স্পর্ধা: সিএএ ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিবাদ। শাহিন বাগ, দিল্লি, ২০২০
বারোটি প্রবন্ধ আর তিনটি সাক্ষাৎকার ছাড়াও এ-বইয়ের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলে মস্ত ঘাটতি থাকে, কারণ সেটি নিছক ভূমিকা নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ, যার ব্যবহারিক মূল্য অনেকখানি। তবে, সেই ভূমিকা, বইয়ের শিরোনাম, এবং ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘সমসাময়িক’ নামক দু’টি বর্গে প্রবন্ধগুলির বিন্যাস— এই সব দেখে পাঠক যদি মনে করেন যে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথিতযশা পণ্ডিত এই সঙ্কলনে কেবলমাত্র নাগরিক-এর ধারণাটিকে ইতিহাস ও সমকালের প্রেক্ষাপটে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, তা হলে একটু ভুল হবে।
গত এক দশকে বিভিন্ন উপলক্ষে লিখিত বা পঠিত প্রবন্ধগুলিতে একটা বড় অর্থে নাগরিক এবং নাগরিকত্বের ধারণা ক্রমাগত ছায়া ফেলেছে বটে, কিন্তু এই সঙ্কলন কেবল নাগরিক বিষয়ক আলোচনার সমাহার নয়।
বস্তুত, বিষয়বৈচিত্র এবং সেই বিচিত্র বিষয়গুলির প্রতিটির ক্ষেত্রেই লেখকের গভীর ও সমৃদ্ধ চিন্তাভাবনার ঐশ্বর্য এতটাই যে, স্বল্প পরিসরে এ-বইয়ের কোনও একটি দিক নিয়েও যথার্থ আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে শুধু সে-বৈচিত্রের একটা আভাস দেওয়া যায়। প্রথম বর্গের লেখাগুলিতে আলোচনায় এসেছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাক্-রামমোহন পর্বে বাঙালির প্রথম ইউরোপ-চর্চা, ওই সময়কালেই জোধপুরে জীবহত্যা নিষিদ্ধ করার ইতিবৃত্ত, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার ‘আদি-আধুনিক’ অভিজাত সমাজ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বাংলায় নাটকের বিবর্তনের সূত্রে থিয়েটার ও গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, আজকের দুনিয়ায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র প্রাসঙ্গিকতা, মার্ক্সবাদী ইতিহাস-চর্চার ‘দুর্ধর্ষ পণ্ডিত’ পেরি অ্যান্ডারসন-এর ‘ভারতীয় ভাবাদর্শ’ সংক্রান্ত লেখালিখিতে উন্মোচিত ইউরোপ-কেন্দ্রিকতা, উদ্বাস্তু বাঙালিকে নিয়ে প্রফুল্ল চক্রবর্তীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ দ্য মার্জিনাল মেন ফিরে পড়া; দ্বিতীয় বর্গে পাই সমর সেনের ব্যক্তিত্ব বিষয়ক আলোচনার সূত্রে দায়বদ্ধতার ধারণাটির উন্মোচন, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপারেশন রাজারহাট উপন্যাসের এক অ-সামান্য পাঠ, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট জমানার অবসানের পরবর্তী প্রথম পাঁচ বছরের খতিয়ান, একাধিক সাক্ষাৎকারে ও লেখায় নরেন্দ্র মোদীর রাষ্ট্রবিজয়ের প্রেক্ষাপট এবং তাৎপর্যের বিশ্লেষণ, আর ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ ও কর্তব্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা।
নাগরিক
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
৩০০.০০
অনুষ্টুপ
এমন বহুধাবিস্তৃত এবং চিন্তাঋদ্ধ আলোচনাগুলির মধ্যে জোর করে কোনও একটি যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করা অর্থহীন, তাতে গ্রন্থকারের প্রতিও মস্ত অবিচার হবে, কারণ তিনি বহুত্বের সাধক। কিন্তু অনেকগুলি লেখাতেই, বিশেষ করে ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিবর্তন যেখানে এসে পৌঁছেছে ও যে অভিমুখে চলেছে তার আলোচনায়, প্রবীণ সমাজবিদের কণ্ঠস্বরে একটা সুর যেন বার বার বেজে উঠতে শুনি, যা আগে তাঁর লেখায় এ-ভাবে লক্ষ করিনি। হয়তো সেটা লক্ষ না-করারই দোষ, কিন্তু তবু, মনে হল যখন, দু’টি লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যাক দু’টি অংশ। ‘বাম বিকল্পের সন্ধানে’ শীর্ষক ২০১৪ সালের এক বক্তৃতা-প্রবন্ধের উপসংহারে লেখক বলছেন, “যে সময়ে বামপন্থীদের জোর ছিল, সেখানে জোরটা ছিল আদর্শের। সেটা শুধু সংগঠনের জোর ছিল না। নির্বাচনে জিতে, সরকার তৈরি করে যে বদল এল, তার ফলে দাঁড়িয়ে গেল যে আদর্শ-টাদর্শ দরকার হবে না, আমার দলের লোককে দিয়ে আমি ভোট করাব, তা হলেই সরকারে থাকা যাবে। এক বার এই দিকে চলে গেলে কী হয়, তার ফলটা তো দেখলাম।” এই সূত্রেই পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত নাগরিক সমাজ সম্পর্কেও সুতীক্ষ্ণ মন্তব্য উচ্চারণে দ্বিধা করেননি তিনি, রাজ্যে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের বর্তমান দুর্বলতার প্রসঙ্গে লিখেছেন, সেই আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেননি, করছেন না, “বুদ্ধিজীবী, বিদ্বজ্জন এই কথাগুলো গত কিছু দিনে অধিক ব্যবহারে আর বিশেষ অর্থ বহন করে না। এবং বুদ্ধিজীবীরাও এর জন্য দায়ী। বুদ্ধিজীবীরা এত সহজে ফাঁদে পা না দিলে তাঁদের অবস্থা এতটা খারাপ হত না।” কঠিন সত্য বইকি।
এই বক্তৃতার প্রায় দু’বছর পরে, তৃণমূল কংগ্রেস জমানার প্রথম পর্বের অন্তিম লগ্নে, এই পত্রিকারই পাতায় প্রকাশিত ‘মমতাশাহির খতিয়ান’-এ পড়ি: পশ্চিমবঙ্গের “এই অবক্ষয়ের শেকড় খুঁজতে গেলে বামফ্রন্ট আমলে ফিরে যেতে হবে নিশ্চয়। কিন্তু... তৃণমূল শাসনের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ক্ষতি হলো ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় যা সংশোধন করা দুঃসাধ্য।” এবং সেই ক্ষতির জন্য বড় রকমের দায়ভাগ স্বীকার করতে হবে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষিত সমাজের সদস্যদের’, কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁরাই চালান, প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় ঘটছে তাঁদেরই হাত দিয়ে। “তাঁরা যে জ্ঞানপাপী হয়ে আশু সুযোগসুবিধার লোভে অথবা অন্যায় শাস্তির ভয়ে স্বৈরতন্ত্রের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেবেন না, সেজন্য তাঁরা বৃহত্তর সমাজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। আজ কি তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি রাখবেন?”
এ-প্রশ্নের উত্তর আজ আমাদের জানা। ফাঁদে পা দেওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, সে-কথাও আজ আর কারও জানতে বাকি নেই। বিমূর্ত আদর্শ বা নৈতিকতার ফানুস ওড়ানো যাঁদের নেশা, পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের দলে নেই, কস্মিন্কালেও ছিলেন না। কিন্তু আদর্শ ব্যাপারটাই অর্থহীন, নৈতিকতার কোনও দাবি নেই— এমন অবস্থান নাগরিক নিতে পারেন না, যদি তাঁকে নাগরিক নামের যোগ্য হতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক অতীত এবং দৈনন্দিন বর্তমান এই আদর্শগত অবস্থানের গুরুত্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে।
আদর্শের প্রশ্নটি এই সঙ্কলনের পূর্বোক্ত ভূমিকাতেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি লেখা হয়েছে ২০২০-র মে মাসে— নাগরিক পঞ্জি রচনা আর নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে ভারত সরকারের ধুন্ধুমার অভিযান এবং তার বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিকদের তুমুল প্রতিস্পর্ধার প্রেক্ষাপটে। ওই সরকারি অভিযানের নৈতিক সমালোচনাকে যুক্তি ও তথ্যে সমৃদ্ধ শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে প্রবন্ধটি। স্বাধীনতার সময় আমাদের দেশে নাগরিকত্বের যে নীতিকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, রাজনীতির লীলায় কী ভাবে ক্রমশ তার বিবর্তন ঘটেছে, অল্প কথায় তার এক গভীর অথচ প্রাঞ্জল বিবরণ আছে এই ভূমিকায়, সামাজিক আলোচনার পরিসরে যা আমাদের সকলের জানা দরকার, মাথায় রাখা দরকার। এবং খেয়াল করা দরকার এই মৌলিক সত্যটি— দেশের মাটিতে জন্ম নিলেই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যে উদার আদর্শ, সেই ‘ভূমিসন্তানের অধিকার’ (ইয়ুস সোলাই)-এর ধারণাই ভারতীয় সংবিধানে মান্য হয়েছিল।
এর উল্টো দিকে আছে ‘রক্তের অধিকার’ (ইয়ুস সাঙ্গুইনিস)-এর ধারণা, যাতে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয় পিতামাতার জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে। ‘সংকীর্ণ এবং পরজাতিবিদ্বেষী মনোভাবের সহায়ক’ হিসাবে নিন্দিত এই ধারণাই সাম্প্রতিক কালে দেশে দেশে মাথা চাড়া দিয়েছে, দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা সেটি কব্জি ডুবিয়ে কাজে লাগাচ্ছেন, অভিবাসী ও অন্য-দেশিদের প্রতি মানসিকতা পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে আইনও। ভারতে যা দেখছি, তা এই বিশ্ব-প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কেবল তার চেহারাটা বিশেষ রকমের কদর্য ও ভয়ঙ্কর— রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব সংশোধন অভিযানের সর্বাঙ্গেও দগদগ করছে আকাঁড়া বিদ্বেষের নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িকতা। এই অনাচারের প্রতিবাদে তথ্য এবং যুক্তির কাঠামো গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাঠামোয় প্রাণসঞ্চার করতে হলে আমাদের গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে হবে: নাগরিকত্বের অধিকারকে ধর্ম বা সম্প্রদায় দিয়ে খর্বিত করার যে কোনও সওয়ালই মূলত ভারত-বিরোধী— ‘আমরা লোকসাধারণ’ (উই দ্য পিপল) যে ভারতের সংবিধান গ্রহণ করেছি তার স্বধর্মের বিরোধী। এটা নৈতিকতার প্রশ্ন, আদর্শের প্রশ্ন, যে প্রশ্নে কোনও আপস চলবে না, চলতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy