র্যাভেনশ’ কলেজ/ ওড়িশাজ় টেম্পল অব লার্নিং, ১৮৬৮-২০০৬
নিবেদিতা মহান্তি
৪৯৯.০০
প্রফুল্ল, জগৎসিংপুর, ওড়িশা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস লেখার কাজ এ দেশে পেশাদার ইতিহাসবিদদের হাতে আজও জনপ্রিয় নয়। সেই ১৯১৮-তে পেয়েছি ‘দ্য স্টোরি অব সিরামপুর অ্যান্ড ইট্স কলেজ’, তার পর ১৯৭২-এ প্রয়াত ইতিহাসবিদ রমাকান্ত চক্রবর্তী লিখলেন ‘আ শর্ট স্টোরি অব বিদ্যাসাগর কলেজ’, ১৭১ পৃষ্ঠা জুড়ে। তবে নিবেদিতা মহান্তির কাজটি একেবারেই নতুন ধরনের। পশ্চিমি জ্ঞানবৃক্ষের ফলের প্রথম ভক্ষক বাঙালি তখন প্রশাসনিক চাকরির সূত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল ওড়িশার সর্বত্র। ইংরেজি না জানার কারণে প্রশাসনে ওড়িয়ারা কোনও বিশেষ পদই পেতেন না। এমতাবস্থায় ওড়িয়াদের মধ্যে একটা অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হচ্ছিল। প্রয়োজন হচ্ছিল ওড়িশার বিশেষ বিশেষ পরম্পরা, অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করার। ইতিমধ্যে ১৮৬৩-তে পটনা কলেজ স্থাপিত হতেই ওড়িশাবাসীদের কলেজ স্থাপনের দাবি আরও জোরালো হয়।
ঠিক এই সময়েই ওড়িশা বিভাগের কমিশনার হয়ে এলেন টি ই র্যাভেনশ। ১৮৬৬-র দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ব্যর্থ হলেও র্যাভেনশ’-র উদ্যোগেই কিন্তু কটক স্কুলে এফএ স্তরের কলেজ চালু হল ১৮৬৮-তে। ১৮৭৬-এ স্নাতক স্তরে রূপান্তরিত হয় কলেজ। দিন যত এগিয়েছে র্যাভেনশ’ কলেজ ততই যেন আধুনিক ওড়িশার আত্মাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এর গল্প শুধু বিচ্ছিন্ন ভাবে সমাজের একাংশের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের নয়, বরং সমগ্র ওড়িশাবাসীর মন জয় করে নেওয়ার, স্বপ্ন পূরণের। সেটাই বইতে বার বার ফুটে উঠেছে। র্যাভেনশ’ কলেজের ছাত্ররাই হয়ে দাঁড়ান উত্তরকালের ওড়িয়া সমাজের স্তম্ভস্বরূপ। তাঁরাই নতুন ওড়িশার নির্মাতা। এই ছাত্ররাই সাম্যবাদের প্রভাবে গড়জাতের রাজাদের শোষণের প্রতিবাদ করেছেন, দেশের দুর্ভিক্ষে ত্রাণ বিলিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। আবার প্রকাশ করেছেন কলেজ পত্রিকা ‘র্যাভেনশভিয়ান’, ছাত্রাবাস পত্রিকা ‘জাগরণ’, ‘ঊর্মি’, আর সেখানে প্রকাশিত লেখাপত্তরে, আর তর্কবিতর্কে সমৃদ্ধ হয়েছে সমকালের ওড়িয়া সমাজ, রাজনীতি। মনে রাখতে হবে এমন একটা সময়ে তাঁরা লিখেছেন যখন বিদেশি শাসক আর ভিন্রাজ্য থেকে আসা তার দেশীয় সহযোগীদের সামনে ওড়িশা তার নিজস্ব সত্তা খুঁজছিল। যে কারণে লেখিকা বলছেন তাঁর ওড়িয়া জাতীয়তাবাদ বিষয়ক গবেষণার মালমশলার ভিতরেই তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতটা দেখতে পেয়েছিলেন।
এই সঙ্গে বইতে উঠে এসেছে কলেজের প্রতিষ্ঠায় ময়ূরভঞ্জের মতো গড়জাতের রাজাদের আর্থিক সহায়তা, কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা, চাউলিয়াগঞ্জে কলেজের স্থানান্তর-সহ আরও অনেক তথ্য ও তার বিশ্লেষণ। সঙ্গে রয়েছে ২০০৬-এ কলেজটির বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়া পর্যন্ত সময়ের খুঁটিনাটি নানান তথ্য।
শিক্ষকের পাশাপাশি বহু কৃতী ছাত্রের নামও দিয়েছেন নিবেদিতা। যাঁদের অনেকে বাংলাভাষী। ইংলিশ চ্যানেল পেরোনো মিহির সেন যে এই কলেজেরই ছাত্র তা তো অনেকেই জানেন না। তাঁর সে অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য চ্যালেঞ্জ অব দ্য চ্যানেল’ নামে ‘র্যাভেনশভিয়ান’ পত্রিকায়। আর এই পত্রিকাতেই লিখতেন অন্নদাশঙ্কর রায়। ‘জীবন যৌবন’-এ গর্ব ভরে সে কথা লিখেওছেন তিনি। এ অর্থে প্রতিবেশী রাজ্যের গৌরবময় কলেজ তো অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের সম্পদ, তার ইতিহাস তো বাংলার বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাসেরই অংশ।
এই বই নিবেদিতা মহান্তির বহু পরিশ্রমের ফল। তথ্য সংগ্রহে বাদ পড়েনি মদন বা বাঞ্ছার ক্যান্টিন, কুঞ্জর পান দোকান বা সাইকেল স্ট্যান্ড-এর পুরনো প্রহরীর স্মৃতিচারণও। এঁদের সকলের স্মৃতিতেই তো একটি প্রতিষ্ঠানের হারিয়ে যাওয়া সময়টা উঠে আসে।
শিবরতন মিত্র, গৌরীহর মিত্র
পার্থ শঙ্খ মজুমদার
৬০.০০
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ
১৯৬৭-তে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’-র অখণ্ড সংস্করণে কতকটা যন্ত্রণাভরেই বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন ‘‘এক সময় শিবরতন ও গৌরীহর মিত্র বীরভূম জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। নিজের জেলার ইতিহাস রচনার জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁরা করেছিলেন, তার কোনও যোগ্য পুরস্কার দেশবাসীর কাছ থেকে পাননি।’’ শিবরতন ১৯৩৮-এ, আর পুত্র গৌরীহর প্রয়াত হন ১৯৪৭-এ। আর ২০১৯-এ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাদের মহার্ঘ ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় অন্তর্ভুক্ত করল বীরভূমের ইতিহাসের দুই নিষ্ঠাবান গবেষকের জীবনী। বাঙালি সাহিত্যিকদের চরিতাভিধান রচনায় শিবরতনই পথিকৃৎ। ১৬ খণ্ডে তিনি লিখেছিলেন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সেবক।’ শিবরতনের সাহিত্য জীবন বর্ণময়— শিশুসাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, পাঠ্যপুস্তক থেকে পুঁথিকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা এবং অবশ্যই ইতিহাস লেখা। লেখক পার্থ শঙ্খ বলছেন তাঁর আগে বিভিন্ন পত্রিকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বীরভূম সংক্রান্ত কিছু নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও বীরভূমের ইতিহাস রচনার ‘তন্নিষ্ঠ প্রয়াস’ কেউ করেননি। মাসিকপত্র ‘বীরভূমি’-তেই উনিশ শতকের শেষ থেকে শিবরতন বীরভূমের প্রাচীন ইতিহাস, সীমানা— এই সব বিষয়ক লেখার সূচনা। পরে বীরভূমের প্রাচীন পুঁথি, প্রবাদ, জমিদার— এ সব নিয়েও তিনি প্রবন্ধ রচনা করেন।
তবে সারা জীবন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে যে পুঁথি আর বই সংগ্রহের কাজটি তিনি করেন, তা দিয়েই তৈরি করেন রতন লাইব্রেরি। আত্মজীবনীতে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখছেন কিছু পয়সা জোগাড় হলেই সিউড়ি যেতেন। ‘কাজ ছিল শিবরতন মিত্রের রতন লাইব্রেরিতে দুই বেলা পুস্তক পাঠ’। কুলদাপ্রসাদ মল্লিকের সহযোগিতায় শিবরতন স্থাপন করেন ‘বীরভূম সাহিত্য পরিষৎ’। বইটির ২৫ পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত তাঁর শতাধিক রচনার তালিকা।
পুত্র গৌরীহর অবশ্য অত লেখেননি। আর তাঁর বিষয়বস্তু একেবারেই বীরভূম কেন্দ্রিক— কেঁদুলি, বক্রেশ্বর, বীরভূমের কবিয়াল— এই ধরনের। তবে দুই খণ্ডে লিখেছিলেন ‘বীরভূমের ইতিহাস’। রেখে যান তৃতীয় খণ্ডের জন্য তৈরি কিছু লেখাও, যা পরে ছাপা হয়। পার্থ শঙ্খ লিখেছেন ‘বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব গৌরীহর মিত্র।’ এই ইতিহাস রচনাকালে যে কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল সে বিষয়ে গৌরীহরের অনুভূতির সঙ্গে (‘‘কত অকর্ষিত গহন অন্ধকার পথে পরিভ্রমণ করিয়া সংযোজক পন্থা নির্দ্দেশ করিতে হইয়াছে...’’) কোথায় যেন সতীশচন্দ্র মিত্রের একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
শিবরতন বা গৌরীহরের মতো মানুষেরা শ্বেতাঙ্গ শাসকের সামনে নিজের সমৃদ্ধ অতীত তুলে ধরে এক রকম দেশসেবাই করে যান। এই ‘খণ্ড’ ‘খণ্ড’ ইতিহাসেই তো জাতীয় ইতিহাসের নির্মাণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy