১৯৫৩-র সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায় উনিশ বছরের এক বঙ্গসন্তান এসএস স্ট্র্যাটনেভার জাহাজে বম্বে (এখন মুম্বই) থেকে ইংল্যান্ডের পথে পাড়ি দিচ্ছে। তার মনে ‘উত্তেজনার সঙ্গে একটা অনির্দিষ্ট উদ্বেগের অদ্ভুত মিশ্র’ অনুভূতি। তার মনে পড়ছে ম্যাক্সিম গোর্কির স্মৃতিকথার সেই জায়গাটি, যেখানে তিনি লিখছেন বাড়ি ছেড়ে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সময় তাঁর বিচ্ছেদ-বেদনা অনুভবের কথা। অমর্ত্য সেন লিখছেন, “একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছি— ব্রিটেনে, কেমব্রিজে— সেই উত্তেজনার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষাদ, যে দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির টান।” জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের আলোয় তিনি দেখছিলেন ভারতবর্ষের তীরভূমি।
শান্তিনিকেতনে তাঁর জন্ম। আদি বাড়ি মানিকগঞ্জের মত্ত গ্রামে, তার পরে ঢাকা শহরের উয়ারী এলাকায় ‘জগৎ কুটির’। তবে অমর্ত্যের প্রথম শৈশবস্মৃতি হল বর্মার। মান্দালয়ে বাড়ি থেকে মেমিয়ো পাহাড়ের উপর সূর্যোদয়ের দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করত। ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে বাবা তাঁকে বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাদামাটা একটি কবর, উপরে ঢেউ-খেলানো লোহার আচ্ছাদন— ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরা শেষ মোগল সম্রাটের পরিচয় দিয়েছিল ‘দিল্লির প্রাক্তন রাজা’ হিসেবে।
অমর্ত্য নামটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। মানুষ হয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। দাদু আর দিদিমার— ক্ষিতিমোহন সেন এবং কিরণবালার— বড় রকমের প্রভাব পড়েছিল তাঁর উপর। ‘দাদু-দিদিমার সঙ্গ’ নামের মর্মস্পর্শী অধ্যায়টিতে অমর্ত্য লিখেছেন, রাতে খাওয়ার সময় ক্ষিতিমোহনের সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য, কবীরের দোহা এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞেয়বাদ বিষয়ে তাঁর দীর্ঘ কথোপকথনের কথা। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে বরাবর তাঁর যে দৃঢ় প্রত্যয়, সেটা তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন, তা বোঝা কঠিন নয়। ছেলেবেলাতেই তিনি দুর্ভিক্ষ আর দেশভাগের দুই হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়েছেন, যে অভিজ্ঞতা সমাজের প্রতি তাঁর দায়বোধকে সুদৃঢ় করে তোলে।
জুলাই ১৯৫১। কলকাতায় সে দিন খুব বৃষ্টি। অর্থনীতি পড়ার জন্য অমর্ত্য প্রেসিডেন্সি কলেজে এলেন। শুরু হল তাঁর বিদ্যাচর্চার নতুন এক অধ্যায়। ভবতোষ দত্তের থেকে তিনি পড়ানোর শৈলী শিখেছিলেন, তাপস মজুমদারের কাছে শিখেছিলেন প্রশ্ন করার গুরুত্ব। কলেজ স্ট্রিটে দাশগুপ্তর দোকান থেকে এক দিন কেনেথ অ্যারো-র সোশ্যাল চয়েস অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ভ্যালুজ় পড়ার জন্য নিলেন, তার পর কফি হাউসে বসে সহপাঠী বন্ধু সুখময় চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘ইমপসিবিলিটি থিয়োরেম’ নিয়ে আলোচনা চলল, এই ভাবেই শুরু হল সামাজিক চয়নের (সোশ্যাল চয়েস) তত্ত্বে তাঁর মৌলিক এবং পথপ্রদর্শক গবেষণার প্রস্তুতি। রাজনৈতিক ঝোঁকটা ছিল বাঁ দিকে, মার্ক্স চর্চা করেছিলেন নিবিড় ভাবে, কিন্তু অমর্ত্যের কাছে ব্যক্তির স্বাধীনতা ছিল মূল্যবান। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “আনুগত্য দাবি করে, এমন কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।”
হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মেময়ার
অমর্ত্য সেন
৮৯৯.০০
অ্যালেন লেন
ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় একই জাহাজে ছিলেন ভারতের মহিলা হকি দল। তাঁদের এক সদস্য অমর্ত্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “শিক্ষা কী কাজে লাগে?” অমর্ত্য জবাব দিয়েছিলেন, “আমি তো হকি খেলতে পারি না, তাই আমাকে লেখাপড়াই শিখতে হবে।” সেই তরুণী বললেন, অমর্ত্যকে তিনি হকি খেলা শিখিয়ে দেবেন। শুনে অমর্ত্য বললেন, তা হলে তো তিনিও তাঁর শিক্ষকই হবেন। মেয়েটি বললেন, “হ্যাঁ, তা ঠিক, কিন্তু সেটা দারুণ মজার ব্যাপার হবে, তুমি সারা বিকেল ডেকে বসে যে একঘেয়ে অঙ্ক কষছিলে তার চেয়ে অনেক ভাল হবে।”
১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরের একেবারে শেষে অমর্ত্য সেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মহিমময় দরজা দিয়ে প্রথম বার প্রবেশ করলেন। সেই প্রথম দর্শনের কথা লিখেছেন তিনি, “নেভিল’স কোর্ট-এর এক দিকে রেন লাইব্রেরি, এত অপূর্ব ইমারত বেশি দেখিনি।” প্রথমে ছাত্র এবং পরে ফেলো হিসেবে তাঁর কেমব্রিজ বাসের কথা পড়তে পড়তে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ল। ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে এক দিন ক্যাম নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি তখন অক্সফোর্ডে পলিটিক্যাল ইকনমি-র ড্রামন্ড প্রফেসর, আর আমি সবেমাত্র সেন্ট ক্যাথরিন’স কলেজে ফেলো হয়েছি। মনে আছে, রেন লাইব্রেরির ঠিক পিছনে কেমব্রিজ ব্যাকস-এ হাঁটতে হাঁটতে সে দিন ভাবছিলাম, অমর্ত্যদা এখানে কতটাই স্বচ্ছন্দ! সে-দিন সেই অপূর্ব পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আলোচনা করছিলাম উনিশশো ত্রিশের দশকের মহামন্দা এবং ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে। হাঁটা সেরে আমরা সে দিন ইয়ান স্টিফেন্স-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৪৩-এর অক্টোবরে তিনি দুর্ভিক্ষ নিয়ে খবর ছাপানোর উপর সরকারি নজরদারি অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্রাবস্থায় অমর্ত্য লেখক ই এম ফর্স্টার-এর কথায় উৎসাহিত হয়ে কেমব্রিজের কিংস কলেজে স্টিফেন্সের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
কেমব্রিজে পৌঁছে দ্বিতীয় দিনে অমর্ত্য তাঁর বিভাগের ডিরেক্টর অব স্টাডিজ় পিয়েরো স্রাফার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। স্রাফা ইটালির মানুষ, বিরাট অর্থনীতিবিদ, এবং আন্তোনিয়ো গ্রামশির বন্ধু। তাঁর সঙ্গে স্রাফার গভীর বন্ধুত্ব আজীবন অটুট ছিল। স্রাফা তাঁকে কড়া রিস্ত্রেতো (এসপ্রেসো-র নির্যাস) কফির স্বাদ ধরিয়েছিলেন, এবং একটি প্রগাঢ় সুপরামর্শ দিয়েছিলেন— তত্ত্বকে কখনও স্লোগানে পরিণত করতে নেই। অমর্ত্যের লেখায় দারুণ সুন্দর ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর শিক্ষকদের— পিয়েরো স্রাফা, সমন্বয়বাদী মার্ক্সীয় অর্থনীতিবিদ মরিস ডব এবং রক্ষণশীল ‘টোরি’দের প্রতি সহানুভূতিশীল ডেনিস রবার্টসন। তীক্ষ্ণধী কিন্তু কট্টর মতামতের জোন রবিনসনের সঙ্গে তাঁর চিন্তাগত মতানৈক্যের কথাও অমর্ত্য পরিষ্কার করে লিখেছেন।
অমর্ত্য সেনের হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড আসলে একাধারে তিনটি বইয়ের সমাহার। জীবনের প্রথম ত্রিশ বছরের সংবেদী স্মৃতিকথার সঙ্গে তিনি বুনে দিয়েছেন এক দিকে ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ভাষ্য, এবং অন্য দিকে, অর্থনীতির তত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক প্রগাঢ় আলোচনা। একটি অধ্যায়ে আছে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সুগভীর বিশ্লেষণ। আর একটি অধ্যায়ে আমরা জানতে পারি, দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইনকে তাঁর প্রথম দিকের মৌলিক রচনা ত্রাক্তাতুস লজিকো-ফিলজ়ফিকুস থেকে সরে এসে ফিলজ়ফিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস-এর ভাষা-বিধি বিষয়ক আলোচনায় অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে পিয়েরো স্রাফার কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই বিষয়টি সম্পর্কে অমর্ত্য সেনের লেখায় এক অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়।
অমর্ত্য তাঁর স্মৃতিচারণে বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক কথা বলেন, ভালবাসা সম্পর্কে তিনি স্বল্পবাক। হয়তো তিনি দুইয়ের মধ্যে কোনও ধরাবাঁধা সীমারেখা আছে বলে স্বীকার করেন না, কিংবা হয়তো তিনি এটাই বিশ্বাস করেন যে, বন্ধুত্ব ছাড়া ভালবাসা হয় না। খুব উষ্ণ অনুভূতি নিয়ে বন্ধুদের কথা লেখেন তিনি— বন্ধুরা পুরুষ ও নারী, নানা দেশের লোক। কেমব্রিজে ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছাত্রছাত্রীদের ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার কথা লিখেছেন অমর্ত্য, লিখেছেন কেমন করে রেহমান সোবহান এবং মাহবুব-উল হকের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
অতলান্তিকের অন্য দিকে আমেরিকার যে নতুন কেমব্রিজ অমর্ত্যের পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রধান বাসভূমি হয়ে উঠেছে, এই বইতে তার একটা ঝলকমাত্র দেখা যায়। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি বিদ্যাচর্চার কাজে এমআইটি এবং স্ট্যানফোর্ডে যান। কেমব্রিজে তখন দুই বিপরীত অর্থনৈতিক চিন্তাধারার অনুগামী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বেজায় বিবাদ, আমেরিকায় বেশ কিছুটা সময় কাটাতে পেরে অমর্ত্য সেই পরিবেশ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এই দশকেই কিছুটা সময় দেশে ফিরে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ গড়ে তোলার কাজটি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৩ সালে ভারতের রাজধানীতে অর্থনীতিচর্চার একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ডাক এল। অমর্ত্য সেই ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তার নামে বৈরিতার মাত্রা চড়ছে, এই পরিস্থিতিতে তাঁর ভয় ছিল কেমব্রিজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ করা যাবে না, তাই দিল্লি ফিরলেন এক অদ্ভুত পথে— লাহৌর এবং করাচি হয়ে। এর পর তাঁর বিদ্যাচর্চা যে পথে এগিয়ে যাবে, তার কাহিনি তো ইতিহাস এবং লোকশ্রুতির সম্পদে পরিণত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy