ব্যতিক্রমী: ভালোমানুষ নাটকে কেয়া চক্রবর্তী
নারীবাদী ইতিহাসচর্চা নারীকে শুধু দৃষ্টিগোচর নয়, শ্রবণগোচরও করে তুলতে চাইছে, যদিও নারীকণ্ঠের বেশির ভাগটাই বলা যায় ‘সাবসোনিক’। আলোচ্য বইটি এমনই এক উদ্ধার-প্রচেষ্টা। গণনাট্য সঙ্ঘ ভেঙে, সঙ্ঘেরই আদর্শ বহন করে বাংলায় স্বাধীনতার পর পরই যে গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম, তার লিঙ্গ-রাজনীতি বইটির বিষয়বস্তু। থিয়েটারে নারীকর্মী আর নারীচরিত্রের উপস্থাপনা, দুটো মিলিয়েই ইতিহাসটা রচিত হয়েছে। সে ইতিহাস আবার বোনা হয়েছে দেশ-কালের বৃহত্তর ইতিহাসের সঙ্গে। গ্রুপ থিয়েটারে লিঙ্গবৈষম্য ব্যাপারটাকে র্যাডিক্যাল রাজনীতির সামগ্রিক ব্যর্থতার অংশ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
বইয়ের সূচনা অন্তিম-ঔপনিবেশিক যুগে কমিউনিস্ট উদ্যোগে গঠিত গণনাট্য সঙ্ঘকে দিয়েই। এক মহান মিশনের কর্মী হিসেবে সেখানে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়েছিল, তাঁদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে ভাবনা ছিল না, প্রত্যাশা ছিল অভিনেত্রী-দেহোপজীবিনীর প্রচলিত সমীকরণ খণ্ডন করে তাঁরা ভদ্রমহিলাসুলভ মর্যাদা বজায় রাখবেন। সঙ্ঘের প্রথম সাধারণ সম্পাদক অনিল ডি সিলভা প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি, তাঁর আচার-আচরণে যৌন ভ্রষ্টতা দেখেছিলেন নেতারা। ফলে সেই দক্ষ সংগঠককে কোনও কারণ না দেখিয়েই অপসারণ করা হয়, সঙ্ঘের ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলা হয়।
এর পর গ্রুপ থিয়েটার। পিতৃসম পরিচালককে ঘিরে এক-একটি দল যেন এক-একটি পরিবার। পটভূমিতে নবগঠিত পিতৃতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের উপস্থিতি। তদনুযায়ী জাতিগঠনের কাজে নারী নাট্যকর্মীর ভূমিকা। বহুরূপী-র তৃপ্তি মিত্রর মতো কেউ কেউ ‘সহচরী স্ত্রী’, উনিশ শতক থেকেই যার কাছে প্রত্যাশিত স্বামীর প্রতি বাধ্যতা। তফাত হল এই, নাটকের তথা দেশের কাজে তাঁকে নিজের সন্তানকেও অবহেলা করতে হতে পারে, কিন্তু স্বামীর গড়া নাট্যপরিবারটির সেবায় আপ্রাণ নিয়োজিত থাকতে হবে। এক জন নারীর গৃহকর্ম যেমন মূল্যহীন, তেমনই এই বাইরের কাজেরও কোনও মূল্য তিনি দাবি করতে পারবেন না। নারীকর্মীরাও মেনে নেন এই আত্মনিবেদনকারী অধস্তনতা। আর বহুরূপী-র যে নাটকে সরাসরি নারীর আত্মানুসন্ধান, সেই পুতুল খেলা-র শেষ দৃশ্যে ইবসেনের মূল নাটকের মতোই বুলু গৃহত্যাগ করে বটে, কিন্তু বহুরূপী-র মঞ্চ-উপস্থাপনায় আলোকসম্পাতের কৌশলে তার স্বামীর একাকিত্বের বেদনাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। বুলুর বিদ্রোহ চাপা পড়ে যায়।
আসলে বাড়ি ছেড়ে বুলু কোন গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করবে, তা তখনও কল্পনায় আসেনি। সেটা অনেকটা এল নান্দীকার-এ কেয়া চক্রবর্তীর ভূমিকায়। তিনি খুব ব্যতিক্রমী ভাবে মননে, পরিকল্পনায়, সাংগঠনিক উদ্যোগে অভিনেত্রীর চেয়ে অনেক বেশি কিছু হয়ে উঠেছিলেন। তবু তিনিও দলটিকে পরিবার বলেই গণ্য করতেন, সেখানে শ্রমদানকে ভালবাসারই অনুষঙ্গ ভাবতেন। তার জন্য এমনকি অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর্থিক অসাচ্ছল্য বরণ করেন। ফল অবশ্য হতাশা, বাঁচার তাগিদে বাণিজ্যিক থিয়েটারে অভিনয়, শেষে অকালমৃত্যু। তাঁর লেখালিখিতে কিন্তু নারীর দেহ আর দৈহিক শ্রমের শোষণ নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ। নারীর নিজস্ব বিকাশ যে কী ভাবে হারিয়ে যায় বিপুল পারিবারিক চাপে, সে ব্যাপারে তাঁর সচেতনতা ১৯৭০-এর দশকের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’-র নারীবাদীদের ‘দ্য পার্সোনাল ইজ় পলিটিক্যাল’ মনে করিয়ে দেয়। সমাজ-শালীনতার তোয়াক্কা না করে নিজের ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম নিয়েও তিনি সর্বসমক্ষে অকপট।
পারফর্মিং সাইলেন্স: উইমেন ইন দ্য গ্রুপ থিয়েটার মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল
তৃণা নিলীনা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
ইতিমধ্যে, ১৯৬০-এর দশক থেকেই, চতুর্দিকে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে মোহভঙ্গ, উত্তাল প্রতিবাদ, নকশাল আন্দোলন, তার পর ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা। উৎপল দত্তের নাটকে (কল্লোল, তীর) প্রতিবাদী আন্দোলনের উপস্থাপনা জাতীয়তাবাদী প্রতর্কের আত্মসংযমী, তপোব্রতী পৌরুষের ধারণাকেও যেমন প্রশ্ন করে, তেমনই সতীত্ব থেকে নারীর বিচ্যুতিরও ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে; এমনকি নারীকে করে তোলে তেজস্বিনী নেত্রী। কিন্তু গৌরবময় বিপ্লবের অভ্যন্তরেই নারী-নিপীড়ন ঘটলে সেটাকে গোঁজামিল দিয়ে মেলাতে হয়। আর নাটকে রাষ্ট্র নিয়ে মোহমুক্তির অভিব্যক্তি এক দিকে যদি নারীকে বিপ্লবী বানায়, বিপরীত মেরুর অভিব্যক্তি শম্ভু মিত্রের চাঁদ বণিকের পালা, যেখানে নারী নেত্রী-আরোপিত ইমার্জেন্সির পরিপ্রেক্ষিতে নারীশক্তি কর্তৃত্ববাদী, অত্যাচারী ও ধংসাত্মক, যার কাছে পরাভূত পৌরুষমাহাত্ম্য।
কিন্তু ইমার্জেন্সির সময়ে নান্দীকার-এর আন্তিগোনে-র নামচরিত্র আর তার রূপকার কেয়া চক্রবর্তীর স্পষ্ট প্রতিবাদ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে, আর তা যেন পুরুষ রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নারীবাদী প্রতিবাদ। সোফোক্লিস আর জঁ আনুই-এর আন্তিগোনে-কে পাশাপাশি রেখে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে দু’টিকে মিলিয়ে কিন্তু প্রধানত দ্বিতীয়টি অবলম্বনে নান্দীকার-এর নাটকটি রচিত হয়। আনুই-এর নাটকে ক্রিয়ন তথা রাষ্ট্রের সুবিন্যস্ত শৃঙ্খলা আর আন্তিগোনের প্রতিবাদের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা ছিল, হয়তো জার্মান-অধিকৃত প্যারিসে সেন্সরকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। আনুই-এর আন্তিগোনের প্রতিবাদ তাই অযৌক্তিক, অর্থহীন, অকার্যকর মনে হয়। নান্দীকারের নাটকটিতেও প্রতিবাদ হয়তো অকার্যকর, কিন্তু তা এক গভীর অর্থ পায়। যে ভাবে আন্তিগোনে নীরবতার বদলে মৃত্যুকে বেছে নেয়, নিজের দেহ, দৈহিক যন্ত্রণা ও মৃত্যুর মাধ্যমে নিজের ‘এজেন্সি’ ঘোষণা করে, তার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিয়ন ভয় পায়, নৈতিক ভাবে পরাজিত হয়।
একে তো গ্রুপ থিয়েটারের নারীকর্মীদের ইতিহাসের লটবহর বইতে হয়, তার উপর তাঁরা এমন এক থিয়েটার আন্দোলনের শামিল যার কোনও শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই; সেই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ভারটাও নারীদেরই বইতে হয় বেশি করে। অবশ্য ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে ‘আমাদেরই সরকার’-এর কাছ থেকে সাহায্য নিতে আর তেমন দ্বিধা রইল না। এর পর থেকে নানা ভাবেই গ্রুপ থিয়েটারের চরিত্র বদলে যেতে থাকে। সেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে।
এই যে বক্তব্যের কাঠামোটা মোটা দাগে পরিবেশিত হল এর মধ্যে কিন্তু আছে অনেক মেহনত— মিশ্র পদ্ধতিতন্ত্রের প্রয়োজনে প্রচুর পড়াশোনা, তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া, সূক্ষ্ম যুক্তিতর্ক। আর আছে অন্তঃসলিলা জীবনোপলব্ধি: নিজের নাট্যকর্মী মায়ের (অনেকটা নাট্যকর্মী বাবার, আর নিজেরও) জীবনকে বোঝার তাগিদ। বিদ্যায়তনিক কাজটিকে এ বাড়তি মাত্রা ও উৎকর্ষ এনে দিয়েছে।
লিঙ্গ-রাজনীতির চমৎকার বিশ্লেষণ। সামগ্রিক ভাবে র্যাডিক্যাল রাজনীতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে বটে, কিন্তু সেই অনুসন্ধান যথেষ্ট এগোল না। অ-বিশ্লেষিত থাকল মধ্যশ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বচিন্তার দুর্বলতা— কিছু ধার-করা তত্ত্বের উপরভাসা চর্চা, তত্ত্বের নামে অযথা অন্তঃকলহ, নিজেদের তত্ত্বে নিজেরাই অদৃশ্য থাকা, বিপ্লবের অনিবার্যতা ও সর্বজ্বরহর চরিত্রে অগাধ বিশ্বাস, সহজে সমঝোতা, আর ক্ষমতাভোগেই পরিতৃপ্তি। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি খুবই সত্যি— কমিউনিজ়ম যেন ‘ম্যাজিক পিল’ যা গিলে বাঙালি নিজের প্রগতিশীল আত্মপরিচয় বজায় রাখে (বইয়েই উদ্ধৃত)। উৎপল দত্ত, যাঁকে খুবই র্যাডিক্যাল নাট্যপরিচালক হিসেবে দেখানো হয়েছে, তাঁরও বিপ্লবচিন্তা কি অতিসরলীকৃত নয়? তিনিও কি সমঝোতা করেননি? নান্দনিক চর্চাতে স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। রোমাঁ রোলাঁর থেকে ‘পিপল’স থিয়েটার’ শব্দবন্ধ ধার নিলেও থিয়েটারের অর্থনৈতিক ভিত্তি পাকা করার জন্য রোলাঁর প্রস্তাব— অল্প দামে টিকিট বিক্রি করে শ্রমিকদের নিয়মিত ভাবে আকৃষ্ট করা— আইপিটিএ উপেক্ষা করে। অনেক পরে নান্দীকার-এর ভালোমানুষ-এর ক্ষেত্রে এমন একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল, যার উল্লেখ অবশ্য বইয়ে আছে। সমাজের পরিস্থিতি যখন বিপ্লবের অনুকূল নয়, তখন কেমন হতে পারে সমাজপরিবর্তনকামী শিল্পী-সাহিত্যিকের পথ, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা আছে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের কাজে। এ দেশে সে রকম চিন্তাভাবনা হয়েছে কি? তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো প্রচলিত ব্যবস্থাকে জোর গলায় ‘না’ বলাতেই শিল্পের বৈপ্লবিক মাহাত্ম্য— আন্তিগোনে আর কেয়া সম্পর্কে যে কথাটা লেখক জোর দিয়ে বলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy