ধার্মিক: বারাণসীতে গঙ্গাস্নান করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ১৩ ডিসেম্বর। পিটিআই.।
মোদী’জ় ইন্ডিয়া: হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড দ্য রাইজ় অব এথনিক ডেমোক্র্যাসি
ক্রিস্টাফ জাফরেলো
৮৯৯.০০
কনটেক্স্ট
এই বইটা যখন পড়ছি, তখন এক বহু পুরনো প্রতিশ্রুতির আর একটা অংশ পূরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনের দিন, উচ্চারণ না করেও, তিনি জানিয়ে দিলেন, অযোধ্যায় করসেবকরা যে স্লোগান দিয়েছিল, ‘কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’— তার কাশী অংশটির মীমাংসা হয়ে গেল। তবে, শুধু সেটুকুকেই হিন্দুত্ববাদী প্রাপ্তি ধরলে নেহাত খণ্ডদর্শন হবে। আসল প্রাপ্তি হল, যে কাজ শুরু করেছিল ব্যক্তি, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় এসে রাষ্ট্র তা পূরণ করার দায়িত্ব তুলে নিল নিজের কাঁধে। গোলওয়ালকর যে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন, নরেন্দ্র মোদী বহুলাংশে তা পূরণ করলেন।
ক্রিস্টাফ জাফরেলো তাঁর বইয়ে এই কার্যত (ডি ফ্যাক্টো) হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিকে রেখেছেন এক কেন্দ্রীয় অবস্থানে। একের পর এক উদাহরণ পেশ করে জানিয়েছেন, কী ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ অবান্তর করে দিয়ে— এতখানিই যে, এখন আর সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটাকে সরানোর দাবিও তেমন গুরুতর ভাবে শোনা যায় না— হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রের ধর্মের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন বর্তমান শাসকরা। ভারতীয় মানে একমাত্র হিন্দু, এবং একমাত্র হিন্দু মানেই ভারতীয়, এই সমীকরণটি প্রতিষ্ঠা করা গেলেই আর অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের বালাই থাকে না। তখন প্রধানমন্ত্রী স্বচ্ছন্দে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন; বারাণসীর করিডর উদ্বোধন করতে এসে অনতিপ্রচ্ছন্ন হুমকি দিতে পারেন ভিন্নতর ধর্মাবলম্বীদের। এবং, তার সবটাই করতে পারেন রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের ভঙ্গিতে— কারণ, রাষ্ট্র মানে যে শুধুমাত্র হিন্দুত্ব, এই কথাটির বৈধতা তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
কী ভাবে, তারই অসামান্য বিবরণ রয়েছে আলোচ্য বইটিতে। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার আগে থেকে, এই ২০২১ সাল পর্যন্ত, একের পর এক ঘটনার উল্লেখ করে জাফরেলো দেখিয়েছেন, কী ভাবে গত এক শতাব্দীর হিন্দুত্ববাদের সূত্রগুলোকে ধরে ধরে এগিয়েছেন মোদী। সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে সংখ্যালঘু সম্বন্ধে অহেতুক ভীতি তৈরি করা, জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে ব্যর্থ যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগিয়ে তোলা গরগরে রাগ, সামাজিক পরিসরগুলোতে কোণঠাসা করে ফেলা সংখ্যালঘু মানুষদের— হিন্দুত্ববাদের বহুচর্চিত রেসিপি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে মোদীর ভারত। তার সঙ্গে অন্য একটা কাজ করা গিয়েছে— যাবতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শিরদাঁড়া ভেঙে সেগুলোকে নিতান্ত জড়বস্তুতে পরিণত করা, যাতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুবৃহৎ প্রকল্পে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনওটা বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে।
এই জমানা সম্বন্ধে আগ্রহী এবং ওয়াকিবহাল কোনও পাঠক একটা গুরুতর অভিযোগ করতে পারেন বইটি সম্পর্কে— গত আট-দশ বছরে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যত লেখালিখি হয়েছে, যত বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে নতুন কোনও কথা কি এই বইটিতে আছে? একই কথা, একই বিশ্লেষণের পুনরাবৃত্তিই কি করলেন না ক্রিস্টাফ জাফরেলো, প্রায় সাড়ে ছ’শো পাতার এই বইটিতে? অভিযোগটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু, তার প্রয়োজনও নেই। মোদী জমানার একটা সামগ্রিক ছবি দুই মলাটের মধ্যে ধরে দেওয়ার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ— বিশেষত, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলিকে এক সূত্রে গাঁথতে থাকলে তার থেকে যে বৃহত্তর ছবিটি বেরিয়ে আসে, তাকে বারে বারেই স্পষ্ট করে দেওয়ার কাজটা জরুরি বইকি।
সেই বড় ছবিটা দেখলে বোঝা সম্ভব, হিন্দুত্ববাদের স্রোত কী ভাবে পথ বদলে বদলে চলেছে এই জমানায়। অযোধ্যা তার একটা মোক্ষম উদাহরণ। ১৯৯২ সালে যখন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল, সে রাজ্যে তখনও ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। কিন্তু, মসজিদ ভাঙার জন্য গোটা দেশ থেকে করসেবকদের জোগাড় করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহ সেই করসেবকদের সুবিধা করে দিয়েছিলেন বিলক্ষণ, কিন্তু ভাঙার কাজটা রাষ্ট্রশক্তি প্রত্যক্ষ ভাবে করেনি, তা করেছিল ব্যক্তিবিশেষ। প্রায় তিন দশক পেরিয়ে এসে সেই মসজিদের জমিতেই যখন রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল— যে কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়— সেই কাজের জন্য কিন্তু কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ল না। এমনকি কোনও মোহন্ত, কোনও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের শীর্ষ নেতারও নয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী— দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। আগে এর জন্যই প্রয়োজন হত ব্যক্তির, রাষ্ট্র যাদের দায় অস্বীকার করতে পারে। আজকের ভারতে আর সেই দায় নেই। যে হেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের রাজনৈতিক কল্পনায় ভারত এখন হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, ফলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে, হিন্দু তীর্থক্ষেত্রে করিডরের উদ্বোধনে হিন্দুত্বের জয়গান গাইলে তাকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য সম্পাদন হিসাবে দেখানোই যায়। জাফরেলো তাঁর বইয়ে বার বার ফিরে এসেছেন এই বিশেষ সাফল্যটির কথায়। রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের চরিত্র মাত্র সাত-আট বছরে এতখানি বদলে গেল কেন, ভবিষ্যতের কোনও গবেষক সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলে আলোচ্য বইটি তাঁর মস্ত সহায় হবে।
হিন্দুরাষ্ট্র যে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব, এই কথাটি নরেন্দ্র মোদী তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের একেবারে গোড়াতেই স্পষ্ট বুঝে নিয়েছিলেন। ফলে, একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁর বিশ্বস্ত আধিকারিকরা। একের পর এক প্রতিষ্ঠান তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছে সাগ্রহে। তার উপযোগিতাও স্পষ্ট। কিছু বছর আগেও হিন্দুত্ববাদের সমালোচকদের চুপ করাতে হলে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলতে হত— অবশ্যই, কোনও ব্যক্তির মাধ্যমে— এম এম কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর থেকে গৌরী লঙ্কেশ, উদাহরণের অভাব নেই। এখন তাঁদের মামলায় জড়িয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখা যায় জেলে। তার জন্য কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন নেই, রাষ্ট্রই সেই কাজ করতে পারে। পদ্মাবত-এর সেটে হামলা চালাতে প্রয়োজন হত হিন্দু সেনার; মুনাবর ফারুকির একের পর এক শো বন্ধ করে দিতে শুধু পুলিশই যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদীর জমানার প্রকৃত অভিজ্ঞান কী, সেই প্রশ্নের উত্তর এখানেই রয়েছে।
এই ব্যবস্থার সুবিধা অনস্বীকার্য। ব্যক্তিকে দিয়ে, অথবা কোনও দলকে দিয়েও, কাজ করিয়ে নেওয়ার মুশকিল হল, সেখানে দুই পক্ষের স্বার্থের সংঘাত হতেই পারে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের সঙ্গে মোদী-শাহের স্বার্থ সর্বদা সমানুবর্তী হবে না, তা স্বাভাবিক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেই ভয় নেই। কাজেই, মোদী জমানা যত এগিয়েছে, বজরং দল বা করণী সেনার মতো সংগঠনের গুরুত্বও যে তত কমেছে, সেটা সমাপতন নয়। ব্যক্তির গুরুত্ব সম্পূর্ণ ফুরিয়েছে, তেমন দাবি করার কোনও কারণ নেই। গো-সন্ত্রাসই হোক অথবা সাম্প্রদায়িক অশান্তি, ব্যক্তির ভূমিকা আছে। থাকবেও। কিন্তু, হিন্দুত্ববাদের প্রসারের দায়িত্বটি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের নিরাপদ হাতে তুলে দেওয়া গিয়েছে। মোদীর ভারতের সেরা সাফল্য এটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy