রাজভবনের সামনের ফুটপাথে সংসার মা-ছেলের। —নিজস্ব চিত্র।
সবে তিন বছরে পা দিয়েছে। ২৪ নভেম্বর ছিল তার তৃতীয় জন্মদিন। তবে এর মধ্যেই ইংরেজিতে শরীরের সব প্রত্যঙ্গের নাম বলতে পারে কলকাতার কৃষ্ণ। তারা ভিখারিনি মা পথচারীদের কাছে হাত পাতার মাঝেই নজর রাখেন, ‘গোরি’ দুষ্টুমি করে পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে না তো? ভাল নাম কিষাণ দাস হলেও মা আদর করে ‘গোরি’ বলেই ডাকেন। স্বপ্নও দেখান। গোরি দু’হাত আকাশের দিকে তুলে বলে, ‘‘গলিবেল ডাক্তাল হব।’’ আধো উচ্চারণের আড়াল পেরিয়ে বোঝা যায়, তিন বছরের শিশু বলছে, সে গরিবের ডাক্তার হবে।
রাজভবনের কালো রেলিংয়ের সামনের ফুটপাথে ধুলোয় আসন পেতে গোরি দুলে দুলে পড়ে, ‘‘এ ফর অ্যাপল, বি ফর বল... ই ফর এলিফ্যান্ট।’’ আপেল, বল দেখলেও নিজের চোখে হাতি দেখেনি গোরি। তার মা মিনতি দাস বললেন, ‘‘ছুটির দিনে তো এ পাড়ায় ভিক্ষা মেলে না। এ বার একটা ছুটির দিন দেখে গোরিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব। এলিফ্যান্টের সঙ্গে পিকক, লায়ন, টাইগার সব দেখিয়ে আনব।’’
রাজভবনের উত্তর দিকের গেট পার হয়েই গোরির পড়ার ‘ঘর’। দূর থেকে দেখা যায় ফুটপাথের সংসারে মা-ছেলের পড়াশোনা। কাছে গেলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যাঁরা খেয়াল করেন না, তাঁরা পড়ার ঘর দিয়েই জুতো পরে গট গট করে চলে যান। কেউ কেউ অবশ্য থমকে দাঁড়ান। এক টাকা, দু’টাকার কয়েন থেকে দশ বা কুড়ির নোট ফেলে দেন ভিক্ষাপাত্রে। ছেলেকে পড়ানোর সময়েও সেই পাত্রের দিকে নজর থাকে মিনতির। স্বপ্ন কিনতে তো পয়সা লাগবেই। মিনতির কথায়, ‘‘ছোট থেকেই ছেলেটা ডাক্তার হতে চায়। আমি বলেছি, ডাক্তার হতে হলে কিন্তু গরিবের ডাক্তার হতে হবে। গরিব মানুষের থেকে পয়সা নেওয়া যাবে না। আমি লোকের কাছে হাত পেতে তোমায় মানুষ করছি। কিন্তু তুমি গরিব মানুষের সামনে হাত পাততে পারবে না।’’
মিনতি নিজে খুব একটা লেখাপড়া করতে পারেননি। বজবজের কাছে চটকলে কাজ করতেন তাঁর বাবা। দুই পুত্র, তিন কন্যার কাউকেই বেশি পড়াতে পারেননি। বিয়ের পরেও খুব স্বচ্ছল সংসারও হয়নি। স্বামী ময়দানের একটি ক্লাবে মালির কাজ করেন। সেখানেই খাওয়া-থাকা। বিয়ের পর বুঝতে পারেন, তাঁকেও কিছু একটা করতে হবে। টুকটাক কাজের পরে দেখেছেন সবচেয়ে ভাল আয় ভিক্ষায়। সুতরাং সেটাই তাঁর পেশা হয়ে গিয়েছে। ঘড়ি ধরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ‘ডিউটি’। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ। দুপুরে এক ফাঁকে মুড়ি-ঘুগনি খেয়ে নেওয়া চায়ের দোকানে। সকালে ছেলে স্কুলেই থাকে। রাস্তার ঠিক উল্টো পারেই রাজভবন প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন কিষাণকে। ছেলের খাওয়াদাওয়া সেখানেই হয়ে যায়।
মিনতির একটা ঘর আছে। গঙ্গার পারে ঝুপড়ি। রাতে সেখানে ফিরে গিয়ে চাল-ডাল ফুটিয়ে নেন। তবে তার আগে একটা কাজ আছে। পাশের চায়ের দোকানের বাসন মেজে দিতে হয়। রোজ নগদ ৭০ টাকা। সেই টাকা আর ভিক্ষার ধন মিলিয়ে মাসের রোজগার মন্দ নয়। তবে টাকার অঙ্কটা লিখতে বারণ করলেন। নজর লেগে যেতে পারে! পাছে জানাজানি হয়ে যায়, তাই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ পেতেও আবেদন করেননি। মিনতির রোজগার কিন্তু স্বামী সুকুমারের চেয়ে ঢের বেশি। জমানো টাকায় স্বামীকে একটা চায়ের দোকান করে দিতে চান মিনতি। তাতে ভিক্ষার পাট উঠে যাবে। দু’জনে মিলে দোকান চালিয়ে গোছানো যাবে সংসার আর এগোনো যাবে ছেলেকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন। তবে সুকুমার চান ফলের দোকান। মিনতির ভিক্ষার কারবার যেমন চলছে তেমনই চলবে। ফি-শুক্রবার সুকুমার আসেন ঝুপড়ির ঘরে। তখন এ সব নিয়ে আলোচনা হয়। ঝগড়াও লাগে। তার মধ্যেই গোরি পেয়ে যায় বাবার সপ্তাহান্তের আদর। মাঝেমাঝে লজেন্সও।
পড়ার বইয়ে গোরির সবচেয়ে ভাল লাগে ‘সি ফর কার’-এর ছবি দেখতে। রাস্তার ও পারেই রেজিস্ট্রি অফিস। গোটা দিন ভিড় লেগে থাকে। অনেকেই সময় কাটাতে চলে আসেন রাজভবনের ছায়াঘেরা ফুটপাথে। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসাও যায়। ওঁরা টাকা দেন মিনতিকে। মাঝেমাঝে রাস্তা পার হয়ে ও পারেও চলে যান মিনতি। মিনারেল ওয়াটারের ফেলে দেওয়া বোতল কুড়িয়ে জমা করে রাখেন। দিনের শেষে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। শুনেছেন, মল্লিকবাজারে নাকি ২৫ টাকা দর। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে অতটা দূরে যাওয়া মুশকিল। রোজগার বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা জানাতে জানাতেই মিনতি বলছিলেন, ‘‘ছেলেটাকে বড় করতেই হবে। টাকা চাই। জমাচ্ছি। আরও রোজগার করতে হবে। তবে সে সব করতে গিয়ে ওকে পড়ানো কমিয়ে দিলে হবে না। ওকে পড়াই বলে অনেক দাদা-দিদি আমাকে বেশি ভিক্ষা দেয়। ওর খোঁজও নেয়।’’
তবে একটা ভয় কাজ করে মিনতির। রাস্তা পার হয়ে বোতল কুড়োনোর সময়েও নজর থাকে সংসার সাজানো ফুটপাথে। গোরিকে কেউ তুলে নিয়ে চলে যায় যদি! তবে গোরি খুবই বাধ্য। বই বা খেলনা নিয়ে একলা বসে থাকে। কেউ কিছু দিতে চাইলেও নেয় না। বেগতিক বুঝলেই ‘মা-আ-আ’ বলে হাঁক দেয়। বলতে বলতে সিঁথিতে মেটে সিঁদুর মাখানো কিষাণ-জননীর মুখে একগাল হাসি। যে হাসি আলো ছড়াচ্ছিল রাজভবনের ফুটপাথে। তার পরে ক্রমশ রেলিং পার হয়ে বড়লাটের বাগানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy