নিজেকে নিজের দান/ রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার গল্প
সোমেশ্বর ভৌমিক
৪০০.০০
প্রতিক্ষণ
‘জগৎটা আকারের মহাযাত্রা,’ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। এই উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল ছবি আঁকা শুরু করার পর। যে মন কান পেতে থাকত, আকাশ, বাতাসে ভেসে-আসা সুর আর কথা শুনতে পেত, প্রায় বার্ধক্য ছুঁয়ে তা চোখ মেলল রূপের রাজ্যে, রেখার ভিড়ে। যামিনী রায়কেও লিখেছেন, ছবি আঁকা শুরু করার পর ‘দৃষ্টির সহযাত্রার মধ্যে মন স্থান পেল।’ এই দৃষ্টি আটপৌরে জীবনের দেখা তো নয়। ‘গাছপালার দিকে তাকাই, তাদের অত্যন্ত দেখতে পাই।’ এমন ‘অত্যন্ত দেখা’-র প্রকাশ যে ছবিগুলোতে, সে সব যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কতখানি জুড়ে আছে, সেটা প্রায়ই আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। যেখানে সাড়ে ছয় দশকে তিনি লিখেছেন আড়াই হাজার গান, সেখানে মাত্র দশ বছরে এঁকেছেন প্রায় দু’হাজার ছবি।
রবীন্দ্রনাথের কিছু ছবি দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু অধিকাংশই সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণার ধার ধারেনি। তিনি নিজেই লিখেছেন, যখন তাঁর ছবি বেশ সুন্দর হয়েছে বলে মনে হয়, তখন তিনি কালি ঢেলে, বা এলোমেলো আঁচড়ে তাকে নষ্ট করে দেন। তারপর তাকে উদ্ধার করেন। সৌন্দর্য বস্তুর বাইরের উপাদান নয়, ভিতরের গুণ। তাকে বুঝতে হলে চোখের দৃষ্টির সঙ্গে চাই মনের দৃষ্টি। এ কথাটা যেমন তাঁর ‘রাজা,’ ‘অরূপরতন,’ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে রয়েছে, তেমনই রয়েছে তাঁর ছবিতে। সেই সূত্র ধরিয়ে দিতে অনেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে কলম ধরেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর চিত্রকলার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবির কথা লিখেছেন পূর্ণেন্দু পত্রী, সত্যজিৎ চৌধুরী, শানু লাহিড়ি, রতন পারিমু, মৃণাল ঘোষের মতো অনেকে। প্রধানত শিল্প সমঝদারের দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র ছবির সঙ্কলন ‘রবীন্দ্র চিত্রাবলী’-র সম্পাদক আর শিবকুমারের লেখা ভূমিকা, চিত্র-পরিচয়, ‘ক্যাটালগ’-ও অতি মূল্যবান।
‘নিজেকে নিজের দান’ বইটি সে দলে পড়ে না। সোমেশ্বর ভৌমিক গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর ভূমিকা শিল্প-সমালোচকের নয়, জিজ্ঞাসু দর্শকের। বইয়ের উপশীর্ষক বলছে, ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার গল্প।’ ঠিক প্রচলিত অর্থে ‘গল্প’ নয়। একটা ছবি যখন আঁকা চলছে, সে সময়ে কী ঘটছে বৃহত্তর বিশ্বে আর রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিনের জগতে, নিজের মনের কোন অবস্থার কথা জানাচ্ছেন চিঠিতে, লিখছেন কোন কবিতা-গান-প্রবন্ধ, সে সব মিলিয়ে দেখলে তৈরি হয় ছবির যে আখ্যানপট, এ হল তাই। সেখানে সাযুজ্য বা ‘সেতুবন্ধন’ যেমন আছে, তেমনই আছে অসামঞ্জস্য।
যেমন, ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গুরুতর অসুস্থতার পর রবীন্দ্রনাথের একের পর এক কবিতায় (‘প্রান্তিক’-এ সঙ্কলিত) স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় মৃত্যুর ঘন ছায়া। একই সময়ে আঁকা ছবি কিন্তু ‘সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সৃষ্টি’। নিসর্গদৃশ্যে উজ্জ্বল রং, আয়তনেত্র নারীর মুখাবয়বের পশ্চাৎপটে হলুদ, কমলা। তৈরি হচ্ছে এক অন্য মনোজগৎ, যেখানে আনন্দরূপের উদ্ভাস। ছবি আঁকা যেন তাঁর আত্ম-শুশ্রূষা, উত্তরণের অবলম্বন। রবীন্দ্রনাথের রূপসাধনার যে অবিশ্বাস্য ব্যাপ্তি, এ বই তার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy