কবিতাসংগ্রহ ৬
জয় গোস্বামী
আনন্দ, ২০২০
“যদি সৌভাগ্যক্রমে এমন কোনও পাঠক পাই যিনি প্রথম খণ্ড থেকে ষষ্ঠ খণ্ড পর্যন্ত চুয়াল্লিশটি বই ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে এলেন, তবে সে-পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারবেন আমার কবিতাজীবন কতখানি অনিশ্চয়তায় ভরা! আমি স্থির নির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাইনি কখনও, কেবলই পথ খুঁজেছি। এখনও খুঁজছি।” বইটির ভূমিকায় এ কথা লিখেছেন জয় গোস্বামী। তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও উদ্যাপিত কবির মুখে এহেন বাক্য বিনয়ের সৌজন্য হিসেবে গ্রহণ করতেই পারেন কেউ, যদিও একে আমি সত্য মেনেই এই আলোচনা আরম্ভ করছি। প্রদত্ত কিছু শর্ত ছাড়া যেমন উপপাদ্যের সমাধানে উপনীত হওয়া যায় না, তেমনই এই অনিশ্চয়তার তত্ত্বকে সত্যি না মানলে পাঠকের কাছে জয়ের কবিতার আশ্চর্য হয়ে ওঠে আরওই ব্যাখ্যাতীত।
এই যে ৪৪টি বইয়ের কথা বলা আছে ভূমিকায়, ৪৩ বছর ধরে তাদের প্রবাহ আমাদের ভাষার কবিতাকে পুষ্ট করছে। চার দশকেরও বেশি বয়ে চলা এই সমস্ত কবিতার বেশির ভাগই ধরা আছে এর আগের কবিতাসংগ্রহ-গুলিতে। পরিসর, এবং অবশ্যই ক্ষমতা থাকলে একেবারে প্রথম খণ্ড থেকে এ আলোচনা শুরু করা যেত। কেননা, জয় গোস্বামীর ক্ষেত্রে কবিতাসংগ্রহ-এর প্রতিটি খণ্ড পাঠকের কাছে এক আলাদা উন্মোচন বয়ে এনেছে।
কেন বলছি এ কথা? আলাদা ভাবে তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ কি আমরা পড়িনি? মুগ্ধ হইনি তাদের পাঠে? হয়েছি নিশ্চিত। কিন্তু যখনই এক মলাটের অভ্যন্তরে একাধিক কাব্যগ্রন্থ পড়ার সুযোগ এসেছে, বার বার চমকে উঠেছি বই থেকে বইয়ে কবিতার বাঁকবদল আবিষ্কার করে। সময়ের ব্যবধানে রেখে বইগুলি পাঠ করলেও তা চোখ এড়ায় না, কিন্তু কাব্যসংগ্রহ-এর সীমানার মধ্যে ওই বিপুল বিচ্ছুরণ থমকে দেয় আরও। একই কবির লেখা এরা? পর পর বছরে লিখিত হওয়া সব কবিতা? অথচ এত ভিন্নপথগামী?
এইখানেই জয় গোস্বামীর কবিতা একান্ত তাঁর হয়ে ওঠে। একই ঘরে বহু আয়না এলোমেলো সাজিয়ে রাখলে যেমন একই মানুষের নানা প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে, জয়ের কবিতা তেমনই একই কলমে লেখা হয়েও ছুটে যায় নানা রাস্তার সন্ধানে, বহু ভাবনার উদ্দেশে। তাঁর কোনও দু’টি গ্রন্থ পাশাপাশি রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বলার উপায় নেই যে, “এই হলেন জয়।” কেননা, যত ক্ষণে পাঠক তাঁর পথকে ঠাহর করার চেষ্টা করছেন, তত ক্ষণে জয় চলে গিয়েছেন আর এক পথের অভিমুখে; আর এক ভাষায়, আর এক প্রকাশভঙ্গিতে। নিজের কাব্যকে কখনও জিরোতে দেননি, থিতু হতে দেননি, নির্দিষ্ট হতে দেননি। তাঁর কবিতায় ধ্রুব বলে যদি কিছু থাকে, তা হল সার্থক রূপান্তর।
কবিতাসংগ্রহ-এর আলোচ্য এই খণ্ডটিও তেমনই সব অবাক করা বদলের সাক্ষ্য বহন করে। গরাদ গরাদ, নিশ্চিহ্ন, চরিত্র খারাপ, সপাং সপাং, আমরা সেই চারজন, প্রাণহরা সন্দেশ, পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো, মরীচিকা ও দৈব— মোট আটটি কাব্যগ্রন্থের সমাহার এ বারের কবিতাসংগ্রহ। সঙ্গে বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতা ও ছোটদের জন্য লেখা ছড়াও আছে। এই গ্রন্থগুলির পাতার মধ্য দিয়ে সেই অনুসন্ধানকে লণ্ঠন হাতে বয়ে যেতে লক্ষ করা যায়। পথ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন বহু আগে যে কবি, তাঁর সন্তুষ্টি হয়নি আজও। এই অতৃপ্তির স্পর্ধা আজ বড়ই বিরল। জয় গোস্বামী বাংলা কবিতার কী ও কতখানি, তা বহু বার সংজ্ঞায়িত হওয়ার পরেও এই যে নতুনকে অবিরাম সন্ধানের তেষ্টা, সে-ই তাঁকে অনন্য করে রেখেছে।
গ্রন্থ থেকে পঙ্ক্তি তুলে আলোচনা করতে গেলে এক ধরনের ভয় কাজ করে, অন্তত আমার— তা হল, সমগ্রকে দেখতে না পাওয়ার ভয়। আমার একান্ত ধারণা, বিমানের জানালা থেকে আলোর বিন্দু-নকশা দেখে যেমন শহরকে চেনা যায় না, তেমনই উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তিগুচ্ছ থেকেও চেনা যায় না কোনও কবিতার বইকে। আদল পাওয়া যায় হয়তো কিছু। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমনকি সে কাজ করার উপযুক্তও আমি নই। বরং বলতে পারি, এখানেও আটটি বই ও অগ্রন্থিত কবিতারাশিতে সেই অভাবনীয় বদলকে টের পেতে হয় বার বার, দাঁড়াতে হয় সেই অপ্রতিরোধ্য অতৃপ্তির সামনে, যা এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলতে চায় নিজেকেই, পুনরায় জন্মাতে চায় নতুন ভাষায়। আন্তরিক রক্তক্ষরণ থেকে নিকট জনের স্মৃতিভার, ভেঙে যাওয়া প্রেমের যন্ত্রণা থেকে শ্রান্ত হয়ে আসা এক জীবন, আত্মগ্লানির স্বীকারোক্তি থেকে আত্মদর্শনের দিগন্তরেখা; বিস্ফোরণ থেকে বিশ্রাম, রোমাঞ্চ থেকে রোমন্থন, শিহরন থেকে শান্তি— এই সমস্ত কিছুর সমারোহে সেজে উঠেছে এ বারের এই কবিতাসংগ্রহ। প্রেমের লেখায়, অস্তিত্বের লেখায়, বিষাদের লেখায় জয় গোস্বামী বহু দিনই প্রশ্নাতীত। কিন্তু এই এত বছর পার করে এসে এক অন্য জয়কেও আবিষ্কার করছেন পাঠক, নিজের প্রতি নির্মম ও প্রকাশ্য কষাঘাত যাঁর কবিতার অস্ত্র হয়ে উঠছে বার বার।
আরও একটি কথা বলার স্পর্ধা দেখাই। তা হল এই যে, ভাষা ভাবনাহীন হলে কেবল তার ব্যবহারের কায়দাই প্রকট হয়ে ওঠে, শিল্প হয়ে ওঠা তার আর হয় না। জয় সেই গোড়া থেকেই নিজের ভাষাকে অতল সব গহ্বরের মধ্যে ফেলে আবার তুলে এনেছেন, আকাশের দিকে ছুড়ে আবার লুফে নিয়েছেন হাতে, কিন্তু তাঁর বদলাতে থাকা ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে তা হয়নি কখনওই। এই বইগুলিতে ভাবনার সঙ্গে ভাষার আশ্চর্য এই সাথ-সঙ্গত আবারও দেখতে পাওয়া যায়।
মনে হয়, আমরা পাঠকেরা হয়তো পুরাতন হয়ে পড়েছি কখনও, জয় কিন্তু নিজেকে নূতন রেখেছেন বরাবর। তাঁর কাব্যভাবনা, তাঁর কাব্যভাষার সঙ্গে তাল মেলাতে অনেক সময় খেই হারিয়েছি নিজেরাই, ফিরে ফিরে পড়তে হয়েছে তাঁকে। আর প্রতি বার টের পেয়েছি নতুনত্বের সেই আনকোরা স্বাদ, যা জয়ের স্বাক্ষর। আমরা শিল্পীর মহত্ত্ব বোঝাতে ‘মাইলফলক’কে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি বটে, কিন্তু আমার কেবলই মনে হয়, জয় একেবারে শুরুতেই বেছে নিয়েছিলেন রাস্তার ভূমিকা, বয়ে চলার প্রতিশ্রুতি, ছুটে যাওয়ার জেদ, খুঁজে চলার অঙ্গীকার। যার ধারে ধারে তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই, মাইলফলক হিসেবে। কবিতাসংগ্রহের এই খণ্ডও সেই যাত্রাপথকেই দেখায় নতুন আলোয়।
লেখা হল অনেক কথাই, বলা হয়তো হল না কিছুই। কেননা বিস্ময়ের বর্ণনা হয় না, প্রাচুর্যের পরিধি থাকে না। তাই জয় গোস্বামীর এই সমস্ত বই আমার কাছে আদতে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতার সমষ্টি, যাকে যত বেশি প্রকাশের কাছাকাছি নিয়ে যাব, ততই ব্যর্থ হতে হবে। ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ থেকে দৈব— এই সফর কেবলই নির্দেশ করে জয়ের আগামী কবিতার দিকে, আমরা পাঠকেরা যার অপেক্ষা শুরু করলাম এ বার।
নিশ্চয়তা মানেই স্থবিরতা, নিশ্চিত হওয়া মানেই স্থাণু হওয়া এক রকম। যদিও ইদানীং চার পাশে তাকালে তুমুল নিশ্চয়তার ভিড়ে নিজেকে বোকাই মনে হয় কিঞ্চিৎ। কেননা শিল্পে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এমনটা জেনেই মাঝবয়সে পৌঁছলাম। এখন যখন দেখি শেষ কথা বলেই অনেকে শুরু করছেন শিল্পের কাজ, ভয়ই হয় বইকি। সেই ভয়ের আবহে ভরসা দেন জয় গোস্বামীর মতো কবি, স্বয়ং কবিতা যাঁর দু’হাত উপহারে ভরে দেওয়ার পরেও, যিনি নতুন আঁজলা ডুবিয়ে তিনি তুলে আনছেন নিজেকে, বারংবার, কবিতার অনিঃশেষ জল থেকে। আর আমরা, তাঁর পাঠকেরা দেখতে পাচ্ছি এক আকাশ থেকে আর এক আকাশে তাঁর কবিতা-উড়ান, অনিশ্চয়ের আশ্চর্য ধারাবাহিকতা যার ডানা হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy