—প্রতীকী চিত্র।
চন্দ্রভানু রুইদাস ও নতুন মনসামঙ্গল আবুল বাশারের এক সঙ্গে গ্রন্থিত দু’টি আলাদা উপন্যাস। চন্দ্রভানু রুইদাসের মা উলাইয়া বাগদাদি। মুসলমান কন্যা উলাইয়ার জীবন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বাল্য বয়সেই, যখন তার বাবা এক লম্পটের সঙ্গে বিবাহ স্থির করেছিল। এই উপন্যাসে ধরা আছে তার স্বপ্নভঙ্গ আর নিজের শর্তে বাঁচার আকাঙ্ক্ষার অদম্য প্রাণশক্তির কাহিনি। নিজের মতো জীবন সাজাতে চেয়ে বার বার ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে পুরুষের মিথ্যাচার, গায়ের জোর, এমনকি ভীরুতারও শিকার হয়েছে সে। আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
নতুন মনসামঙ্গল-এর কাহিনি আবর্তিত হয় বর্ণহিন্দু, ধর্ষিতা, সর্পদষ্টা নন্দিনী চক্রবর্তীর জীবনের গল্প ঘিরে। দুই ধর্মীয় পরিচয়ের দুই নারী। আসলে একই যাত্রাপথের দু’টি বয়ান। উলাইয়া বাগদাদি আর নন্দিনী চক্রবর্তীর সন্ধান, নিজস্ব যাপন আর যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা, সবটাই নারীর আপন ভাগ্যজয়ের কাহিনি। পুরুষচালিত সমাজে উজান বাওয়ার আখ্যান। লেখক দু’টি আখ্যানেই বাস্তব আর রূপকের মিলমিশে কাহিনির বিন্যাস ঘটিয়েছেন, যেখানে পাঠক খুঁজে পান বহমান লোকজীবনের বাস্তবতায় মানুষের বাঁচা আর বাঁচতে চাওয়ার টানাপড়েন। ধর্ম, তার বিভিন্ন নাম এবং আচারের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে, এক অভিন্ন দর্শন দিয়ে ঘিরে রেখেছে লোকজীবনের অন্তরাত্মাকে। সেই দর্শন তৈরি করে মানুষের নিজস্ব ধর্মবোধ, যা তাকে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শেখায়। আর আছে বর্ণাশ্রম কণ্টকিত সমাজে অন্ত্যজের বিড়ম্বিত বাঁচার কাহিনি। চন্দ্রভানু নিরামিষ খায়, কিন্তু তাকে লোকে প্রশ্ন করে সে মরা গরু খায় কি না? কারণ সে রুইদাস।
চন্দ্রভানু রুইদাস ও নতুন মনসামঙ্গল
আবুল বাশার
৩০০.০০
দে’জ়
এক দিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান, অন্য দিকে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনৈতিক বার্তার সামনে বিমূঢ় আজকের ভারতবর্ষে এই উপন্যাসদ্বয় এক অন্য জীবনের কথা বলে। বাংলার পটভূমিকায় সেই ভারতবর্ষের কথা, যেখানে বিনুনির মতো পাকে পাকে ধর্মের সঙ্গে ধর্মের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ধর্ষিতা হওয়ার অপরাধে নন্দিনীকে সাপের কামড়ে হত্যা করার বিধান দিয়েছিল তার বর্ণহিন্দু অভিভাবক। তাকে বাঁচায় কামরু ওঝা। নাকি শঙ্কর গাড়ুরি? নাকি মির্জা? অথবা সবাই মিলে? পরিজন-পরিত্যক্ত একটি মেয়ের জন্য কোল পেতে দেয় একদম সাধারণ মানুষের ধর্মবোধ। সে-ও কিন্তু এই সমাজেরই।
অবশ্যই উল্লেখ্য কাহিনি দু’টির ভাষা। কূপমণ্ডূকতা আজকের সমাজের মতো ভাষারও অন্যতম লক্ষণ হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য তার অনর্গল গ্রহণক্ষমতায়। এই কাহিনি দু’টির ভাষা সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। কাহিনিতে যে ছন্দপতন হয়নি এমন নয়, কখনও কখনও রূপক আর বাস্তবের ফাঁক ভরাট হয়নি। যেমন তামান্নার সঙ্গে ওয়াহিদের দেখা এবং কথা। প্রক্ষিপ্ত মনে হয়, উলাইয়ার সিদ্ধান্ত, যে পুরুষ মূলত চালিত হয় যৌনতা দ্বারা। মুসা, ওয়াহিদ আর রতনকে ছাপিয়ে যায় বদু আর প্রশান্ত। দু’টি উপন্যাসেই প্রকৃতির এক বিশেষ ভূমিকা আছে। নদী, নৌকা, ঝড়, বৃষ্টি, মৌচাক সবই যেন চরিত্র হয়ে উঠেছে। তারা ছাড়া এই পরণকথা অসম্পূর্ণ।
রঙ্গিলা দালানের মাটি
সৈকত রক্ষিত
৪৯৯.০০
দে’জ়
রঙ্গিলা দালানের মাটি-র কাহিনি আবর্তিত হয় যশস্বী লেখক শান্তনু সেন ও তার সমাজমাধ্যমে আলাপ-হওয়া মুগ্ধ পাঠিকা রুমির প্রেম ঘিরে। একেবারেই এই সময়ের দুই পূর্ণবয়স্ক বিবাহিত মানুষের প্রেম। যাদের ঘুম ভাঙা এবং ঘুমোতে যাওয়া পরস্পরের মেসেজে। তারা ভার্চুয়াল উপহার পাঠায়, দীর্ঘ সময় ধরে সমাজমাধ্যমে কথা বলে। শান্তনু মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে নিজের মতো। তার সফরসঙ্গী হতে চায় রুমি। শান্তনু তাকে নিয়ে যেতে চায় বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে, জয়দেবের মেলা থেকে কংসাবতী ভ্রমণে। রাঢ়ের জল জমি জঙ্গল আর মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় করাতে চায় তার। সেই ভ্রমণের এক কল্পচিত্রও এই কাহিনির অন্যতম অংশ। সেখানে কংসাবতীর পাড়ের গ্রামজীবনও এসেছে খণ্ড খণ্ড হয়ে। খানিকটা সচ্ছল পর্যটকের চোখে দেখার মতো।
সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ দু’জনই। স্প্যানিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ় ভাষায় যত কথা বলে, যত উপমা দেয় বিদেশের গান আর কবিতার, ততখানি হয়তো বাংলা সাহিত্যের মুখাপেক্ষিতা নেই তাদের। কিন্তু তারাই বাংলা সাহিত্যের লেখক-পাঠক। এই কাহিনি রচিত হয়েছে শান্তনুর বয়ানে, তার স্বপ্ন, যাপন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। “যে দেশে ডিটেনশন ক্যাম্প হয়, হিন্দু-মুসলিমে দাঙ্গা লাগানো হয়, যে দেশের অযোগ্য সরকার কিষানদের ভূমিহীন করার লক্ষ্যে পুঁজিপতিদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে থাকে, সে দেশের মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে বিদ্রোহের বীজ বপন করে যাব আমি,” শান্তনুর নিজের বয়ানে এই তার গন্তব্য। কিন্তু তার আবেগসর্বস্ব প্রেমে এই প্রসারিত চেতনার কোনও প্রতিফলন চোখে পড়ে না। এক পলায়নপর রোম্যান্টিকতাই সেখানে মূল চালকের ভূমিকা নেয়। দু’জনই যেন অপছন্দের সঙ্গী এবং নিত্যকার যাপন থেকে পালাতে পরস্পরের কাছে হাঁপ ছাড়ে। আর তাই শেষ পর্যন্ত এই প্রেম আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে না।
নজরে
এক্স-অ-প্রভঁস ১৬৩৫, ম্যানচেস্টার ১৮৩৯, ফ্লোরেন্স ১৯১৩, আক্রা ১৯৩৫, মস্কো ১৯৬৮, ওয়াশিংটন ১৯৯২, কায়রো ২০১১, শার্লটসভিল ২০১৭, নিউ ইয়র্ক সিটি ২০২০, মিনিয়াপলিস ২০২০। চার শতাব্দীর সময়সারণিতে দশটি মাইলফলক। যা চলছে সেটাই চলবে বলে মেনে না নিয়ে নতুন পথে চলার নানা উদ্যোগ ‘নির্মাণ’-এর ইতিবৃত্ত লিখেছেন নিউ ইয়র্কের মিডিয়া-বিশারদ ও সাংবাদিক। তার মধ্যে আছে সপ্তদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর নানা বিন্দু থেকে চন্দ্রগ্রহণ দেখে আরও নিখুঁত ভাবে দ্রাঘিমা নির্ধারণের চেষ্টা, ২০১১ সালে মিশরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নাগরিক অভ্যুত্থানের কাহিনি, ষাটের দশকের সোভিয়েট ইউনিয়নে রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী সত্য প্রচারের প্রকল্প, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় কালো মানুষদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দুর্মর প্রয়াস।
বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়পর্বে বিজ্ঞানে ও রাজনীতিতে, জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটানোর নানা উদ্যোগের পিছনে যে যুগান্তকারী ধারণাগুলি কাজ করেছে, সেগুলি কী ভাবে এল, দানা বাঁধল, অর্থাৎ কী ভাবে তাদের ‘নির্মাণ’ করা হল, বেকারম্যান তা অনুসন্ধান করেছেন। দেখিয়েছেন, পুরনো ছেড়ে নতুন পথে চলার উদ্যোগ সার্থক করতে চাইলে মূল ধারণাটিকে অনেক যত্ন, নিষ্ঠা, পরিশ্রমে সমাজমনে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। নইলে ‘সব কিছু পাল্টে দেব’ বলে হঠাৎ-উন্মাদনার জোয়ার আসে এবং দ্রুত তার জল ফিরে যায়, প্রায়শই রেখে যায় হিংস্র নিপীড়ন বা প্রতিবিপ্লবের ধ্বংসাবশেষ।
এই সমস্যা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে, কারণ প্রচার-প্রযুক্তির বিস্ফোরণ। সমাজমাধ্যমের কল্যাণে এখন সহজেই নতুন উদ্যোগের পক্ষে লোক জড়ো করে শোরগোল তোলা যায়। কিন্তু উদ্যোগের দীর্ঘ প্রস্তুতি নেই, ধারণার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার অনুশীলন নেই, ফলে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের বুদ্বুদ অচিরেই ফেটে যায়। তা হলে উপায়? বেকারম্যান দেখিয়েছেন, বড় অভিযানের আগে যে শান্ত প্রস্তুতি জরুরি, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারেই কী ভাবে তার আয়োজন সম্ভব। এ বই কেবল পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে না, পৃথিবী বদলানোর জন্য কী করতে হবে, তা নিয়েও দরকারি কথা বলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy