‘‘এবার যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথের চোখের উপর থেকে মায়ার আবরণ সরে গেল, আর তাঁর চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক অপরূপ চিন্ময় জগৎ। তাঁর যে সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাপখোলা তলোয়ারের মতো সদাই উদ্যত হয়ে থাকত, সকলের সব রকম যুক্তিকে নিজের কূটতর্ক দিয়ে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার জন্য, আজ তা সম্পূর্ণরূপে পরাভব স্বীকার করলে এক দুর্জ্ঞেয় ভাবের কাছে। এই রকম করে উদ্ধত, গর্বিত বিদ্যাভিমানী নরেন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে নতি স্বীকার করলেন অশিক্ষিত, নিরীহ প্রকৃতি ঠাকুরের কাছে।’’ লিখেছেন যামিনীকান্ত সোম (১৮৮২-১৯৬৪)। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনীর কোনও অভাব নেই, কিন্তু তিনি নিজে যেমন সহজ ভাষায় অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে অনেক গভীর জীবনবোধের কথা বলতেন, যামিনীকান্তও সেই পথেই হেঁটেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘একজন অজ পাড়াগাঁয়ের লোক কী করে জগৎ-পূজ্য রামকৃষ্ণ পরমহংস হলেন, সে এক বিস্ময়কর কাহিনী।’’ সেই কাহিনিই তিনি এই বইয়ে অনায়াস-দক্ষতায় সাজিয়ে দিয়েছেন। এই বই একাধারে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী ও কথামৃত। ধারাবাহিক ঘটনাক্রমের স্বচ্ছন্দ বিন্যাসে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকথা যেমন স্পষ্ট ফুটে ওঠে, তেমনই মনে গেঁথে যায় সেই জীবন দিয়ে তিনি কী শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যামিনীকান্ত লিখছেন, ‘‘একজন একবার জিনিস কিনতে গিয়ে ঠকে এসেছিলেন, ঠাকুর তাঁকে বকলেন, বললেন, ‘সে কিরে, তোকে সাধু হোতে বলেছি, বোকা হতে তো বলিনি!’’
‘‘এ দূরাশা আমার কোন দিন নেই যে, দেশ একেবারে এক লাফে পুরো স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই স্বরাজের একটা সত্যকার ভিত্তি স্থাপন করতে।’’ স্টিমারে বরিশাল যাওয়ার পথে ডেকে বসে কথাগুলি বলেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র, যিনি রাজনীতিতেও প্রবল আগ্রহী ছিলেন, সেই রাতে সঙ্গী ছিলেন দেশবন্ধু-র। তাঁর প্রয়াণের পর শরৎচন্দ্রের সে ‘স্মৃতিকথা’ প্রকাশিত হয় ‘ভারতবর্ষ’, ১৩৩২-এ— গুরুত্বপূর্ণ রচনাটি ঠাঁই পেয়েছে এই সঙ্কলনে। আছে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, স্বর্ণকুমারী দেবী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন রচিত প্রয়াণলেখও। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার সাময়িকপত্র থেকে চয়ন-করা এ-সঙ্কলনের যাবতীয় রচনা প্রয়াণের অব্যবহিতে লেখা, আর প্রয়াত ব্যক্তি ও প্রয়াণলেখ রচয়িতারা প্রত্যেকেই খ্যাতিমান। প্রতিটি রচনার শেষে ব্যক্তি-পরিচিতি, রচনাসূত্র, সময়কাল ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি লেখায় উঠে এসেছে সমকালীন দৃষ্টিকোণ, তৎকালীন বঙ্গদেশ ও বাঙালি জীবন, চেনা মানুষের ব্যক্তিজীবনেরও অজানিত নানা উপকরণ। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, উপেন্দ্রকিশোর, সজনীকান্ত প্রমুখ যেমন প্রয়াতদের মধ্যে আছেন, তেমনই আবার রবীন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলাল আছেন প্রয়াত ও প্রয়াণলেখক— দু’তরফেই। বাঙালির ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ের সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতির পাঠও এতে ধরা রইল। সম্পাদকের মন্তব্য: ‘‘প্রয়াণ-লেখ রচনায় ব্রাহ্মদের অবদান সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য... কেবল শোক-সন্তপ্ত চিত্তের স্মৃতিচারণাই নয়, প্রয়াত ব্যক্তির জীবন ও কর্ম-আলেখ্যও তাতে সমমর্যাদায় ধরা থাকতো।’’
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলার একটি মহকুমা রূপে জলপাইগুড়ির আত্মপ্রকাশ। যদিও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিতে জলপাইগুড়ি নামটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ১৭৭৩-এ। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি জলপাইগুড়ি জেলা গঠিত হয় পশ্চিম ডুয়ার্স ও বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটকে মিলিয়ে। অর্থাৎ পৃথক জেলা হিসাবে তার বয়স হল দেড়শো বছর। ২০১৪ সালে এ জেলার আলিপুরদুয়ার মহকুমা আলাদা জেলার মর্যাদা পেয়েছে। এ পার ও পার দুই বাংলার বিভিন্ন জেলার ইতিহাস রচনার উদ্যোগ উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই দেখা গেলেও জলপাইগুড়ির সে সৌভাগ্য হয়নি। উমেশ শর্মার মতে, জেলার ভৌগোলিক রূপরেখার বার বার পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। বিতর্ক রয়েছে নামকরণ নিয়েও। জলপাই গাছের গুঁড়ি থেকেই এই নাম, নাকি এটি জল্পেশ মহাদেবের নামের সঙ্গে জড়িত? লেখকের মতে, ‘রাজমালা’ সূত্রে জানা যায়, জলপায়ি বা জলপলিয়া গোষ্ঠীর বসবাস ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। জলপাইগুড়ি অঞ্চলেও তাঁদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। এই জনগোষ্ঠীর বাসস্থান হিসাবে ‘জলপাইগুড়ি’ নাম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। লেখক প্রাচীন ইতিহাসের সূত্র ধরে এগিয়ে কামতাপুর হয়ে বৈকুণ্ঠপুরের রায়কত পরিবারের ইতিহাসে আধুনিক জলপাইগুড়ির স্থান নির্ণয় করেছেন। সমাজ সংস্কৃতি শিক্ষা শিল্প স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনও প্রসঙ্গই বাদ দেননি তিনি। আছে জেলার কিছু পর্যটন ক্ষেত্রের বিস্তারিত বিবরণ। শেষে সংযোজিত হয়েছে বেশ কিছু দুর্লভ ও মূল্যবান নথিপত্র, সঙ্গে আছে অনেক ছবি। সব মিলিয়ে জেলার সামগ্রিক ইতিহাস প্রণয়নে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy