Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

স্মৃতি নির্মাণের রাজনীতি

স্বাধিকারের দাবি যদি না-তুলতেই নস্যাৎ হয়ে যায়, তা হলে ভোটার কার্ড-আধার থাকলেই বা কী?

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৫:৫৯
Share: Save:

স্বাধীনতার সাত দশক পরে দেশ ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছে একই প্রশ্নের সামনে— কে নাগরিক আর কে নয়, তা কি ঠিক হবে ধর্ম দিয়ে? নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশ তোলপাড় হওয়ার কিছু আগেই বেরিয়েছে বইটি, তবু সিঁদুরে মেঘ এর ছত্রে ছত্রে। নাগরিকত্ব হারালে কী হয় মানুষের অবস্থা, বহু দেশ থেকে গবেষকেরা আহরণ করেছেন সেই তথ্য। তাঁদের সূত্র কখনও আত্মকথন, কখনও স্মৃতি-আশ্রয়ী সাহিত্য, কখনও সমাজ আন্দোলনের দলিল। নানা প্রবন্ধে, বয়ানে উঠে আসে এই কথা যে, ভিটেমাটি, পরিচিত মানবমণ্ডল ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে অসীম কষ্টের পর যদি বা দু’-চারটে বৈধ কাগজ পায় উদ্বাস্তুরা, পূর্ণ নাগরিকত্ব জোটা দুঃসাধ্য। বিশেষত দরিদ্র, মহিলা, নিম্নবর্ণ বা ভিন্‌ধর্মের মানুষদের। জমির পাট্টা, ভোটার কার্ড হাতে নিয়েও তারা বাহিরে-অন্তরে রিফিউজি কলোনির স্থায়ী বাসিন্দা থাকে আজীবন।

আর মর্যাদা, স্বাধিকারের দাবি যদি না-তুলতেই নস্যাৎ হয়ে যায়, তা হলে ভোটার কার্ড-আধার থাকলেই বা কী? নাগরিক তখন রাষ্ট্রের কাছে নিজের মূল্য প্রতিষ্ঠা করতে আত্মহত্যাও করতে পারে। মণিপুরে ইরোম চানু শর্মিলার দীর্ঘ অনশন তো তা-ই। কিন্তু স্তরের নীচে আছে স্তর। কেরলের রবার বাগিচায় কর্মরত দলিতরা জমির অধিকার নিয়ে লড়াই করতে নামল। একটি মেয়েকে আন্দোলনের নেতা ডেকে বলল, “তোমার সঙ্গে পেট্রল-কেরোসিন থাকবে, পুলিশ এলে গায়ে ঢেলে দেবে, আর এক জন আগুন দেবে। তোমার সন্তানকে আমরা দেখব।” মেয়েটিকে যে সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হল না, কেবল নির্দেশ দেওয়া হল, এই অপমান সে ভালই টের পেয়েছিল। দলিত আন্দোলনের প্রচলিত বিবরণে এই সব বয়ান পাওয়া যায় না সহজে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাওয়া যায় না বাঙালিদের দ্বারা ধর্ষিত উর্দুভাষী ‘বিহারি’ মহিলাদের বয়ান।

স্মৃতি ইতিহাস নয়, অথচ ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে অবদমিতের স্মৃতির শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ব্যক্তির স্মৃতি, আর প্রচলিত ইতিহাসের বক্তব্য, এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে কথিত ইতিহাস (ওরাল হিস্ট্রি), যা এই বইয়ের অনেকটা জুড়ে রয়েছে। জার্মানিতে ‘হলোকস্ট’ হওয়ার আগে আফ্রিকার উপনিবেশে ব্যাপক গণহত্যা করেছিল জার্মানরা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প অবধি বানিয়েছিল, সে সাক্ষ্য উঠে আসে প্রজন্মবাহিত স্মৃতি থেকেই।

ডিসপ্লেসমেন্ট অ্যান্ড সিটিজ়েনশিপ: হিস্ট্রিজ় অ্যান্ড মেমরিজ় অব এক্সক্লুশন
সম্পা: বিজয়া রাও, শাম্ভবী প্রকাশ, মল্লারিকা সিংহরায় ও পাপড়ি বেরা
৯০০.০০
তুলিকা

হাতের কাছেও এমন নজির কি নেই? এক সময় হাসাহাসি হত, পুব বাংলায় সবারই নাকি প্রচুর জমি-পুকুর-বাগান ছিল। এর সত্যতা যা-ই হোক, উদ্দেশ্য হল উদ্বাস্তু বাঙালির ‘ভদ্রলোক’ পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা, যাতে নাগরিকের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধের দাবি উপেক্ষিত না হয়। সেই শক্তিশালী বয়ানে চাপা পড়ে গিয়েছে দলিত-উদ্বাস্তুর বয়ান, যারা ‘দ্যাশ’-এও দিন কাটিয়েছে শাসন-শোষণের দুঃখে। কেবল ধর্মনাশ-প্রাণনাশ নয়, পদ্মার ভাঙনে জমি হারিয়েও অনেকে এসেছে এ পারে। যেমন আসছে আজও, জীবিকার সন্ধানে।

যে পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকেন, যাঁকে উৎখাত করেছে উন্নয়নের প্রকল্প, যিনি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, তাঁদের সবার মনে ‘দেশ’ একটি রূপকল্প। অনেকের ক্ষেত্রে তা বহু প্রজন্মবাহিত একটি ধারণা। তাদের পূর্বপুরুষ হয়তো এসেছিল দাস, বা জাহাজ-বাহিত শ্রমিক হয়ে। ভারত, বাংলাদেশ, পেরু, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নামিবিয়া— এমন নানা দেশে মানুষের স্মৃতিতে বাস করছে যে দেশ, তা যত না ভৌগোলিক তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। সাহিত্য, মানববিদ্যা, সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে তাকে দেখেছেন এই বইয়ের লেখকেরা। ‘দেশ-ঘর’ কেমন, তা না বুঝলে ‘নাগরিকত্ব’কে বোঝা যায় না। কোন স্মৃতি মান্যতা পাবে, কোনগুলো বাতিল হবে, তার রাজনীতি দিয়ে তৈরি হয় সে সব অর্থ।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy