Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

যে দুনিয়ার অস্তিত্ব থাকার কথা নয়

এ কেবল সমকামী যৌনতার গল্প নয়। এ হল সমলিঙ্গের প্রেমের কাহিনি। পাগলের মতো প্রেম, যা নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্য জনকে সম্পূর্ণ অধিকার করতে চায়।

স্বাতী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর জাতে সাহিত্যিক। ঘেঁটি ধরে নিয়ে যান এমন সব জায়গায়, যেখানে অধিকাংশ পাঠকের নিজে যাওয়ার মুরোদ নেই। এ বইটা শুরুই হচ্ছে দুই পুরুষের উন্মত্ত যৌনখেলার বিবরণ দিয়ে। আর্তি, ফাজলামি, সুখযন্ত্রণা, অবসাদ এবং শেষমেশ আত্ম-অবমাননার মধ্যে তৃপ্তি সন্ধানের গ্লানি, মাত্র তিন পাতার মধ্যে অনুভূতির এই রোলার-কোস্টার। ততক্ষণে পাঠক জুগুপ্সা, দৃষ্টি-কামুকতা পার করে সিরিয়াস কৌতূহলে উপনীত। তাঁর চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে কলেজ হস্টেলে তরুণদের এক বিষাদপূর্ণ উত্তেজনার জগৎ, যা তারা বাবা-মায়ের কাছে, বান্ধবী বা স্ত্রীর কাছে কখনও মেলে ধরতে পারে না। এ দেশের অধিকাংশের মতে যে দুনিয়া নেই, কারণ তা থাকার কথা নয়।

তা বলে এ কেবল সমকামী যৌনতার গল্প নয়। এ হল সমলিঙ্গের প্রেমের কাহিনি। পাগলের মতো প্রেম, যা নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্য জনকে সম্পূর্ণ অধিকার করতে চায়। ভাষায় যার একমাত্র প্রকাশ ‘খেয়ে ফেলা’ রূপকল্পে। সেই প্রেম, যেখানে বিচ্ছেদের সাত বছর পরেও এক দিন ছেড়ে থাকার ব্যথা এত দুঃসহ হয়ে ওঠে যে সরকারি চাকুরিরত, নিজ দ্বিতলগৃহ, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নিজের দু’কব্জিতে ব্লেড চালিয়ে দেয়। এক পুরুষের প্রতি আর এক পুরুষের এমন প্রেমের কথা ভারতীয় সাহিত্যে-সিনেমায় খুব কি মিলেছে?

পরদিন ছেলে যখন নামে বাড়ির স্টেশনে, অপেক্ষারত বাবা-মা ছেলের দু’হাতে ব্যান্ডেজ দেখেন কিন্তু তা নিয়ে কিছু বলেন না। এ কি বাপ-মায়ের বলার মতো কথা? ছেলের অন্তর্জগৎ তাঁদের পরিধি নয়, কখনও হয়ে ওঠেনি। ছেলের কেরিয়ার নিখুঁত প্ল্যান করেন বাবা (সে কেমিস্ট্রি পড়বে, যত দিন না মেডিক্যালে চান্স পায়)। ছুটিতে ছেলে বাড়ি এলে গ্রামের বাড়ি, আত্মীয়দের খবর, কোন গাছটা কাটা পড়ল— এমনই কথাবার্তা হয়। তরুণ পুত্র জানে, নেতাদের প্রতারণায় পিতার রাজনৈতিক উচ্চাশা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন সান্ত্বনা বাগানের পরিচর্যা। বাবার বেদনা ভাগ করে নিতে পারে না ছেলে। জিজ্ঞাসা করতে চায়, ‘‘আমি যে তোমার মতো নই, তাতে কি তুমি হতাশ?’’ অলিখিত অনুশাসন কাঁটাতার বাঁধে, সীমান্তে জাগে সাহিত্য।

মাই ফাদার্স গার্ডেন
হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর
৪৯৯.০০, স্পিকিং টাইগার

তবে হাঁসদার আগের লেখার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় রয়েছে, তাঁরা ‘মাই ফাদার্স গার্ডেন’ বইটি হাতে নিয়ে একটু বিস্মিত হবেন। হাঁসদার প্রথম বই, সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কার প্রাপ্ত ‘দ্য মিস্টিরিয়াস এলমেন্ট অব রুপি বাস্কে’ (২০১৪) যেন সূক্ষ্ম আঁচড়ের পটচিত্র। পটের ছবি বিমূর্ত নয়, তার গাছ-পাখি-ফুল-মানুষ বরং অতিমূর্ত, অতি-বিশদে চিত্রিত। কিন্তু পরিচিত বস্তু এমন অপ্রত্যাশিত বিন্যাসে দাঁড়িয়ে থাকে যে এক রহস্যময় জগৎ তৈরি হয়। রুপি বাস্কের গ্রামের প্রতিটি নারী-পুরুষ চরিত্র, পার্শ্বচরিত্র, এমনকি পাড়ার ছেলেগুলোকে অবধি এমন তন্নিষ্ঠ ভাবে এঁকেছেন হাঁসদা, যে তাদের গেরস্থালি থেকে অন্তর্ভুবন, সব খুলে যায় পাঠকের কাছে। আবিষ্ট পাঠকও অনুভব করে, জ্যোৎস্না রাতে কিংবা অতিপ্রত্যূষের আলো-আঁধারে মানুষ হঠাৎ যা দেখে ফেলে, সেই অতি-সত্য সাদা আলোয় দেখা ঘটনার মর্ম উদ্ঘাটন করে। সেই নিপুণ কারুকাজ এই বইয়ে নেই, এখানে চরিত্র-চিত্রণ স্কেচধর্মী। যেন বিষাদবিদ্ধ মূল চরিত্রটির মতো লেখকও আত্মমগ্ন, অপরিচিতের খুঁটিনাটির প্রতি নিরুৎসুক। লেখার চলনটিও ডায়েরির ধাঁচে, সংক্ষিপ্ত বইয়ের তিনটি অধ্যায় ভাগ হয়েছে জীবনের তিনটি পর্ব দিয়ে— কলেজ-জীবনের প্রেম, কর্মক্ষেত্রে বন্ধুত্ব এবং পরিবার ও পিতা। এ সবই প্রধানত মূল চরিত্রটি দিয়ে গ্রথিত, কাহিনির নিজস্ব যুক্তিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়। অপিচ, এই বইয়ের অনেক ঘটনা লেখকের দ্বিতীয় বইটিতে (‘দ্য আদিবাসী উইল নট ডান্স’) সঙ্কলিত নানা গল্পে মেলে, মায় কিছু সংলাপ অবধি। আন্দাজ হয় যে এই বই, বা তার খসড়া, হাঁসদা তাঁর লেখকজীবনের গোড়ায় লিখেছিলেন।

হয়তো এই বই এক দিন গুরুত্ব পাবে লেখক আর তাঁর রাজনীতিকে বুঝতে। হাঁসদা শৌভেন্দ্র শেখর বয়সে তরুণ, কিন্তু ভারতের সাহিত্যে এখনই একটি নাম। বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর বইগুলি। তিনি বিতর্কিতও বটে। ‘দ্য আদিবাসী...’ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল ঝাড়খণ্ডে, সরকারি হাসপাতালের চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল চিকিৎসক হাঁসদাকে। অভিযোগ, তাঁর গল্পে সাঁওতাল মেয়েদের অবমাননা হয়েছে। ফালতু অভিযোগ, পরে তা বাতিলও হয়। তবে হাঁসদা যৌনতাকে ব্যবহার করে যে ভাবে দেহ-রাজনীতিকে জাতপাত তথা দলীয় রাজনীতির মল্লভূমিতে টেনে আনছেন, তা অনেককে বিচলিত করছে। যৌনমিলনে আধিপত্যের একটা পরিচিত নকশা আছে। পুরুষ প্রবেশ করে, নারী প্রবিষ্ট হয়, প্রবেশকারী বলবত্তর। এ কেবল চাপানো চিন্তা নয়, এর শিকড় এত গভীর যে বহু নারীবাদী মনে করেন, যৌনজীবনে সাম্যসুষমা চাইলে মেয়েদের সমকামী না হয়ে উপায় নেই। যখন দু’জনেই পুরুষ, তার এক জন বর্ণহিন্দু অন্য জন জনজাতীয়, কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র, যখন প্রবিষ্ট মালিক ও প্রবেশকারী মজুর, তখন অদ্ভুত সব সংঘাত তৈরি হয়। নিজের প্রতিটি নির্বাচন নিজের কাছে জবাবদিহি দাবি করে। দ্য পার্সোনাল ইজ় দ্য পলিটিক্যাল— সমকাম পুরুষকে সেই ব্যক্তিগত রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই সব সংঘাত পরতে পরতে খুলে দেখানোর এলেম হাঁসদার আছে। কয়েকটি ছোট গল্পে তার আভাসও মিলেছে। কিন্তু এই বইতে তাঁর মূল চরিত্রটি বড়ই যন্ত্রণাবিদ্ধ, অন্তর্মুখী। বিশ্লেষণ করবে কী, সে বোঝাতে পারে না কেন তার এত কষ্ট। এ শুধু তার, এবং তার মতো অগণিত তরুণ-তরুণীর অক্ষমতা নয়, এ হল ভাষা ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা। যা বলার মতো কথা নয়, তার আবার ভাষা কী? যে গান গাওয়া চলে না, তার সুর কে বাঁধতে যাবে?

কাহিনির তারসপ্তকে প্রেমাস্পদের বিচ্ছেদ-বেদনা, মন্দ্রসপ্তকে পিতার সঙ্গে সন্তানের মূক ব্যবধান। এ-ও এক রকম স্পর্শ করতে না পারার আর্তি। এই পিতা তাঁর বংশের প্রথম কলেজ-পাশ, চাকরি-প্রাপ্ত পুরুষ। হিন্দুত্ববাদী দল তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রভাব বাড়ায়। কিন্তু বড় নেতা জনজাতীয় নেতাকে দেখে বলে, ‘‘এই নরবানর সভায় আসবে নাকি?’’ আবার জনজাতীয়দের নিজস্ব পার্টি-করা সাঁওতালরা তাঁকে বলে ‘দিকুর কুকুর।’ নির্বাচনে টিকিট শেষ অবধি মেলেনি, তবু পিতা দলের কাজ করে গিয়েছেন কর্তব্যবোধে। ছেলে আড়াল থেকে দেখেছে, একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে গালাগাল দিচ্ছেন বাপ। কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখার সাহস হয়নি। যেন কিছু হয়নি, এমন ভাব করেছে দু’জনেই।

ছেলেও ধাক্কা সামলে ফের কাজের জীবনে ফিরে যায়। তার আগে শেষ বার দেখতে যায় প্রেমিককে। কলেজে যে ছিল সলমন খানের প্রতিমূর্তি, সে এখন চাকরিরত ভদ্রলোক। শুকনো সান্ত্বনা দেয় শুধু। ট্রেনে ফেরার পথে কালো চশমার পিছনে ছেলের দু’চোখ দিয়ে নামে জলের ধারা। ভিক্ষারত হিজড়ের দিকে একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সন্দিগ্ধ হিজড়ে তার শরীরের দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করে, ‘কুছ মিসিং তো নহি হ্যায়?’ ছেলে উত্তর দেয়, ‘সব কমপ্লিট হ্যায়।’ যদিও জানে, আসলে চির-অসম্পূর্ণ জীবন বাঁচতে যাচ্ছে সে।

দলীয় রাজনীতি, দেহের রাজনীতি, মিলে যায় প্রতারিত, প্রত্যাখ্যাতের নীরবতায়। ব্যর্থতা বাক্‌রুদ্ধ করে। শুধু ক্ষমতা কথা বলে।

অন্য বিষয়গুলি:

Book Book Review My Fathers Garden Hansda Sowvendra Shekhar LGBT LGBTQIA Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy