কথায় কথায় 'হ-রি-বো-ল' বলতেন মহানায়ক!
এ এক ‘আরব্য রজনী’। মরূদ্যানে খেজুরপাতার ছায়ায় বসে জিন-পরি-জাদুকরের স্বপ্ন নয়, এ কাহিনি এ দেশের জল-মাটি-হাওয়ার। কেবল ‘চিচিং ফাঁক’-এর বদলে এখানে শোনা যায় ‘লাইট্স-ক্যামেরা-অ্যাকশন’।জাদুগুহার দরজা বন্ধ হওয়ার বদলে শোনা যায় ক্ল্যাপস্টিকের শব্দ, প্রোজেক্টরের কিরকির। খুলে যায় স্বপ্নপুরীর সদর ফটক। সাদা পর্দার উপরে আলো-ছায়া এসে বুনে দেয় নকশি কাঁথা থেকে বালুচরী— হরেক কিসিমের স্বপ্ন। যাদের ডাকনাম ‘সিনেমা’। আর সেই সিনেমার রূপকার যখন তরুণ মজুমদারের মতো এক পরিচালক, তখন অবধারিত ভাবেই থাকবে চড়াই-উতরাই ঋদ্ধ এক সড়ক। কখনও তা আকৃতি পাবে গলিঘুঁজির, কখনও সন্ধান দেবে তেপান্তরের মাঠের।
তবে এ বার তরুণ মজুমদারের হাতে ক্যামেরা নেই, রয়েছে কলম। এক মায়াবি জাদুকলম। যা দিয়ে তিনি লিখেছেন প্রায় ৯০০ পৃষ্ঠার পরিসর জুড়ে এক সুবিশাল ‘চিত্রনাট্য’। তাঁর স্মৃতিকথা। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’।
সাবেক পূর্ববঙ্গের এক ছোট শহরে বেড়ে ওঠা ছাপোষা পরিবারের সন্তানটি যখন অভিভাবকদের জানালেন, তিনি ছবির জগতে কাজ করতে চান, বাধা দেননি বাবা-মা। বরং তাঁরাই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন বড়মামার কাছে। তিনি ‘ফিল্মল্যান্ড’ নামে এক কাগজের সম্পাদক। তাঁরই সুপারিশে তরুণ নামে তরুণের প্রবেশ সিনেমাপাড়ায়।
রূপশ্রী স্টুডিয়োয় বিনামাইনের কাজ। পারিশ্রমিক বলতে দু’বেলা দু’কাপ চা। ক্যামেরার কাজ শেখার কথা। সেকালের জগদ্দল ক্যামেরার সঙ্গে পরিচিতি ভাল করে ঘটতে না ঘটতেই পাট চুকল অন্য হেঙ্গামে। বেকার জীবনের চায়ের দোকানের নৈমিত্তিক আড্ডা থেকেই আবার প্রবেশ সিনেমাপাড়ায়। এ বার পাবলিসিটি সংস্থায় শিক্ষানবিশের কাজ। এখানেই ঘটে ‘অঘটন’। শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের ‘পথিক’ ছবির ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপনের খসড়া প্রায় অলৌকিক ভাবেই চোখে পড়ে পরিচালক দেবকীকুমারের। ধীরে, খুব ধীরে যবনিকা উঠতে থাকে জীবনপুরের পথিকের নিজের জীবনে।
সিনেমার সেই বিজ্ঞাপন সংস্থা তথা পাবলিসিটির দফতরেই একদিন আসেন কানন দেবী। এক সংসারের গল্পে প্রবেশ করে লিখন। এক আত্মভোলা মানুষ হরিদাস ভট্টাচার্য আর কাননদেবী। তখন কাননদেবীর খ্যাতি গোটা উপমহাদেশের অলিতে-গলিতে। কিন্তু তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই দেখা যায় স্বপ্নসুন্দরীর অন্য রূপ। তরুণ মজুমদার কাননদেবীর বর্ণনা সেরেছেন একটি মাত্র শব্দে— ‘থিরবিজুরি’। এ হেন স্থির বিদ্যুন্মালা যে বাড়িতে একান্ত ঘরোয়া এক স্নেহময়ী মানুষ, তা কে জানত! হেঁশেল থেকে প্রযোজনা— সব একা হাতেই সামলাচ্ছেন তিনি। কাননদেবীর প্রযোজনা সংস্থায় শিক্ষানবিশ হয়ে ঢোকেন তরুণ। সেখানেই আলাপ দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই আলাপ থেকেই সূত্রপাত ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর। পরিচালনার জগতে পদার্পণ ঘটে তরুণ মজুমদারের।
তবে এতটা সরলরৈখিক ছিল না ‘যাত্রিক’ থেকে একক ভাবে তরুণ মজুমদার নামে যাত্রা। প্রথম থেকেই নিবিড় ভাবে স্মৃতিরেখা ছুঁতে চেয়েছেন লেখক। দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরার পিছন থেকে সামনে এসে নায়ক হয়ে ওঠার কাহিনি যেমন রোমাঞ্চকর, তার চেয়ে একটুও কম নয় তাঁর নিজের পরিচালক হিসেবে একক আত্মপ্রকাশের গল্প। আজকের ‘আমি’-সর্বস্ব বিনোদন জগতের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনাও করা শক্ত, এই লিখনে কী অপরিসীম যত্নে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন তরুণ মজুমদার নামের কিংবদন্তি!
এই বই কখনও তুলে ধরেছে টালিগঞ্জ নামের তদানীন্তন স্বপনপুরীর অন্দরমহলের গ্রাফিত্তি, আবার কখনও পটভূমিকা বদলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বম্বে (অধুনা মুম্বই)। কুশীলব হিসেবে কখনও দেখা দিয়েছেন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, নৃপতি, তো কখনও এসেছেন ভি শান্তারাম, গুলজার বা রাজ কপূর। এই যাত্রাপথের টুকরো টুকরো স্মৃতি জোড়া লাগতে লাগতে কখন যে এক বিরাট কাল আর সময়কে ছেয়ে ফেলে, পাঠক টেরই পান না।
কে জানত, উত্তম কুমার কথায় কথা ‘হরিবোল’ বলে উঠতেন!তা-ও আবার এক বিশেষ সুরে। সুচিত্রা সেনের পর্দার রূপ আর অন্তরাল, এটুকুই জানা সাধারণ বাঙালির। কিন্তু মহানায়িকার ব্যক্তিসত্তার পরতে পরতে যে মিশে থাকত কৌতুক আর মমত্বের বিরল রসায়ন, তা কি জানা যেত ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ হাঁটার সুযোগ না পেলে?
স্মৃতির খুঁটিনাটি যেন ফিরে এসেছে এই বইতে। কেউ ললিত, তো কেউ বিভাস রাগের ছোয়াঁ নিয়ে। খোলা আড্ডার সুরে-স্বরে তরুণ মজুমদার জানিয়েছেন ‘পথের পাঁচালী’ দেখে বিমূঢ় হয়ে যাওয়ার স্মৃতি। তার পরেই সে বন্ধুর দল যে মহানগরের বুকে ‘পথের পাঁচালী দেখুন’ মর্মে ব্যানার বানিয়ে মিছিল করেছিল, তা কি আজকের এই ‘মুঠোবাক্সে বন্দি’ ছোট হয়ে যাওয়া পৃথিবীর নাগরিকরা ভাবতে পারবেন?
যাকে ‘ট্রিভিয়া’ বলে মনে হয়েছে, সেই আপাত সাধারণ তুচ্ছতাই হিরেমানিক হয়ে জ্বলে উঠেছে এই লেখায়। একের পর এক ঘটনা।যেন এক অনিঃশেষ চিত্রনাট্য। সেই চিত্রনাট্যের কোনও বাঁধাধরা অবয়ব নেই। কুশীলব বার বার বদলে গেলেও তার স্বর এক নৈর্বক্তিকতায় নিষিক্ত। অনেকটা তাঁরই ছবির ‘আংটি চাটুজ্যের ভাই’-এর মতো। সিনেমাপাড়া যেন নাচনি-ঝুমুরের অনাধুনিক আসর, আজ এখানে তো কাল ওখানে ফেলতে হবে তাঁবু। কয়েক দিনের আস্তানায় জমে ওঠা বন্ধুত্ব গড়িয়ে যায় আত্মীয়তায়। শ্যুটিং লোকেশনে বৈরী গ্রামবাসীও বাড়িয়ে দেন বন্ধুত্বের হাত। উত্তম কুমার শীতের সকালে ইঁদারার হিম জল বালতি বালতি ঢেলে স্নান করিয়ে দেন ইউনিটের সকলকে। এক জনের পালা শেষ হলে হাঁক দেন— ‘নেক্সট...’!
এই ‘নেক্সট’-এর টানেই উলটে যেতে থাকে পাতা। এই উঁকি দেন সাদামাটা অনুপ কুমার তো কয়েক অধ্যায় পরেই আবছা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন অধুনা বিস্মৃত চাঁদ ওসমানি। স্কুলবালিকা মৌসুমিকে যে পাঁজাকোলা করে তুলে আনতে হয়েছিল ‘বালিকা বধূ’তে অভিনয় করানোর জন্য আর তাঁর দামালপনায় শ্যুটিং যে লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছিল, সে কাহিনি কি স্বয়ং অভিনেত্রীর মনে আছে? তরুণ মজুমদারের এই স্মৃতিযাত্রায় টলিউডি কিংবন্তির আড়ালে ঢেকে রাখা একাকিত্ব, বিষণ্ণতা আর ছায়াময়তা যেমন স্পষ্ট, তেমনই উদ্ভাসিত বলিউডের ‘হয়ে ওঠা’-র এক বিশেষ পর্বের আনন্দ-বেদনার ইতিহাসও।
শচীন দেববর্মন সাত সকালে হাফ প্যান্ট পরে জগিং করছেন বা তরুণ রাহুলের বিরুদ্ধে ‘মিশবা না’ বলে সাবধানবাণী আওড়াচ্ছেন, এমন কৌতুক যেখানে রয়েছে, সেখানেই রয়েছে পাহাড়ি সান্যাল নামে এক উদাসী গায়কের কাহন। এ যেন এক সুবিশাল সারকারামায় দেখা অনিঃশেষ ভুবন। লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-অ্যাকশনের দুনিয়ার পিছনে সেট তৈরি থেকে শুরু করে শ্যুটিংয়ের জন্য চিল জোগাড়ের কাহিনি বিছিয়ে রয়েছে পটচিত্রের গানের আঙ্গিকে। সিনেমা আর বায়োস্কোপের মধ্যেকার ফারাকটিকেই যেন মুছে দেয় এই লিখন।
রাজেন তরফদার যে মায়ায় পড়ে অবিশ্বাস্য দৈর্ঘ্যের ‘গঙ্গা’-কে সীমায় বাঁধতে পারছিলেন না, ঋত্বিককুমার ঘটক নামক মানুষটি যে ব্যক্তিগত জীবনেও ধূমকেতুপ্রতিমই ছিলেন, সেই সব কাহিনির আড়াল-আবডাল, অলিগলি-রাজপথের কাহিনি যেমন ধরে রেখেছেন লেখক, তেমনই বিস্তারিত ভাবে লিখে রেখেছেন সেই সময়ের সিনে-প্রযুক্তির খুঁটিনাটি। এ বই তাই সিনেমা তুলতে আসা নবীনের কাছে পথপ্রদর্শকের ভূমিকাও নিতে পারে।
কাননদেবী থেকে মৌসুমি, বিমল রায় থেকে শক্তি সামন্ত, অশোক কুমার থেকে রাজেশ খন্না— কোনও সরলরেখা বরাবর হাঁটেনি সময়। যে কোনও চোরাগলির বাঁকে হারিয়ে গিয়েছে অবিরত চেনামুখের দল। আবার কোনও চৌমাথায় ঝলক দিয়ে উঠেছে প্রায় বিস্মৃত হওয়া মুখের সারি। ‘সংসার সীমান্তে’ ছবির জন্য যে নির্মাণ করতে হয়েছিলএক আস্ত যৌনপল্লি, তা আজকের এই ‘ফিল্ম সিটি’-র যুগে দাঁড়িয়ে কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু তা সত্যিই ঘটেছিল।
সে দিক থেকে দেখলে তরুণ মজুমদার বা তাঁর সহযাত্রীরা ভারতীয় সিনেমার অনেক বিষয়েরই অগ্রপথিক। কিন্তু এই আখ্যানকাব্যেকোথাও সেই দাবিটুকু পর্যন্ত নেই। তাঁর সময় থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আজ বোঝা যায়, ভারতীয় সিনেমার এক যুগসন্ধিকে নির্মাণ করছিলেন তরুণ মজমদার, তপন সিংহ, রাজেন তরফদাররা। অনেক পরে যাকে ‘সমান্তরাল ছবি’ আখ্যা দেবেন তাত্ত্বিকেরা। কিন্তু তাঁরা সে সব ভাবেননি। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে বেরিয়ে জীবিকার অনিশ্চয়তা আর মাঠে-ঘাটে জলে–জঙ্গলে পড়ে থেকে ছবি নির্মাণের যে অদম্য জেদ, তা কে কী ভাবে দেখবে এই ডিজিটাল প্রজন্ম? বরেণ্য চিত্র নির্মাতা জাঁ লুক গোদারও স্বাগত জানিয়েছেন মুঠোফোনে তোলা ছবিকে। কিন্তু মুঠোফোনই হোক বা আড়াই মণ ওজনের ক্যামেরা আর ট্রলির কারিকুরি, ছবিকে শেষ পর্যন্ত ছবি হয়েই উঠতে হয়, সেই কথাটি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে কায়ফি আজমি এই সুবিশাল আখ্যানের পিছনে যেন ধরে রয়েছেন সুরের বাঁধন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা মুকুল দত্ত, গীতা দত্ত অথবা লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সেই সুরের মায়ায় জড়িয়ে পড়েন পাঠকও। সিনেমার পর্দার চৌখোপ ছাপিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘের মাচায় দাঁড়িয়ে গাওয়া সলিল চৌধুরী অথবা বাংলা থিয়েটারের পালাবদলের কিংবদন্তি উৎপল দত্ত এই গীতিকাব্যের আর এক পিঠ। সেই বর্ণিল আখ্যানের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে রঞ্জন দত্তের আঁকা ছবি। ফোটোগ্রাফ দিয়েই তৈরি হতে পারত এই বই। কিন্তু তেমনটি না করে চিত্রণের আশ্রয় যেন মনে করিয়ে দিল ছায়াছবির পুরনো বিজ্ঞাপনকে। যেখানে রং-তুলিতেই প্রাণ পেতেন উত্তম-সুচিত্রা-ছবি বিশ্বাস-পাহাড়ি সান্যাল।
(সঙ্গের ছবিগুলি গ্রন্থ থেকে গৃহীত। শিল্পী: রঞ্জন দত্ত)
সিনেমাপাড়া দিয়ে (দুই খণ্ড)/ তরুণ মজুমদার/ দে’জ পাবলিশিং/ ৯৯৯ টাকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy