক্তিগত পরিচয়সূত্রই এ বই-এর উদ্ভাবনার মূল।’

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

আমাদের চেয়ে অনেক কম বয়সের যেসব কবিকে কাছ থেকে দেখেছি আমি, কিছু কম কিছু বেশি, তাদেরই মধ্যে কয়েকজনের কথা মাত্র বলতে পারলাম এখানে।’ প্রতিমা ঘোষ লিখেছেন তাঁর আপনজন ক’জন কবি-র (পাঠক, ১৫০.০০) ভূমিকায়। সঙ্গে এও জানিয়েছেন: ‘ব্যক্তিগত পরিচয়সূত্রই এ বই-এর উদ্ভাবনার মূল।’ জয়দেব বসু, জয় গোস্বামী, নির্মল হালদার, একরাম আলি, নিশীথ ভড়, সুব্রত রুদ্র, সব্যসাচী দেব আর ভাস্কর চক্রবর্তী সম্পর্কে তাঁর রচনা নিয়েই বইটি। ব্যক্তিগত পরিচয়সূত্র থেকে পাঠককে পৌঁছে দিয়েছেন কবিতাপড়া-র নৈর্ব্যক্তিকে। যেমন সুব্রত রুদ্রকে নিয়ে রচনাটি, ‘সুব্রতর ব্রত’: ‘‘পাখির কথা সুব্রতর কবিতায় ফিরে ফিরেই আসে। কথায় বলে, মানুষের প্রাণ তো পাখির প্রাণ, এই আছে, এই নেই। তাই কখনো তার কবিতায় মানুষ-ফুল-পাখি একাকার হয়ে দেখা দেয় শুধু প্রাণের আনন্দ হয়ে। ‘শীতের দিনে পাখি চুরি হয় বলে কেউ তাড়াতাড়ি ঘুমোলে/ পাখি এসে পুনর্জন্ম চায় স্বপ্নে’, ‘আমরা পাখির জন্ম সফল করব...’, যে বুড়োবুড়িরা নদীর কূলে কাশফুল হয়ে ফুটে আছে, তাদের কথা, ‘তুমি জীবনে ফিরে আসবে, পাখির কাছে শিখবে জেগে ওঠা।’ আবার, ‘কে কাকে অবজ্ঞা করল?/ পাখির চোখ ঝরঝরিয়ে কাঁদছে’। বৃষ্টির মতো তার ভালোবাসার দৃষ্টি এভাবে ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে।’’

দীপক রায়ের পদ্য নিয়ে গদ্য-র (ছোঁয়া, ১৫০.০০) অধিকাংশ লেখাই রচিত হওয়ার কারণ যেমন সংশ্লিষ্ট স্রষ্টাদের সৃষ্টির প্রতি তাঁর মুগ্ধতাবোধ, তেমনই তাঁদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও। অরুণ মিত্র, আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুধেন্দু মল্লিক, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে লেখকের সখ্যই এই রচনাগুলির প্রাথমিক প্রেরণা। যেমন প্রণবেন্দুকে নিয়ে লিখেছেন ‘কিছুকাল তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম তার টুকরো টুকরো ছবি ভেসে আসে। ‘আরম্ভ, শেষ’ নামের কবিতার দুটি ছত্র মনে পড়ে— যেভাবে আরম্ভ করি, শেষ ঠিক সেভাবে ঘটে না।/ মাঝখান থেকে শুধু একটা জীবন পুড়ে যায়।’

সাংবাদিকতার পেশায় কর্মজীবন কাটানোর সুবাদে একদা বিদুর ছদ্মনামে একটি সাপ্তাহিক কলাম লিখতে শুরু করেন কৃষ্ণ ধর। সে সব রচনারই সংকলন বই পড়ুয়ার দেখা মানুষ (একুশ শতক, ১০০.০০)। যাঁদের নিয়ে লিখেছেন তাঁদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন লেখক। প্রসঙ্গকথা-য় জানিয়েছেন ‘সংবাদপত্রের জন্য লেখা বলে তার আয়তন বিস্তার সম্ভব হয়নি। সে কারণে একটা অতৃপ্তি পাঠকদের মতো আমারও মনে স্বাভাবিক ভাবেই রয়েছে।’ কিন্তু স্বল্পায়তন কখনওই রচনাগুলির অন্তরায় হয়নি, বরং তাঁর অন্তর্ভেদী কলমে নির্মেদ সুঠাম রূপরেখা তৈরি হয়েছে মনীশ ঘটক, গোপাল হালদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সোমেন চন্দ, বিনয় ঘোষ, বা এমন আরও অনেকের। যেমন বিনয় ঘোষ সম্পর্কে: ‘স্বনির্ভর সর্বক্ষণের গবেষক লেখক। সে জন্যেই তাঁর কলম ছিল প্রখর, সত্যসন্ধানী এবং সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ।’

দু’টি খণ্ডে গ্রন্থিত দিব্যজ্যোতি মজুমদারের আমার আত্মজন (গাঙচিল, ২৫০.০০ ও ৩৭৫.০০)। যাঁদের নিয়ে লিখেছেন, প্রতি খণ্ডে আত্মপক্ষ-এ তাঁদের সম্পর্কে পরিচয়সূত্রটি পেশ করেছেন পাঠকের কাছে। যেমন প্রথম খণ্ডে: ‘মুচি মেথর টাঙাওয়ালা মজদুর পকেটমার বৈষ্ণবী বেশ্যা কনডাক্টর টমটমওয়ালা ধোপা পাখমারা— এঁরা তো পেশাজীবী মানুষ। এঁদের আমরা চিনি, আবার চিনিও না। চেনার আগ্রহও নেই। অথচ এই সব অবমানিত মানুষের হৃদয়ের পরিচয় ও অনন্য জীবনদর্শনের পরিচয় পেলে বিস্মিত হতে হয়।’ দ্বিতীয় খণ্ডে: ‘ছেলেবেলা থেকে কিছু মানুষজনের সঙ্গে মিশবার সুযোগ হয়েছিল। অতি সাধারণ হাটবাটের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের তুচ্ছ মানুষ। তাঁদের হৃদয় অবশ্য তুচ্ছ ছিল না।’ এই প্রান্তবাসী মানুষজনকে নিয়ে অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্রই উঠে এসেছে লেখকের কলমে। দ্বিতীয় খণ্ডের একটি রচনা ‘সার্কাসের তাঁবু’, তাতে একটি অনুচ্ছেদে লেখকের মন্তব্য ‘স্বাধীন ভারতেও সার্কাসের কুশীলবদের জীবনবিমা হয় না, এদের প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, অবসরকালীন কিছু সুযোগ নেই। বড় সার্কাস থেকে বহিষ্কৃত হলে অন্ধকার। অন্য কোনও কিছুই জানার সুযোগ ছিল না। তাঁবুই ছিল বিশ্বজগত্‌।’

মৃণাল সেনের অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত-এর (পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ/ দক্ষিণ কলকাতা আঞ্চলিক কমিটি ও থীমা, ১৫০.০০) মুখবন্ধে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এ বই মৃণালবাবুর ‘চলচ্চিত্রভাবনার গভীরতম স্তরে যে রাজনৈতিক প্রত্যয়, জনজীবনাবর্তের যে প্রবল আত্মিক টান, বন্ধু-সহযোগীদের সঙ্গে সখ্য-সমবায়িকতায় যে নিপাট ভরসা’, তা নিয়েই। তাঁর সমকালে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য গ্রন্থিতে যে সমস্ত মানুষ স্মৃতিধার্য হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের নিয়েই লিখেছেন মৃণালবাবু, এঁদের মধ্যে যেমন জসীমউদ্দিন আছেন, তেমনই আছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। যেমন কালী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে রচনাটিতে, নিজের ছবির সঙ্গে সত্যজিত্‌-ঋত্বিক-তপন সিংহ-সত্যেন বসু-অগ্রগামীর ছবিতে তাঁর অভিনয় নিয়ে লিখছেন ‘একটা থেকে আর একটা কতই না আলাদা অথচ কী অসামান্য বিশ্বাসযোগ্যতা... বার বার দেখেও যে চরিত্রগুলো আমাদের চোখে আজও এক একটা বিস্ময়।’

অন্য বিষয়গুলি:

pustak book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE