লিভিং ব্রিজেস/ ফোক কালচার্স অব ইন্ডিয়া, দেন অ্যান্ড নাও
ইরাচ ভারুচা
৯৯৯.০০
হার্পার কলিন্স
মানুষের যাপন— জগতের এই চরাচরে কত বিচিত্রতার দৃশ্যপট দেখায়। রোজকার ছকবন্দি জীবন এড়িয়ে অন্য চৌহদ্দির খোঁজে গেলে, কখনও উজান টানের সন্ধান পাওয়া যায়। আত্মানুসন্ধান ও গবেষণায় নতুন অভিজ্ঞান তৈরি করে। বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের গবেষণা ও সংরক্ষণে অন্যতম উদ্যোগপতি আবার শল্যচিকিৎসক ইরাচ ভারুচা যেমন পরিভ্রমণের জন্য অন্য অভিযানে শামিল হয়েছিলেন। মাটি, জঙ্গল, নদী, সাগর, পাহাড়, অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান, জন্তুর আরণ্যক আচরণ, পাখির উড়ে যাওয়া দেখতে গিয়ে যাঁর দৃষ্টি চলে যায় আরও একান্ত আঙিনায়। আলাপ গড়ে ওঠে জনজাতীয় মানুষ, পশুপালক, কৃষিজীবী, মাছশিকারি; সঙ্গীত-নৃত্যের তাল-ছন্দের শিল্পী ও কৃৎকৌশলী কারুশিল্পীর সঙ্গে। তাতে ক্ষেত্রসন্ধানী পরখ আর মুক্তমনের কারিকুরিতে, স্বাধীনোত্তর কালে আমাদের দেশের লৌকিক সংস্কৃতির পাল্টে যাওয়া লেখচিত্রের একটা অবয়ব গড়ে উঠল। তখন তা হয়ে ওঠে, অতীত আর বর্তমানের সংযোগসূত্রে পরিব্যাপ্ত জীবনসংস্কৃতির ঐশ্বর্য আবিষ্কারও।
গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রযুক্তিবিদ শিল্পপতি সুমন্ত মুলগাঁওকর দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্তের প্রকৃতির মাঝে জনজাতীয় মানুষের ছবি তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ভারতের এ প্রান্ত সে প্রান্ত ঘুরে ইরাচ ভারুচার মনে আবার অন্য জানালা খুলে যায়। অগ্রজ বন্ধু সুমন্তর তোলা সাদা-কালো ছবির প্রকৃতি-পরিবেশ আর মানুষের যাপনচিত্র দেখতে গিয়ে পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপটের সন্ধানী হয়ে ওঠেন। রূপান্তরের এই দৃশ্যরূপ দেখতে পেয়ে অন্য পরিকল্পনার সূত্রপাত তখনই। পরবর্তীতে তাঁর তোলা রঙিন ছবিতে সেই ভাবনার সম্বলই ধরা পড়েছে। এ ভাবেই হিমালয়, মরু প্রান্তর, উপকূল অঞ্চল, ঊষর ভূমি, পশ্চিমঘাট, দাক্ষিণাত্য, গাঙ্গেয় সমভূমি, উত্তর-পুবের পাহাড়-জঙ্গলের ভূভাগ বা দ্বীপবাসী মানুষের কথা ফুটে উঠেছে লেখসূত্র ও ছবির যুগলবন্দিতে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ ও তার সমাজ-সংস্কৃতির সংযোগ-সম্পর্কের খতিয়ানে মিশেছে নৃতত্ত্ব, ভূগোল ও ইতিহাসের অনুধ্যানের ব্যক্তিগত গদ্য। তাতে আছে পোশাক ও গহনায়; চারু, কারু ও প্রদর্শশিল্পে— সময়ের রূপান্তরে পাল্টে যাওয়ার হদিশ। আলোকচিত্রের সূত্রও গবেষণার মূলধন হয়ে উঠেছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণে আলোকচিত্রের সহাবস্থান থাকলেও, সে সময়ে তা ব্যাপক রূপ পায়নি। পরে, সুনীল জানার মতো অনুভবী আলোকচিত্রী ক্যামেরায় জনজাতি জীবনের নানা মুহূর্ত ধরেছেন। সুমন্ত মুলগাঁওকরের পথ ধরে ভারুচা শুধু জনজাতি নয়, নানা ধারার ভারতীয় জনগোষ্ঠীর দৃশ্যায়ন করেছেন। বইটি পরিব্যাপ্ত ভারতভূমির জনজাতীয় ও জনগোষ্ঠীগত চর্চার হদিশ ও সময়ের সঙ্গে রূপান্তরের ইঙ্গিতবহ আলেখ্য। এই চর্চায় নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের অন্তর্ব্যাপ্ত পরিসর সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। বিগত শতকের শেষ দশকে বা এই শতকের শুরুতে অ্যানথ্রপলজিকাল সার্ভের উদ্যোগে ভারতের জনজাতির যে সমীক্ষাভিত্তিক বর্ণনাত্মক পরিচয় ও অ্যাটলাস প্রকাশিত হয় তা সুনির্দিষ্ট ও নৈর্ব্যক্তিক চর্চার তথ্যলেখ। কিন্তু রূপান্তরের প্রতিতুলনার বয়ানে ‘জীবন্ত সেতু’ শিরোনামাকৃত বর্তমান প্রকাশনায় কোনও কোনও জনজাতির নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য তৈরি হলেও— কখনও তা মনে হয় এ প্রয়াস ব্যক্তিগত ভ্রমণেরও। মেঘালয়ের মাউলিনং-এ গ্রামীণ মানুষের কয়েক প্রজন্ম ধরে তৈরি জীবন্ত গাছের শিকড়ের সেতু ভ্রামণিকের চোখে আকর্ষণীয়— তেমনই তা ইঙ্গিতময় হয়েছে অতীত আর বর্তমানের সংযোগসেতুর লৌকিক সংস্কৃতির উল্লেখে। নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক সমাজ-সাংস্কৃতিক নিবন্ধীকরণ নয় এই বই; সরল বিন্যাসে সুখপাঠ্য আর আলোকচিত্রের আলো-আঁধারিতে উজ্জ্বল মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। জনবৈচিত্রের জ্ঞানচর্চার নব হদিশ আর জনপ্রিয় কৌশলী বর্ণনায় নৃতাত্ত্বিক বয়ানে বইটি আকর্ষণীয় ও শোভনসুন্দর। দেশের সাত-শতাধিক জনজাতির কাছে যাওয়া বা বহুবিচিত্র লোকায়ত জীবন দেখা একক ব্যক্তিমানুষের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তবু নাগাল্যান্ডের নাগা, ওড়িশার বোন্ডা, ছত্তীসগঢ়ের গোন্ড, তামিলনাড়ুর টোডা বা হিমাচলের ভোটিয়ার মতো বহু জনজাতির চিত্র-কথা জানতে গিয়ে শাশ্বত জীবনশৈলীর আভাস পাওয়া যায়। হস্তশিল্প, নৃত্যগীত, হাট, মেলা, উৎসব, রীতিনীতি, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি বিচিত্রতার গবেষণা তথ্য আর এই সময়ে দেখার কথনশৈলীতে তৈরি হয়েছে ভারতীয় লোকজীবন ও সংস্কৃতির পরম্পরার তুল্যমূল্য বয়ান।
শিকড়সন্ধানী ভারতসংস্কৃতির বিস্তৃত চরাচরের পরম্পরা বলতে গিয়ে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথাও বলেছেন। এ সবই শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী হয়ে দেখা। সে সময়ে তথাকথিত ‘পিছড়ে বর্গ’, ‘অস্পৃশ্য’ মাহার জনগোষ্ঠী়র জেনো মানি কৃষিজীবী থেকে পেশা পাল্টে লেখকের ডাক্তার বাবার ড্রাইভার হয়েছিলেন। কিন্তু আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে ভারুচার শৈশবে পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলের সেই অক্ষরজ্ঞানহীন জেনোর স্বতঃবিকশিত জ্ঞান লোকায়ত সংস্কৃতির পরম্পরা আলোচনায় মেলাতে চেয়েছেন। চাষবাস, পশুপালন, বন্যজন্তুর গতিবিধি এমনকি অন্ধকারে হাঁটার কৌশলে তাঁর ছিল অসাধারণ অর্জিত ধ্যানধারণা। জেনো কী করে জেনেছিলেন প্রকৃতিপাঠের সহজ ইস্তেহার বা মানুষের জীবনশৈলীর অন্তরকথা? এই অভিজ্ঞানেই থাকে মানব সমাজ ও সংস্কৃতির রকমারি ধাঁচ। জীববৈচিত্রে মানুষের একাত্ম সন্নিবেশকে দেখানো— প্রাগিতিহাস ও শিকার সংগ্রহের জীবন, পশুপালন, কৃষিকাজ, জনজাতীয় সংস্কৃতির স্তরবিন্যাস ছাপিয়ে প্রকৃতি পরিবেশ আর মানুষের প্রবহমান জয়যাত্রাকে প্রকাশ করেছেন লেখক। বিষয়তত্ত্বে বাড়তি অনুগত না হওয়ায় ব্যাপ্তি অনেক খোলামেলা— যা ভীমবেটকার গুহাচিত্র থেকে ছত্তীসগঢ়ের ধাতুশিল্প, দক্ষিণ ভারতের ভেষজ চিকিৎসা, বহুরূপী, ম্যাজিক ইত্যাদি রূপকৌশলের। আলোচনার মধ্যে আছে কিছু সুনির্দিষ্ট ‘কেস স্টাডি’ যা এই লৌকিক অন্বেষণের ব্যাপ্তিকে আকর্ষণীয় করেছে।
জনজাতি আর বহুজাতিগোষ্ঠীর ধারাবাহী পরম্পরায় টিকে থাকে কেমন সেই লৌকিক সংস্কৃতি? দেখা আর চর্চা-গবেষণার সামূহিক তথ্য উল্লেখে লেখক তাঁর বন্ধু সুমন্তর ছবির ছায়াপথের বৃত্তান্ত লিখেছেন মরমি তথ্যে। এই সূত্রেই তৈরি হয়েছে জনজীবনের আবিষ্ট জগৎ। পাল্টে যাওয়া সংস্কৃতি আর অনতিক্রম্য জীবনের বয়ে চলা বিচিত্র ব্যঞ্জনার মোজাইক এই বই। মূলত টাটা ট্রাস্টস-এর প্রণোদনায় তৈরি দৃষ্টিশোভন এই বইটি পড়তে পড়তে আনন্দের সঙ্গে কিছু আক্ষেপও তৈরি হয়। বাংলার শুধু সাঁওতাল ও সুন্দরবন! বইটির পরিকল্পনা যদিও স্বতন্ত্র ভাবনায়— তবু বাংলার উত্তরে টোটো জনজাতি বা জঙ্গলমহলের ‘ছৌ’ মুখোশের নৃত্যকৌশলের রূপ অন্তত যদি থাকত, তা আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ হত। সাদা-কালো বহু ছবির সুনির্দিষ্ট পরিচিতিও নেই বহুলাংশে। তবু বইটা দেখলে ছন্দময় জীবনের স্পর্শ অনুভব করা যায়। তাতে আছে প্রান্তরভূমি আর নদী-পাহাড়-জঙ্গলের মৌনী জগতের মাঝে দারিদ্র আর বঞ্চনার সঙ্গী হয়েও— মানুষের উন্মুখ জীবনের জয়যাত্রা। যেখানে দেশকালের ভারতসংস্কৃতি আবহমান পরম্পরার ঐশ্বর্যের আকাশপ্রদীপ হয়ে ঝিকিমিকি করতেই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy