কলেজ স্ট্রিটের একটি বইয়ের দোকান। —ফাইল চিত্র।
“অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা হোক বা অপেশাদারিত্বের অভ্যাস— বাংলা প্রকাশনায় আজও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যোগ্য কপি এডিটর অথবা কনটেন্ট এডিটর-এর কোনও অস্তিত্ব থাকে না।” পুস্তানি পেরিয়ে বইয়ে এই মন্তব্য সুস্নাত চৌধুরীর। বাংলা মুদ্রণের নানা দিক নিয়ে তাঁর অনেক দিনের চিন্তাভাবনা, বোধশব্দ এবং বিশেষ করে হরফচর্চা পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বাংলা প্রকাশনার ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে লেখক পাঠক প্রকাশক সবাইকেই এমন অনেক বিষয়ে সচেতন করতে চান যা হয় আমরা আদৌ জানি না, অথবা জানলেও মাথা ঘামাতে চাই না। উদ্ধৃত মন্তব্যটি দ্বিতীয় পর্যায়ের ইঙ্গিতবাহী। লেখকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুদ্রণযোগ্য কপি তৈরি করে দেন না, অনেকে জানেনও না কী ভাবে তা করতে হয়। প্রকাশক এক দিকে তাড়াতাড়ি বই ছেপে বিনিয়োগ উসুল করে লাভ ঘরে তুলতে চান, একটা বই নিয়ে অনেক দিন বসে থাকা সম্ভব নয়; অন্য দিকে খরচ অনেকটা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। পাঠক গাঁটের কড়ি দিয়ে সেই বই কেনেন, কারণ তাঁর সামনে কোনও বিকল্প নেই। সব জেনেও সবাই চুপ। লেখক সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলেছেন, প্রকাশ্যে এই চেতাবনি জরুরি ছিল।
শুধু এটাই নয়। তাঁর বইটি, ঘোষিত ভাবেই, ‘বই নিয়ে একটি বই’। তিনটি পর্বে ৩৮টি ছোট ছোট লেখা, অল্প দিন আগেই সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত প্রকাশিত, ‘ঈষৎ পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে’ এই বইতে স্থান পেয়েছে। সংবাদপত্রের প্রয়োজনেই লেখাগুলি মিতায়তন, কিন্তু তার অধিকাংশই বারুদ-ঠাসা, সুযোগ পেলেই বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। বইটির প্রকাশক পর্যন্ত তাঁর ‘প্রকাশকথা’য় স্পষ্টই স্বীকার করেছেন, “লেখক এই যেপ্রকাশকদের অপেশাদারিত্বকে চিহ্নিত করেছেন— তা মোটামুটি সার্বিক, এবং এক কটু সত্যি।”
পুস্তানি পেরিয়ে
সুস্নাত চৌধুরী
৪৫০.০০
প্রতিক্ষণ
নতুন প্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে গিয়ে প্রকাশকরা আরও বিপদ ডেকে এনেছেন। আগের মতো অফসেটে হাজার কপি বই ছেপে বাঁধাইখানায় ফর্মা রেখে দিয়ে চাহিদামতো বাঁধিয়ে ব্যবসা করার দিন চলে গেছে। কাগজের আকাশছোঁয়া দাম, এক চিলতে জায়গার জন্য বিপুল ভাড়া গোনা ইত্যাদি তার অনেক কারণ। এখন প্রকাশকরা ঝুঁকেছেন পিওডি বা ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’-এর দিকে। ছেপে নিচ্ছেন পঞ্চাশ কি একশো কপি বই, কপি-পিছু সামান্য বেশি খরচ পড়লেও অন্য অনেক ঝক্কি কম। কাটতি হলে আবার অল্প ছাপতে অসুবিধা নেই। বিনিয়োগ কম, রাখতে জায়গার সমস্যা কম, ছোট প্রকাশনার পক্ষে আদর্শ। প্রথম মুদ্রণে ভুল থেকে গেলে শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকছে।
আর সমস্যা দানা বাঁধছে এখানেই। বই কত বার ছাপা হচ্ছে, তার কী সংশোধন হচ্ছে, সে সবের কোনও প্রমাণ থাকছে না— সবই প্রথম মুদ্রণের কপি হিসাবে গণ্য হচ্ছে। লেখক যথার্থ দেখিয়েছেন, এক দিকে একই আইএসবিএন দিয়ে এ ভাবে যদি অঘোষিত সংস্করণ প্রকাশিত হতে থাকে, তা হলে ভবিষ্যতে পাঠক-গবেষকরা অশেষ বিভ্রান্তিতে পড়বেন; আর অন্য দিকে প্রতারিত হচ্ছেন সেই পাঠক, যিনি একটি ভাল বই প্রকাশিত হলেই সংগ্রহ করছেন, বা প্রি-বুকিং করে বইটির প্রকাশে সাহায্য করছেন— সংশোধিত পরবর্তী মুদ্রণ তো তাঁকে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে না!
নতুন প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে এমন অনেক কাজ হয়ে চলেছে, যা সার্বিক ভাবে প্রকাশনার গুণমানকেই প্রভাবিত করছে। লেখক দেখিয়েছেন, ক্রিস্টোফার হার্স্ট যে গ্রন্থনির্মাণকে ‘ইনভিজ়িবল আর্ট’ আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘সামঞ্জস্যহীন জগঝম্প সংস্করণের প্রকটতা’য় আজ তা একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে। ইউনিকোডে নানা হরফের সহজপ্রাপ্যতা ভুলিয়ে দিয়েছে কোথায় কোন টাইপফেস ব্যবহার করা উচিত, সেই মাত্রাজ্ঞান। বাঁধাই, প্রচ্ছদ, ই-বই, বাংলা বইয়ের দাম, ‘ভ্যানিটি পাবলিশিং’ বা লেখকের অর্থায়নে বই-প্রকাশ, দোকানে বই সাজানোর তরিকা, পাণ্ডুলিপি নির্মাণ, কপিরাইট— এমনই সব জরুরি বিষয়ে আলোচনা এবং প্রশ্ন জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি বই-জগতের নানা টুকরো খবরও সুস্নাত চৌধুরীর এই বইটিকে অবশ্যপাঠ্য করে তুলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy