Advertisement
১৮ জানুয়ারি ২০২৫
book review

চেনা খোপের বাইরে মার্ক্স-চর্চা

‘ক্লাস’ বা শ্রেণির অর্থ কী? বিপ্লব মানে কী? শোষণ বলতে কী বোঝায়? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘ট্রানজ়িশন’ বা অবস্থার পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়?

অংশী: অনেকের মধ্যে একা, ব্রিগেডে সিপিএম কলকাতা জেলা কমিটির সমাবেশ। ১৯৯৬ সালের ছবি।

অংশী: অনেকের মধ্যে একা, ব্রিগেডে সিপিএম কলকাতা জেলা কমিটির সমাবেশ। ১৯৯৬ সালের ছবি।

মানস রঞ্জন ভৌমিক
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৪৩
Share: Save:

সমাজবিজ্ঞানের আঙিনায় কার্ল মার্ক্সের লেখাপত্র ও চিন্তা বিপ্লব এনেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এর পর বিংশ শতাব্দীতে মার্ক্সবাদ ক্রমশ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে। পরিচিত প্রশ্নের অতিপরিচিত উত্তরের জোগান দেয় ‘মার্ক্সবাদী রাষ্ট্র’, নতুন প্রশ্ন ও নতুন নতুন আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও রুদ্ধদ্বার তৈরি করা হয়। শতধারায় বয়ে চলা মার্ক্সবাদ চর্চার ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা, নতুন আঙ্গিক নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত, রিচার্ড উলফ ও স্টিফেন রেসনিক বিরচিত গ্রন্থ নলেজ অ্যান্ড ক্লাস। লুই আলথুসার মার্ক্সবাদ চর্চায় এক নতুন ঘরানা নিয়ে আসেন, সেই পথ ধরেই রেসনিক এবং উলফ রচনা করেন বইটি। আর সেই মুক্তধারায় অবগাহন করেই এক নতুন পথে চলে, ভারতের জন্যে মার্ক্সবাদ নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন এবং গবেষণা করেছেন রিথিঙ্কিং মার্ক্সিজ়ম: ইন্ডিয়া ফ্রম আ ক্লাস পার্সপেক্টিভ গ্রন্থের লেখকদ্বয় অঞ্জন চক্রবর্তী এবং অনুপ ধর। এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে এই দুই লেখকের বহু দশকব্যাপী গবেষণাঋদ্ধ প্রবন্ধাবলি। সনাতন মার্ক্সবাদের পরিচিত প্রশ্নগুলিকে অন্য আঙ্গিক থেকে নতুন করে ভেবেছেন লেখকেরা। এবং এই নতুন আঙ্গিক ব্যবহারের ফলে নতুন নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। মার্ক্সের এক নতুনতর পাঠলেখকদ্বয় আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাঁদের নিবিড় ও সুগভীর গবেষণার মধ্যে দিয়ে।

‘ক্লাস’ বা শ্রেণির অর্থ কী? বিপ্লব মানে কী? শোষণ বলতে কী বোঝায়? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘ট্রানজ়িশন’ বা অবস্থার পরিবর্তন বলতে কী বোঝায়? উন্নতি কথাটার মানে আসলে কী হতে পারে? উন্নয়ন মানে ঠিক কী আর কী নয়? ধনতন্ত্র বা ক্যাপিটালিজ়ম বলতে আজকে কী বোঝায়? সমাজ ও অর্থনীতির ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় ক্যাপিটালিজ়ম কি একটি স্টেজ বা ধাপ? আমেরিকায় ক্যাপিটালিজ়ম বলতে যা বোঝায়, ভারতেও কি তা-ই বোঝায়? তা হলে ‘নন-ক্যাপিটাল’ বলতে কী বোঝায়? ধনতন্ত্রের বাইরে কি কিছু আছে? নিয়োলিবারালিজ়ম-এর অর্থ কী? আজকের এই নিয়োলিবারাল দশায় ভারত সরকারের ভূমিকা কী হতে পারে? ‘বিপ্লব’ বলতেই বা কী বোঝায়? এই দুই লেখকের বিভিন্ন গবেষণায় উপরোক্ত প্রশ্নগুলির সুগভীর অনুসন্ধান দেখতে পাওয়া যায়।

রিথিঙ্কিং মার্ক্সিজ়ম: ইন্ডিয়া ফ্রম আ ক্লাস পার্সপেক্টিভ

অঞ্জন চক্রবর্তী, অনুপ ধর

১৪৯৫.০০

আকার বুকস

বইটির ভূমিকায় আমরা জানতে পারছি যে, এখানে তিনটি দিকের মধ্যে সংলাপ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে— এক, ক্লাস বা শ্রেণির ধারণা; দুই, ‘ওভারডিটারমিনেশন’ (আলথুসার)-এর ধারণা; এবং তিন, ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ। এর সঙ্গেই একটা মোক্ষম প্রশ্ন ওঁরা তুলেছেন যে, মার্ক্সের ক্যাপিটাল রচনার ক্ষেত্রে যেমন ব্রিটিশ রাজনৈতিক অর্থনীতি আর্কাইভ হিসাবে কাজ করেছে, তেমনই আজকের ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর জন্যে ক্যাপিটাল লিখতে হলে ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ কি আর্কাইভের ভূমিকা পালন করতে পারে? অর্থাৎ, এখানে ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ শুধু কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিত নয়, আর্কাইভ-ও বটে। কেন এবং কী ভাবে ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ গোটা ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর আর্কাইভ হয়ে উঠল, সে কথা বুঝতে গেলে এই বইয়ের প্রথম ভাগ পড়তে হবে।

আলোচ্য বইটি ছ’টি ভাগে বিভক্ত। প্রথমে রয়েছে: গৃহীত মার্ক্সবাদ পেরিয়ে; দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম— শ্রমিক শ্রেণি বলতে কি বোঝায়?; তৃতীয় পর্ব— কৃষি, অসংগঠিত শিল্প ও গ্রামীণ জীবনের বিনির্মাণ; চতুর্থ পর্ব হল পুনর্ভাবনায় ধনতান্ত্রিক উন্নয়ন; পঞ্চম পর্ব রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ; ষষ্ঠ পর্ব হল— উত্তর-ধনতান্ত্রিক রাজনীতি। বিষয়বৈচিত্র ও সার্বিকতায় এই গ্রন্থ সত্যিই অনন্য।

প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে মার্ক্সবাদের মূল তাত্ত্বিক বিষয়গুলি নিয়ে নতুন আঙ্গিক থেকে বিশদ আলোচনা। সেখানেই ক্লাস বা শ্রেণির ধারণা নিয়ে কথা এসেছে। শ্রেণির ধারণাকে মার্ক্সবাদ-চর্চার এই ঘরানায় আরোপিত ভাবে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত— এই ভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং শ্রেণির ধারণাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ‘সারপ্লাস’ বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও বণ্টনের সঙ্গে। ‘ক্লাস’ বা শ্রেণি এখানে দু’টি গোষ্ঠীর নামের অংশ নয় (যথা পুঁজিপতি শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি); শ্রেণি এখানে ‘প্রসেস’ বা প্রক্রিয়া— ‘সারপ্লাস’ বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও বণ্টনের প্রক্রিয়া। এবং এই ‘ক্লাস-প্রসেস’-এর উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আসছে— যেমন ধনতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি। দাসপ্রথা, সামন্তপ্রথা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, এ সবই শোষণমূলক উৎপাদন ব্যবস্থা, যেখানে একটি শ্রেণি উদ্বৃত্ত তৈরি করে ও আর একটি শ্রেণি সেই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে; এবং এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। অন্য দিকে, শোষণবিহীন উৎপাদন ব্যবস্থা হিসাবে ভাবা যায় সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে। ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ এক অর্থে আর্কাইভে পরিণত হয়েছে এর বিপুল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কারণে— ‘ক্লাস প্রসেস’ বা শ্রেণি প্রক্রিয়ার বিপুল বৈচিত্র। লেখকদ্বয়ের মতে, ভারতে একই সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক এবং এই মূলগত কাঠামোর মধ্যেও অনেক রকম ব্যবস্থা একই সময়ে বিদ্যমান। কেন একই সময়ে অনেক রকম বৈচিত্রে ভরা উৎপাদন-সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতে পারে, তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন লেখকরা। বৈচিত্র হল উৎপাদন ব্যবস্থার বৈচিত্র এবং ঐক্য হল মূলগত ভাবে শোষণের ঐক্য— অর্থাৎ প্রায় সব ক’টি উৎপাদন ব্যবস্থাতেই শোষণ বা ‘এক্সপ্লয়টেশন’ বর্তমান। বইটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ে কাজ করলে ক্লাস বা শ্রেণির প্রশ্নটিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।

মার্ক্সবাদ-চর্চার এই ধারায় বিপ্লব অর্থে কোনও পূর্বনির্ধারিত পথরেখা ধরে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র হয়ে সাম্যবাদে উন্নীত হওয়া নয়। বরং উৎপাদন সম্পর্ক ও ‘সারপ্লাস’ বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও বণ্টনে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ও ছোট ছোট পরিবর্তন। যেমন ক্ষুদ্র শিল্পে— যেখানে পরিবারের সবাই উৎপাদনে হাত লাগায়— সেখানে বাড়ির মহিলা শ্রমিকদের অবদান কি স্বীকার করা হচ্ছে? তাঁরাও কি মজুরি পাচ্ছেন? এখানেই শ্রেণি সংগ্রামের গুরুত্ব। নারীশ্রমকে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তাঁদেরকেও মজুরির আওতায় আনা, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বইয়ের নারীশ্রম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আমরা এই ধরনের আলোচনা খুঁজে পাই। ২০২৩ সালের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কারে যে নারীশ্রমের কথা এল সেই বিষয়ে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে এই বইতে। এ ছাড়াও এই বইতে স্থান পেয়েছে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা, যা কিনা অর্থনীতির গবেষণায় বড় একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। গৃহীত জাতীয়তাবাদের ধারণা এখানে প্রশ্নের সম্মুখীন, যা আজকের এই যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

এই বই কোনও ‘রেডিমেড’ উত্তরমালার মেড-ইজ়ি নয়, বরং এই বই প্রশ্ন তোলার আকর গ্রন্থ। এখানে ধনতন্ত্রের ধারণা, জাতীয়তাবাদ, উন্নয়নের ধারণা এমনকি মার্ক্সবাদের বিভিন্ন ধারণাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়। মার্ক্সবাদের এই ঘরানায় মার্ক্স–গান্ধী–রবীন্দ্রনাথ অবলীলায় কথোপকথনে বসতে পারেন। তাত্ত্বিক আলোচনা ও গবেষণার যে বিষয়ভিত্তিক খোপ রয়েছে, এই গ্রন্থ তার দেওয়াল ভাঙার আহ্বান জানায়। ফলত এই গ্রন্থের আবেদন গুঞ্জরিত হয় যে কোনও ‘ডিসিপ্লিনারি বাউন্ডারি’র বাইরেও। এই ধারা মেনে চলেই ধনতন্ত্র অতিক্রম করার যে রাজনীতি, সেই নিয়ে এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায় ‘গ্রাম আমাদের অতীত, না কি ভবিষ্যৎ’!

অন্য বিষয়গুলি:

book review Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy