Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

যিনি কাঁদান, তিনি ভাবাতেও পারেন

সতীত্বের এই অসারত্ব তাঁর প্রবন্ধে (১৩০৯) লেখার পরেও তিনি শ্রীকান্ত-র অন্নদাদিদির মতো চরিত্র এঁকেছিলেন, বিধবার স্বল্পাহার ও কঠোর আত্মসংযমের সপ্রশংস বিবরণ দিয়েছেন।

অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:০৮
Share: Save:

“তিনি শুধু কাঁদাতে পারেন, ভাবাতে পারেন না”— শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে এই নালিশ, বইয়ের ভূমিকার গোড়াতেই যার দেখা মেলে, তা বড়ই পরিচিত। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসের হাত ধরে চোখের জলে ভেসে সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখা, আবার সে তল্লাটে চলাচল একটু বাড়লেই তাঁর সাবেকিয়ানায় বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরানো— এই পরিচিত পথে পাঠক হেঁটে চলেছে বহু প্রজন্ম। জনপ্রিয়তায় তিনি অতুলনীয়, কিন্তু সেটাই আবার তাঁর সঙ্কট হয়েও এসেছে— স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন, “তোমার এখনকার লেখা পড়তে ভয় হয়, পাছে চোখে পড়ে যে, তোমার কলমের উপরে তোমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ভিড়ের লোকের মনটা ভর করছে।” যে কোনও মনোযোগী পাঠকই অনুভব করতে পারেন, গ্রামজীবনের প্রখর বাস্তবের উপর জনমোহিনী রোম্যান্সের প্রলেপ দিতে গিয়ে, কিংবা নতুন শিক্ষার অভিঘাতে সমাজ-সংসারে আলোড়নের ছবি এঁকেও পুরনো মূল্যবোধের জয়গান গেয়ে পাঠককে স্বস্তি দিতে গিয়ে, তাঁর অনেক কাহিনি সারবত্তা হারিয়েছে। তবে সে সব সত্ত্বেও শরৎচন্দ্রের লেখনীর শক্তিকে, তাঁর সমদর্শিতা ও মুক্ত মানবিক মনকে আবিষ্কার করে বহু পরিণতমনস্ক পাঠক তাঁকে নতুন করে চিনছেন রোজ। গোপা দত্তভৌমিক তাঁর পুনরাবিষ্কারের যাত্রা ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকদের সঙ্গে।

প্রবন্ধকার হিসাবে শরৎচন্দ্র খুব বেশি আলোচিত হন না, কিন্তু প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর ‘নারীর মূল্য’ রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল। জাত-কুলের অভিমান, আর্যত্বের বড়াই, সতীত্বের গৌরব, সব খণ্ডন করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, বিশ্বের সর্বত্র নারীর প্রশ্নহীন আনুগত্যেরই গুণগান গাওয়া হয়েছে। সব ধর্মের মধ্যে ইসলামই যে বিধবার প্রতি সবচেয়ে মর্যাদা ও সুবিচারের অনুজ্ঞা দিয়েছে, সেই সাহসী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন শরৎচন্দ্র, মনে করিয়ে দিচ্ছেন আলোচক। তবে সতীত্বের এই অসারত্ব তাঁর প্রবন্ধে (১৩০৯) লেখার পরেও তিনি শ্রীকান্ত-র অন্নদাদিদির মতো চরিত্র এঁকেছিলেন, বিধবার স্বল্পাহার ও কঠোর আত্মসংযমের সপ্রশংস বিবরণ দিয়েছেন। বিধবা বিবাহের মতো বিষয় নিয়ে শরৎচন্দ্রের মধ্যে দোলাচল, অস্বচ্ছতা থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরই কলম থেকে বেরিয়েছিল বামুনের মেয়ে-র মতো উপন্যাস, যেখানে “তথাকথিত শাস্ত্রসম্মত সামাজিক বিন্যাসের ফাঁপা সুবিধাবাদী ভণ্ড চেহারাটা... বারবার তুলে ধরা হয়েছে।” কুলীন চূড়ামণি, যাঁর মুখের কথায় লোকের জাত যায়, তিনিও গরু চালানে টাকা খাটান, যদি কিছু বাড়তি সুদ মেলে।

যাহার অমর স্থান: ফিরে দেখা শরৎচন্দ্র

গোপা দত্ত ভৌমিক

২৭০.০০

ঋত

চরিত্রহীন-এর কিরণময়ী বা শ্রীকান্ত-র রাজলক্ষ্মীর মতো চরিত্র কী উপায়ে বাঙালি পাঠকের মনের অভ্যন্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি, সে আলোচনার পাশাপাশি সে সব উপন্যাস সম্পর্কে চিঠিপত্রে শরৎচন্দ্রের মন্তব্যকে পাশাপাশি রেখেছেন গ্রন্থকার, যেগুলি প্রায়ই স্ববিরোধী। তবে মানবচরিত্রের বৈচিত্র যতখানি তুলে ধরে মহামারির সঙ্কট, তেমন আর কিছুই নয়, এবং সেখানে শরৎচন্দ্রের তুলনা বাংলা সাহিত্যে নেই। বর্মায় আগত কুলিদের ‘কেরেন্টিন’-এর সঙ্গে স্বতঃই লকডাউনের ‘সামাজিক দূরত্ব’-র বিধিতে শ্বাসরুদ্ধ শ্রমিকদের কথা মনে আসতে বাধ্য। যে শরৎচন্দ্র সাবেকিপনায় পাঠককে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন, তিনিই যে আবার সমাজের স্বার্থপর, বিবেকহীন রূপ তুলে ধরেছেন সান্ত্বনার কোনও অবকাশ না রেখে, শরৎচন্দ্রকে ফিরে না পড়লে সেটা বেখেয়ালে থেকে যায়। এই বইয়ের পরিক্রমা সেই ইচ্ছে আবার জাগিয়ে তোলে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy