সম্পর্ক: উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রদ্বয়ের সঙ্গে মেনকা দেবী ও প্রমথেশ বড়ুয়ার মিল চমকপ্রদ
পড়ে মনে হয়, যেন লেখিকার প্রথম উপন্যাস। কিন্তু তিনি চলচ্চিত্র-ইতিহাসবিদ। আসলে গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে চলচ্চিত্র-চর্চায় বিদ্বান সমাজে একটা দিক পরিবর্তন ঘটেছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা বিভাজনও। ত্রিশের দশক থেকে চলচ্চিত্রকে শিল্পকলাসঙ্গমে আরও একটি, না কি নবীনতম, শাখা বলে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রয়াস চলে এসেছে, তা ভেঙে ত্রিশ বছর আগে তাকে সেই পরিমণ্ডল থেকে সরিয়ে পপুলার কালচারের অন্তর্গত করার একটা উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। খানিকটা যেন গণতন্ত্রের ধুয়ো তুলে তথাকথিত অভিজাত বর্গ থেকে চলচ্চিত্রকে তার আমসাধারণ দর্শকমণ্ডলীর নিত্য সমাদরের আবহে পুনঃস্থাপিত করে আইজ়েনস্টাইন-ওয়েলস-বার্গম্যান-কুরোসাওয়া-আন্তোনিয়োনি-গদার-সত্যজিৎ রায় প্রমুখ মহীয়ান নির্দেশকদের প্রত্যন্তে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার একটা রাজনীতি কার্যকর হয়ে যায়। চলচ্চিত্রবিদ্যাচর্চায় ‘পপুলার’-এর একটা রমরমা তৈরি হয়। এই পপুলারের নবমান্যতা তথা নবমর্যাদায় ‘পপুলার’ সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে বটতলার সান্নিধ্য তৈরিই কি এই অন্য রকম উপন্যাসটির প্রস্থানবিন্দু?
বাংলার বটতলা সাহিত্যের অনেক শাখা-প্রশাখার মধ্যে ছিল এক জাতের উপন্যাসের ধারা, যার উপজীব্য বড় মানুষদের পারিবারিক কাহিনি ও সিনেমাপাড়ার কাহিনির কৌশলী অবগুণ্ঠনে-অনবগুণ্ঠনে পরিবেশনায় সাধক-সাধিকাকে সুড়সুড়ি দিয়ে— ইংরেজিতে ‘টিটিলেশন’ শব্দটা আরও লাগসই— মজিয়ে দেওয়ার মোক্ষম সিদ্ধি। আসল ব্যক্তিনাম, স্থাননাম সাবধানে সামান্য পাল্টে সাদৃশ্যের মধ্যে একটা ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন রেখে মানহানির অভিযোগ যেমন এড়ানো যেত, তেমনই ওই সামান্য রহস্যের আড়ালে পাঠক-পাঠিকাদের সন্দেহ চাগিয়ে দেওয়া যেত, আবার আসল কেলেঙ্কারির মাত্রাটি বাড়িয়েও দেওয়া যেত ওই সুযোগে। কল্পনার মিশেলে, অতিরেকের চাতুরিতে কাহিনির পরিধি অবলীলায় আরও রোমহর্ষক হয়ে উঠত, পাঠক-পাঠিকারাও তাঁদের কল্পনাকে উড়াল দিতে পারতেন। শিক্ষিত ভদ্রসমাজে নিষিদ্ধ ও অশালীন বলে বিবেচিত হলেও এই ধারার সাহিত্য কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মধ্যবয়সি সমাজ ও স্কুল পড়ুয়াদের গোপন পাঠসামগ্রী রূপেই মূলত প্রচলিত থাকলেও কলকাতার স্কুলে-কলেজে— পঞ্চাশের দশক সাক্ষ্য দিতে পারে— এই বটতলা চোরাপথে পৌঁছে যেত, তথাকথিত ‘ভদ্র’ পড়ুয়া পাঠককুলের চিত্তবিনোদন করত। সঙ্গে সেই একই জাতের ইংরেজি সাহিত্যেরও চোরাচালান ছিল যথেষ্ট।
এই বইয়ের চাঞ্চল্যকর নাম ‘মেনকা গলায় দড়ি দিয়েছে’ থেকেই সেই মেজাজ ধরার একটা চেষ্টা মনে হয়। যেহেতু কাহিনির পটভূমিকা, পরিবেশ বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের প্রথম দশকের শেষ পর্ব, যাঁরা ওই বিষয়ে অল্পবিস্তর খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের ছ্যাঁৎ করে মনে হতেই পারে যে, এখানে কি তা হলে মুক্তি, অধিকার, উত্তরায়ণ প্রভৃতি ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়ার সহ-অভিনেত্রী মেনকা দেবীর কথা হচ্ছে! রহস্যের ইঙ্গিতটুকু স্পর্শ করে লেখিকা কাহিনি আরম্ভের আগেই কৃতজ্ঞতালিপিতে রহস্য ভেঙে দেন— “এই বইতে আমার মনে ছিল মেনকা দেবীর কথা (যদিও এই বইটি কোনও ভাবেই তাঁর জীবনকে আধার করেনি), ১৯৩০-এর দশকের এই নায়িকাভিনেত্রী বৃদ্ধ বয়সে দারিদ্রের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।”
মেনকা হ্যাজ় হ্যাংড হারসেল্ফ
শর্মিষ্ঠা গুপ্তু
৩৯৯.০০
সাইমন অ্যান্ড শুস্টার ইন্ডিয়া
কী বিচিত্র সমাপতন, যে অভিনেতা-পরিচালকের সঙ্গে ছবিতে অভিনয় করতে করতে উপন্যাসের মেনকা ১৯৩৬-৩৭’এর বর্ষশেষ রাত্রিতে আত্মঘাতিনী হন— পরে ক্রমশ প্রকাশ্য, তাঁরই প্ররোচনায়— সেই রূপবান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিটির নাম অম্বরীশ দেববর্মা (প্রমথেশ বড়ুয়ার নামের সঙ্গে মিল ইঙ্গিতপূর্ণ, আবার প্রমথেশের মতো অম্বরীশও স্টুডিয়ো মহলে ‘সাহেব’ অভিধায় উল্লিখিত)।
উপন্যাস রচনার প্রথাগত প্রকরণ মেনেই উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলিকে প্রথমেই প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হয়— প্রত্যেকেই নিপাট ছাঁচে ঢালা— সম্ভ্রান্তবংশীয় অপাপবিদ্ধা, সুন্দরী কিন্তু পরিমিত অঙ্গিনী, ‘ক্ষুদ্রস্তনী’, বিপুলসমাদৃতা তারকা রমলা; উচ্চাকাঙ্ক্ষিনী যৌনকর্মী অভিনেত্রী রাজবালা; স্টুডিয়োর দায়িত্বশীল কর্মচারী, রাজবালার প্রেমে পাগল, রাজবালাকে বিবাহ করে ঘরনি করার আগ্রহে আকুল অনিল; চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের ব্যবসায়ক্ষেত্রে নিয়োজিত, রমলার আকর্ষণে তাড়িত কিন্তু লাজুক অবিনাশ; রমলার স্বামী ভারত টকিজ়ের মালিক ও চলচ্চিত্র নির্দেশক শল্কার, সুভদ্র, সজ্জন, কিন্তু সফল ব্যবসায়ী; এবং অবশ্যই অভিনেতা-পরিচালক অম্বরীশ দেববর্মা, “বাংলার সবচেয়ে খানদানি জমিদার বংশগুলির অন্যতম একটির উত্তরাধিকারী, স্কুলশিক্ষা ইংল্যান্ডে, উচ্চশ্রেণির চা পার্টিতে যেমন স্বচ্ছন্দ, কালীঘাটের পতিতালয়ে রাত্রিযাপনেও তেমনই।” এই ক’জনকে ঘিরেই স্টুডিয়োপাড়া ও যৌনপল্লির মধ্যে আবর্তিত কাহিনিতে ওই দুই পাড়ার অন্য কুশীলবদের মধ্যে রয়েছে কুটিল মাসিরা, আগ্রহী খদ্দেরকুল, মেদবহুল মাড়োয়ারি শেঠজি ও তাঁকে যৌন সুখদানে দক্ষ নেপালি মর্দক, ‘ন্যাকা’ সুপুরুষেরা। এই দুই পাড়াকে কোনও মতে প্রতিষ্ঠা করেই উপন্যাসের মূল কাহিনি হয়ে দাঁড়ায় রাজবালার পতিতাবৃত্তি থেকে তারকা হয়ে ওঠার দুর্দমনীয় সাধ ও সেই সাধের সুযোগ নিয়েই অম্বরীশের বিকারগ্রস্ত যৌন সাধ পূরণ।
মামার ঔরসে জাত, মায়ের ‘পাপ’-এর সন্তান অম্বরীশ যেন সেই ‘পাপ’-এরই দাক্ষিণ্যে ইডিপাস কমপ্লেক্স, নেক্রোফিলিয়া, সেডিজ়ম আদি সমূহ যৌন বিকারের আকর, সঙ্গে সঙ্গেই পেশাদারি সাফল্যের তুঙ্গে ভারত টকিজ়ের অন্যতম চলচ্চিত্র-নির্দেশক। তিনি যৌনপল্লি থেকে তুলে এনে এক একটি তরুণীকে তারকায় পরিণত করেন, তাঁর যৌন কামনার শিকার রূপে তাঁদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে শেষে বর্জন করেন— কারও মৃতদেহ আবিষ্কার হয়, কেউ ভিখারিনি হন, মেনকা গলায় দড়ি দেন।
উপন্যাসের শুরুতেই রমলার চিন্তায় ‘ক্লাস’-এর বড়াই ও মেনকাদের ‘ক্লাস’হীনতায় তাঁদের পরিণতির ভবিতব্যে তিলেক করুণাবোধ এই উপন্যাসের নৈতিকতার সীমা সুনির্দিষ্ট করে দেয়। অম্বরীশের যৌন পীড়নে রাজবালার যন্ত্রণার বিবরণে অম্বরীশের দানবীয়তাই যেন সর্বতো প্রমাণ বিশালতায় উৎকট থেকে উৎকটতর হয়ে ওঠে, তাতে রাজবালা যেন নিমিত্তমাত্র, পুরোপুরি মানুষই হয়ে ওঠেন না। যে দানবীয়তার শুরু হয় অম্বরীশের মায়ের মৃত্যুশয্যা-পাশে মায়ের তিলে তিলে মৃত্যুযন্ত্রণা ও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ উপভোগ করে মৃতদেহের সেমিজের বোতাম খুলে মৃতার স্তন লেহনে, তা-ই গড়াতে গড়াতে চলে আসে সেই দৃশ্যে, যেখানে অম্বরীশের নির্দেশে ক্যামেরার সামনে নগ্ন রাজবালা গলায় দড়ি জড়িয়ে দড়িতে টান দিয়ে গ্রন্থি আঁট করতে করতে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে, তার চোখ, নাক, যোনি থেকে জল বইতে থাকে, অম্বরীশ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার “প্রতিটি ছোট্ট সেকেন্ডের মজায় বুঁদ হয়ে যায়।”
অম্বরীশের প্রেমিকারূপে তারকাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হয়ে ওঠার লোভেই রাজবালার এই আত্মসমর্পণ। শেষ পর্যন্ত মালি ক্লাসের রমলার দেবীসুলভ আবির্ভাবেই রাজবালার মুক্তি ও তাঁরই মাতৃস্নেহচ্ছায়ে তাঁর নবজীবন লাভ ও তার তারকা রাজ্যের সুরলোক বম্বেতে রাজবালার উত্তরণে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy