শ্রীজাত-র ১৭৬ পাতার উপন্যাস বৃক্ষ অনুবাদক (আনন্দ)। কবির গদ্য সব সময় অন্য স্বাদ নিয়ে আসে। এক অন্য পৃথিবীর সন্ধান এই বইয়ের পাতায় পাতায়। বিশেষত সংলাপ অংশগুলো যেন প্রতিদিনকার ভাষা হয়ে চোখের সামনে ফুটে ওঠে এবং কানে বাজতে থাকে। যে হেতু কবি-ঔপন্যাসিক নিজে এক জন সঙ্গীতের অংশভাক্ তাই তিনি ভলতেয়ারকে দিয়ে এ রচনা শুরু করেছেন। যেখানে সেই বিখ্যাত দার্শনিকের একটাই প্রশ্ন— ‘কবিতার অনুবাদ অসম্ভব। তা হলে সঙ্গীতের কী হবে!’ এই উপন্যাসের ‘উইলিয়ম’ নিশ্চয়ই শ্রীজাত-রই পরম বান্ধব। ৪৭ এবং ৬৫ পাতায় যে অত্যাশ্চর্য এক লাইনের শূন্যতার পর এক লাইনের বর্ণনা— সে এক আশ্চর্য দ্যুতি। ‘আর সেই সমস্ত কিছুর পিছনে, গম্ভীর হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি নীল পর্বত।’ এ যেন, এ বর্ণনা যেন বহু বহু বছরের পরে ‘রিখ্টার্সভেল্ড’ পর্বতমালার কথা মনে করিয়ে দেয়।
অথ লীলাবতী কথা (সিগনেট প্রেস) সুধীর দত্ত-র ৪৮ পাতার কবিতার বই। এই কাব্যগ্রন্থের ৩৭ নম্বর পাতার ‘এক গুচ্ছ নির্ভেজাল গপ্পো’ কবিতায় কবি লিখছেন— ‘গুলতাপ্পি অনেক হল। নিতাইবিনোদ/ ভীত, পাছে/ দত্তবাবুর ভূত ভর করে।/ ডর হয়/ ভূত নয়, লোকে বলে ব্রহ্মদত্যি দু’পায়ের ফাঁকে/ যে যায় সে মেষ হয়; ভর সন্ধেবেলা’— কবিতার উচ্চারণ বা রচনা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। কেননা সুধীরবাবু এ কাব্যগ্রন্থের আগেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু অতটা লাইন তুলে দিয়ে লেখার কারণ— ‘সেমিকোলন’। যার ব্যবহার মুছে যেতে চলেছে বাংলা ভাষায়। ১৬ পাতায় ‘অত্যাগসহন’—শব্দ-বাক্যর পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
৪৮ পাতার কাব্যগ্রন্থ যশোধরা রায়চৌধুরীর জ্বরপরবর্তী (সিগনেট প্রেস)। ভারী চমৎকার এক বিভাব কবিতা দিয়ে কাব্যগ্রন্থের যাত্রা শুরু। শেষে এসে তিনি যখন লেখেন— ‘লেখার পদ্ধতি ভাল, লেখা অবিমিশ্র তবু গড়বড় সমেত ঝুটা সচ/ তোমাকে আপ্লুত করবে, তোমাকে বাগিয়ে ধরবে/ তোমাকে করবে তছনছ।’ তখনই তাঁর রচনার সিদ্ধি নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। যদিও এর আগেই ১৪ নম্বর পাতায় ‘শরদিন্দু অমনিবাস’-এর ‘১’ নম্বর কবিতায় তিনি লিখেছেন অত্যাশ্চর্য লাইন— ‘মনোজগতের বাতায়ন খোল, চারুবাক!/ ভাষা অঙ্গের কত ছল তুমি দেখেছ।/ কাহিনিবয়নশিল্পের রূপদক্ষের/ সূচীমুখ কারুকাজগুলি করে রেখেছ।’ এ কাব্যভাষার সঙ্গে শরদিন্দু তো বটেই, কোথাও যেন ব্যোমকেশেরও একটা রৌদ্রে মাখা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।
‘গানেরও অধিক ছিল সেই দমকা হাওয়া/ অসম্ভব তাকে ভুলে যাওয়া’— এমনই সূচনা দিয়ে তৈরি হয়েছে জয় গোস্বামীর মরীচিকা কাব্যগ্রন্থ (সিগনেট প্রেস)। মোট ৭০ পৃষ্ঠা। ‘মাত্র তিন মাসের মধ্যেই আমার জীবনে একটি পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল।’ মুখবন্ধে এমনই জানিয়েছেন জয়। ‘আমার সংহিতা পুরস্কার’ আর ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে...’— এই দু’ভাগে ভাগ করা এ কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থ না কি হাহাকার! একদম শুরুতেই জয় লিখেছেন— ‘কুত্তা খেদানোর মতো বার করে দিলে/ বাড়ির চৌহদ্দি থেকে। বাড়ি মানে তোমার জীবন।’ এ কবিতা পাঠের সময় বহু কাল আগেই তাঁরই একটি বাক্য মনে পড়ে— ‘মারহাব্বা কাটা ঘায়ে শোভানাল্লা ছিটে ছিটে নুন।’
আকাশ যুদ্ধের জন্য এক চিলতে আকাশ সুপর্ণা পাল বণিকের কাব্যগ্রন্থ (পাঠক)। এ বইয়ের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠা ওল্টাতেই চোখে পড়বে ‘উত্তর ভারতের নদী’ কবিতাটি। ‘চোখের সামনে/ ভরা নদী শুকিয়ে গেলে কেমন যেন করে ভয়’। পুরো কবিতাটাই তুলে দেওয়ার লোভ হয়। ‘আজকাল যা যুগ পড়েছে/ একটা কথা রটিয়ে দিলেই হলো/ মুহূর্তে ছড়িয়ে যাবে মোবাইল থেকে মোবাইলে/ সত্যতা বিচার করবে না কেউ।’ এই সময়ের জলজ্যান্ত সামাজিক ছবি তুলে এনেছেন কবি তাঁর ‘রুগি ও বিশেষজ্ঞ’ কবিতায়। ‘অতর্কিতে’ কবিতার শুরুতেই কবি বলছেন— ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কারণগুলি এখানে বর্তমান/ সুতরাং করতেই হবে যুদ্ধ।’ কবির সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা অত্যন্ত পরিষ্কার।
অমর মিত্রের পিতৃপুরুষের বাস ছিল পূর্ববঙ্গে। তাঁর পিতৃদেব কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন গোটা ময়মনসিংহ জেলার গ্রামে গ্রামে, বাবার কাছেই সেখানকার ঋণগ্রস্ত কৃষকদের কথা প্রথম শোনেন অমর, আর মা-র কাছে শুনেছিলেন ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের কথা। ‘‘ঋণগ্রস্ত কৃষকের কথা খুঁজতে গিয়ে দেখি গীতিকার কাহিনির বাইরে ময়মনসিংহে রয়েছে কৃষক বিদ্রোহ, হাতিখেদা বিদ্রোহ, জমির টঙ্ক প্রথার বিরোধী আন্দোলন, যা আসলে নেত্রকোণা, সোমেশ্বরী নদী, সুসঙ্গ দুর্গাপুর ঘিরে ঘটেছিল। গারো পাহাড়ের দেশ হলো মহাকাব্যের মতো ব্যাপ্ত জীবনের এক দেশ।’’ লিখেছেন অমর মিত্র তাঁর নতুন উপন্যাস মোমেনশাহী উপাখ্যান-এর (দে’জ) গোড়ার কথা-য়। উপন্যাসটিতে ময়মনসিংহ গীতিকার বাইরে যে জীবন মহিমময় করেছে ওই ভূখণ্ডকে, তার কথাই লিখতে চেয়েছেন ঔপন্যাসিক।
জমিদারি প্রথা ঘুচে গিয়েছে, কিন্তু বাঙালির মানসজগতে জমিদারের আধিপত্য কমেনি। কলকাতার এক মস্ত জমিদার পরিবারকে নিয়ে দীপান্বিতার উপন্যাস ভোরাই (ধানসিড়ি)। প্রধান চরিত্র শঙ্কর ব্যবসায়ী, আবার বিপ্লবীদের গোপনে মদত জোগান। প্রতি মাসে অর্থ সাহায্য করেন বাঘা যতীনকে। কাহিনির অনেকটাই জুড়ে থাকে আর এক রাজনীতি— বৃহৎ যৌথ পরিবারে ক্ষুদ্র স্বার্থের রেষারেষি, যার প্রধান শিকার মহিলারা। অতুল বৈভবের মধ্যে বিধবা বধূ-কন্যাদের দীনহীন জীবনের চিত্রটি মর্মস্পর্শী। কাহিনির বিস্তার দুই-তিনটি প্রজন্ম ধরে। নিঃস্ব, প্রতারিত শঙ্করের পুত্রেরা অন্য রাজনীতি করে। স্থান দেয় উদ্বাস্তুদের, খেটে-খাওয়া মানুষদের নেতা হয়ে ওঠে তারা, সম্পদ গেলেও হৃত সম্মান ফিরে আসে পরিবারে। কঠিন জীবনসংগ্রাম এসে দাঁড়ায় নতুন ভোরের প্রত্যয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy