পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ফ্রাঁস ভট্টাচার্য
১০০০.০০
এশিয়াটিক সোসাইটি
হুজুগে বাঙালি যখন, তখন বাঙালি পাঠকই বা হুজুগে হবেন না কেন? বাঙালির পাঠক-পার্বণের তাই পারম্পর্য নেই, বছরওয়ারি হট্টগোল আছে। বিশেষ করে বঙ্গজ আইকনদের শতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষ, দ্বিশতবর্ষ এলেই তাঁদের নিয়ে হট্টগোল তুঙ্গে ওঠে এবং যথারীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু ‘গরজন ও তরজন’ সঙ্গে ব্যাকুল অশ্রু ‘বরষণ’। আগে শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষে চোখে পড়ার মতো কাজ তাও দেখা যেত— যত দিন যাচ্ছে অবনীন্দ্রনাথের কল্পনা অনুযায়ী একেলেরা খাটো হচ্ছেন, বেগুন গাছে আঁকশি দিচ্ছেন। বলবার কইবার মতো তেমন ভালো কাজ আর চোখে পড়ছে না। বিদ্যাসাগরকে ঘিরে বিনয় ঘোষ, অরবিন্দ গুহ, অশোক সেন প্রমুখ গবেষকরা বাংলা-ইংরেজিতে যে মাপের কাজ করে গিয়েছেন তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে তেমন মাপের আয়োজন চোখে পড়ল না, তবে প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনের সঙ্গে আয়োজনের অবশ্য সব সময় মিল হয় না। ১৯৫৭-১৯৫৯ এই কালপর্বে প্রকাশিত হয়েছিল বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালিসমাজ, অরবিন্দ গুহ (ইন্দ্র মিত্র) করুণাসাগর বিদ্যাসাগর লিখে আম-বাঙালিকে বিদ্যাসাগর জীবনের প্রতি পুনশ্চ মনোযোগী করে তুলেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত আনপাবলিশড লেটার্স অব বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগরের কর্ম-ভাবনাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল। বিদ্যাসাগরের ভাবনার ও কর্মের সীমা নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে অশোক রুদ্র ও প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের তর্ক-বিতর্ক ভাবনা উসকে দেওয়ার মতো। বদরুদ্দীন ‘মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে ও মার্কসবাদী পদ্ধতিতে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটা সংক্ষিপ্ত সামগ্রিক মূল্যায়ন’ করতে চেয়েছিলেন। অশোক রুদ্র-প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য দু’জনেই যেন মনে করছিলেন কাঠামোটি বড্ড হাওয়া-বাতাসহারা। অশোক সেনের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অ্যান্ড হিজ় এলিউসিভ মাইলস্টোনস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। সংবেদনশীল বাঙালি চিন্তকের ব্যক্তিগত প্রয়াস ও উপনিবেশকর্তাদের কৌশলী প্রশাসনিকতা এ দুয়ের টানাপড়েন বুঝতে চেয়েছিলেন তিনি। এ-সবই পুরনো প্রয়াস। এঁদের সমতুল কাজ তো হলই না, এই কাজগুলিও আমরা খুঁটিয়ে পুনর্বিচার করলাম না।
বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছরে সভা হল অনেক, বইও প্রকাশিত হল কিছু। তবে দাগ কাটার মতো তেমন কিছু হাতে এল কোথায়! এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের লেখা বইটি এক অর্থে গোছানো বই। বাংলা-না-জানা পাঠকদের বইটি মোটের ওপর বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে সরল ভাবে জানতে-বুঝতে সাহায্য করবে। বইটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়েই ফ্রাঁস বিদ্যাসাগর জীবন-সম্বন্ধীয় উৎসগ্রন্থগুলিকে নির্দেশ করে বিদ্যাসাগরের সমকালকে বুঝতে চেয়েছেন। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারীলাল সরকার, সুবলচন্দ্র মিত্র, বিনয় ঘোষ, ব্রায়ান এ হ্যাচার তাঁর অবলম্বন। টুকরো প্রবন্ধের কথাও আছে, সুমিত সরকারের বিদ্যাসাগর বিষয়ক ইংরেজি লেখার কথা আছে, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের বাংলা লেখার কথা অবশ্য নেই। মঙ্গলাচরণের মতো করে পূর্বজরা কে কী কাজ করেছেন তা সংক্ষেপে নির্বাচিত ভাবে জানান দেন। তবে সকলের কথা আসেনি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিবন্ধ বাদ গিয়েছে সে তো বলেইছি। ‘বিদ্যাসাগর চর্চার ইতিহাস’ তৈরি করা হয়তো উদ্দেশ্য নয়। এ অধ্যায়ে রামমোহন-বিদ্যাসাগরের প্রতিতুলনাও চোখে পড়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় বিদ্যাসাগরের জীবনকথা, কী ভাবে গ্রামের ছেলেটি কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসে বড় হয়ে উঠল এখানে তার ছবি। স্বাভাবিক ভাবেই অতিকথাগুলি বাদ গিয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয় বিদ্যাসাগরের প্রশাসনিক, বিদ্যাবিষয়ক ও সামাজিক সংস্কার। সংস্কৃত কলেজের পড়াশোনার পদ্ধতির ও পাঠ্যসূচির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি কী করেছিলেন সেই সব বৃত্তান্ত লিখেছেন ফ্রাঁস। বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রদ প্রচেষ্টা, সহবাস-সম্মতি আইনের প্রসঙ্গ আলোচিত। সহবাস সম্মতি আইন প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের অভিমত যে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল সে বিষয়ে ফ্রাঁসের বিচার সুগভীর বলে মনে হয়নি। চতুর্থ অধ্যায়ে বিদ্যাসাগরের ধর্ম-ভাবনা, ব্রিটিশ প্রশাসনিকতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, তাঁর লেখালিখি, ব্যক্তিত্ব ও নানা জনের বিদ্যাসাগর মূল্যায়ন আলোচিত। এই সব আলোচনায় কোথাও যে খুব মৌলিক কথা লিখেছেন তা নয়, তবে মোটের উপর গোছ আছে।
ফ্রাঁসের বইয়ের এই আপাত গোছকে অতিক্রম করে কেউ যদি একটু তলিয়ে বিদ্যাসাগর চরিত বুঝতে চান তা হলে হতাশ হবেন। সে বিষয়ে এ বার একটা দুটো কথা লেখা যাক। ইচ্ছে করেই তাঁর সমগ্র বই থেকে ইতি-উতি নানা অংশ উদ্ধার করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যের যে প্রতিতুলনা চোখে পড়ে তা নিতান্তই বাহ্যিক। দু’জনের পারিবারিক ও সামাজিক-শ্রেণিগত পার্থক্যের কথা নির্দেশ করেছেন ফ্রাঁস। সত্যই তো রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরের পরিবার ‘অভিজাত’ ও ‘বিত্তশালী’ নন। তবে পরিবার ও সমাজের বাইরে তাঁদের ব্যক্তিমন সমাজ-সংস্কারে নিযুক্ত, তাঁদের সমাজসংস্কারমূলক রচনার সূত্রে তাঁদের মনটিকে কিন্তু ফ্রাঁস বুঝতে চাননি। রণজিৎ গুহ তাঁর দয়া নামের পুস্তিকায় কী ভাবে রামমোহনের গদ্য সমাজমনে দয়ার সঞ্চার ঘটিয়েছিল তা পর্যালোচনা করেছিলেন। গুহর বইতে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। অথচ বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির সূত্রে এই দয়াসঞ্চারী ভাষাপ্রকল্পের পুনর্বিবেচনা সম্ভব। ফ্রাঁস লেখক বিদ্যাসাগরকে নিয়ে খানিকটা আলোচনা প্রথম অধ্যায়ে ও পরে চতুর্থ অধ্যায়ে করেছেন বটে কিন্তু কোথাও তিনি বিদ্যাসাগরী রচনার সামাজিক অভিঘাত বুঝতে চাননি। অথচ যে ভাবে তিনি বিচার করেছেন তাতে এই বোঝাপড়া অনিবার্য ছিল। ফলে দুই সংস্কারকের প্রতিতুলনা বাইরের কোঠাতেই আটকে থাকল। প্রসঙ্গত জানাই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ তাঁর মতে বাঙালি কিশোরদের ‘বানান শিক্ষা’র বই— রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ প্রকাশের পর বানান শিক্ষার ক্ষেত্রে এটির গুরুত্ব কমল। (‘...বর্ণপরিচয় রিমেনড দি আনডিসপিউটেড স্পেলিং বুকস ফর বেঙ্গলি চিলড্রেন আনটিল দ্য পাবলিকেশন অব সহজপাঠ’) এই মন্তব্যটি একটু সরল বলেই মনে হল। ‘সহজ পাঠ’ আর যাই হোক না কেন বানান শিক্ষার বই হিসেবে ‘বর্ণপরিচয়’-এর বিকল্প নয়। ‘সহজ পাঠ’ বাঙালি কিশোর-কিশোরী ‘বানান শিক্ষার বই’ হিসেবে পড়তেন না—বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা ও প্রাইমার রচনার আদর্শ পৃথক। বিদ্যাসাগরের ভাষা-ভাবনা, ভাষাদর্শ তাঁর সমাজ-সংস্কার ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত। সে-কথা খেয়াল রাখলে এ-জাতীয় সরল সিদ্ধান্তের ফেরে হয়তো আটকা পড়তে হত না। বিদ্যাসাগর যুক্তাক্ষর-বানান এই সব শেখাতে চাইলেও দ্বিতীয় ভাগে পড়ুয়াদের জন্য যে কাহিনি যোজনা করেছিলেন সে-বিষয়ে ফ্রাঁসের মন্তব্য আশা করা অন্যায় নয়।
ফ্রাঁস তাঁর বইতে বিদ্যাসাগরের ধর্ম-ভাবনা, সহবাসসম্মতি আইন ইত্যাদি বিষয়ে নানা টুকরো-টুকরো প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। সে প্রসঙ্গগুলি অনেক ক্ষেত্রেই অগভীর, চেনা তথ্যের সমাহার মাত্র। তাঁর সহায়ক গ্রন্থতালিকায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ বইটির উল্লেখ চোখে পড়ল না। বছর নয়েক আগে প্রকাশিত শ্রীভট্টাচার্যের এই বইটি বিদ্যাসাগর চর্চার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, লেখাগুলি অবশ্য আরও আগেকার। কোনও ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর মূর্তি নির্মাণ না করে বিদ্যাসাগরের জীবনের নানা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা ছিল। ‘বিভ্রান্তিবিলাস: সহবাস-সম্মতি আইন ও বিদ্যাসাগর’ লেখায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগরী ভাবনার প্রেক্ষিত নির্দিষ্ট করেছিলেন। এ বিষয়ে অশোক সেনের সঙ্গে তাঁর মতভেদ হয়েছিল। রামকৃষ্ণ লিখেছিলেন, ‘বাঙালি হিন্দুদের সমাজজীবন ও প্রথা সম্পর্কে যথেষ্ট না-জেনেই কেউ কেউ বিদ্যাসাগরের খুঁত ধরেন, সহবাস-সম্মতি বিল্-এর ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা নিয়ে অযথা অকথা-কুকথা বলেন।’ কথাটি খেয়াল করা জরুরি। ফ্রাঁসের বইতে পূর্বজদের এই সব তর্ক-বিতর্ক অনুপস্থিত, অনুল্লেখিত। স্বপন বসুর সমকালে বিদ্যাসাগর-এর উল্লেখ ফ্রাঁস করেছেন বলেই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের উল্লেখ জরুরি। কারণ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর বইতে সমকালীন প্রসঙ্গের সূত্রে বিদ্যাসাগরের তর্ক-পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছিলেন।
ফ্রাঁস যে হেতু বাংলা ভাষার লেখা ব্যবহার করতে সমর্থ সে হেতু তাঁর কাছে পাঠকের দাবি কিছু বেশি। ইদানীং ভারত-সংস্কৃতি কিংবা ভারতীয় ব্যক্তি বিষয়ক ইংরেজি পর্যালোচনায় একটা ফাঁক চোখে পড়ে। ভারতীয় ভাষার আলোচনাগুলি গভীর হলেও ইংরেজিতে বহু ক্ষেত্রে অব্যবহৃত। ফ্রাঁসের পক্ষে এই দূরত্ব দূর করা সম্ভব। তাঁর উচিত ছিল বঙ্গভাষায় বিদ্যাসাগর চর্চার পরিসরটিকে আরও মনোযোগ সহকারে দেখা, তা হলে পাঠকদের আক্ষেপ করতে হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy