দৈনন্দিন যাপনের আলো-অন্ধকার পেরিয়ে আরও এক স্পর্শযোগ্য জীবন বয়ে যায় ভিতরে, নৌকার চালে। কখনও তাপমাত্রার হেরফেরে হিমশৈলের মতো তার আভাসটুকু নাক উঁচিয়ে থাকে জলের উপরে। চকচকে, বানানো, আরোপিত নয়, এই স্রোতে অহরহ ভেসে চলে অগণন কাগজের নৌকা। তা অফুরন্ত, অথচ জিওল। বিকেলের আলো-লাগা স্তিমিত আলো দিয়ে তৈরি তার শরীর। নিঃসীম জীবনের মাঝে বিপন্ন মানুষের মুখে সেই বেঁচে থাকার আলো পড়ে। তৈরি হয় একের পর এক জাদু নকশা।
এই বই তেমন অফুরন্ত অন্তরযাপনের নৌকার মতো সতত প্রবহমান। যাদের পাঠ-অভিজ্ঞতায় পাঠক পৌঁছে যাবেন এক আয়নাঘরে, যেখানে নিজ সত্তার খণ্ড খণ্ড প্রতিকৃতি ছড়িয়ে আছে। যা নিজেদের হয়েও কতই না ভিন্ন! এই গল্পগুলির পরিসরে আসলে আবহমান মানবজমিনে অগণ্য আলোকবিন্দুর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে, যার গায়ে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষুদ্র রহস্য, সম্পর্কের টানাপড়েন, টেনশন, স্বপ্নভঙ্গ, প্রান্তিক স্বর, নির্জন সংলাপ, অপেক্ষার মিনে করা; যে আলোকবিন্দুগুলি এই সঙ্কলনের গল্পগুলির সম্ভাবনাকে অফুরান করে তোলে। পাঠকের সামনে তৈরি হয় উদ্বৃত্ত অর্থের ভাঁড়ার।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর তৈরি এই গদ্যপ্রবাহের প্রকৃত সূত্র রয়েছে এর ইঙ্গিতময়তায়, বহুস্তরীয় ভাষা-ভাস্কর্যে। দেশের বিচিত্র ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ ও কৌমজীবনের মানচিত্র এই পঞ্চাশটি গল্পে আঁকা, কিন্তু কোথাও দাগিয়ে দিয়ে বলা হয়নি কিছু। বরং এমন এক ভাষা এই গদ্যের ভিতভূমি, যা রূঢ়, জান্তব বাস্তবতার পাড় দিয়ে ঘিরে রেখেছে টলটলে একটি পুকুরকে। সেই পুকুরটির যে শর্ত, তা হয়তো কবিতারও অনুচ্চারিত শর্ত। সেখানে কখনও ছায়া পড়ে স্মৃতির, ফিরে আসে ছেলেবেলার প্রসন্ন বাতাস, অনপনেয় বিষণ্ণতা, হাহাকারও। তাই শেষ বিচারে এই গল্পগুলি শুধুমাত্র পাঠের জন্যই বরাদ্দ থাকে না, খানিকটা সেবনের জন্যও নির্ধারিত হয়ে যায়।
পঞ্চাশটি গল্প
অনিতা অগ্নিহোত্রী
৪৫০.০০
আনন্দ
দুর্লভ এবং অভিজাত এক পরিমিতিবোধ ধারণ করে রেখেছে গল্পগুলির অন্তর্বস্তুকে। পরিসরের কারণে গল্পগুলির আলোচনা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয় হয়তো। পাঠক নিজের মতো করে নিজের ছায়া খুঁজে নেবেন। শুধু প্রবেশদ্বারটিতে আলো ফেলার জন্য কয়েকটি গল্প নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ‘রণভূম’ গল্পটিতে পলাশির মাঠ দেখতে আসা মফস্সলের হাইস্কুল মাস্টার অভিরামের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের সঙ্গে কেমন অনায়াসে জায়গা বদলাবদলি করে নেয় বাংলার শেষ নবাবের ব্যর্থতার ইতিহাস। দেশকাল ও সময় একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। এই গল্পের ইতিহাসবোধ যেন সেই প্রখ্যাত গোধূলিবেলা, যেখানে তথ্য ও তত্ত্ব, বাস্তব ও কল্পনা, সত্য ও দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। “একমাত্র যোদ্ধাদের পতনভূমিতে স্বাধীন মানুষও দীপ জ্বালে না”— এই ঘোর উচ্চারণ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় গণতন্ত্রের ঘোলাটে হয়ে যাওয়া পরিণতির সামনে। ‘যশোবন্ত: এক গেরিলার আত্মসমর্পণ’ গল্পটির পরিণতিতে ‘বউলের গন্ধমাখা আঁধার’ই যে ঝরে পড়বে, গল্পটির প্রথম লাইন থেকেই লেখিকা আমাদের তার জন্য প্রস্তুত করতে এগোন। স্নায়ু-টানটান এক গেরিলা যুদ্ধের মতো প্রেমের এক অন্য ছবি তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত ভিতর থেকে বটফলের মতো ফেটে পড়ে। তার পর ভালবাসার শান্ত প্রপাত ঘটে। পাখির চোখে দেখা দেশের কোনও এক মহকুমার যাপন দুর্নীতি, অন্তর্বর্তী ক্লেদ, প্রশাসনের দুর্লঙ্ঘ্য ফাঁদ— সাব-টেক্সট হয়ে সমান্তরাল ভাবে রয়ে যায় এই গল্পে।
বিশেষ ভাবে বলতে হয় সঙ্কলনের প্রথম গল্প ‘শেষ সামুরাই’-এর কথা। বাংলা ভাষার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ক্লান্ত যোদ্ধার দীর্ঘশ্বাস বড় মরমি আখ্যানে বুনে দেওয়া, যেন প্রতিটি ছত্রে। ইশারাপ্রবণ এই সাড়ে নয় পাতার গল্পে রয়েছে আরও বেশ কিছু অণুগল্পের বীজ, যেগুলি বিশদে বলা হয়নি বলেই পাঠকের কল্পনাকে তা ক্রমশ উস্কে দিতে থাকে। শেষ হয়েও তাই এই গল্প শেষ হয় না। দুই অসমবয়সি বন্ধুর মধ্যে মায়াবিধুরতা, গল্পের শেষে পাঠককে ‘আফটার টেস্ট’-এর মতো দীর্ঘ ক্ষণ অন্যমনস্ক করে রাখে।
আমরা প্রতিনিয়ত কাছের মানুষের থেকে, সম্পর্কের অনাবিলতার থেকে সরে যাচ্ছি দূরে। হারিয়ে যাচ্ছি ভিতরের মানুষটির থেকেও, রাংতাকে রুপো ভেবে পণ্যসুখের দাঁও-তে লাগিয়ে দিচ্ছি আত্মার স্পর্শ। ‘তীর্থর দিদি’ গল্পে ক্ষীণদৃষ্টি কাজলদি আমাদের বহু দূর পর্যন্ত দেখতে ও দেখাতে শিখিয়ে নিজে অনন্ত আলোর মতো নার্সিংহোমের বেডে জেগে থাকেন। সম্পর্কে পচন ধরায় উচ্চাকাঙ্ক্ষার, স্বার্থপরতার কালি, কিন্তু তবুও স্নেহ জেগে থাকে বদ্ধ ডোবার উপর জোছনার মতো।
“মৃত্যু এসে আলিঙ্গন না করলে জীবন জাগে না।”— এই উচ্চারণের সামনে এসে পাঠ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হয় ‘একটি বিশেষ দিন’ গল্পে। ছোট ছোট স্ট্রোকে সেই জীবনের আভাসটুকু এঁকে দেওয়া হয়: ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’। জীবন ও মৃত্যুর মাঝে হাইফেনের মতো জেগে থাকে প্রতীক্ষা, বরফ হয়ে যাওয়া সম্পর্কের রেলিংয়ে টাঙানো থাকে সংসার।
অমল শৈশবের সেতু ভেঙে পড়ার শব্দ আমরা কে শুনিনি? সেই অনুরণনই আবার ফিরে আসে ‘বীজপত্র’ গল্পটিতে। হলুদ ইস্কুলবাড়ি থেকে আমরা পরবর্তী কালে উড়তে থাকি যে যার নিজস্ব ফানুসে। কারও ফানুস গোত্তা খেয়ে পড়ে, ম্লান হয়ে যায় উড়ান। শ্রেণি-প্রভেদের জটিল ঘুণপোকা কাটতে থাকে ফেলে আসা সম্পর্কের শর্তহীনতাকে। যদিও এই গল্প শেষ পর্যন্ত আজকের স্বার্থচেতনার বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো এক শর্তহীন ভালবাসার জয়পতাকা উড়িয়ে দেয়। যে ভাবে উঁচু জলাধার থেকে প্রবাহ অনিবার্যতায় গড়িয়ে নামে নীচে, অপরিবর্তনীয় ভাবে, তেমনই এক অসম বন্ধুর অভিমুখে এই প্রবাহ যখন পৌঁছয় ক্লাইম্যাক্সে, আমরা এক দুর্লভ মায়া জেগে উঠতে দেখি। ‘হলুদ বিকেল নামলে চুনখসা দেওয়ালে চৌকো আলো’র বৃত্তের মধ্যে অশ্রুর সেতু তৈরি তখনই সম্ভব হয়।
‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।/ সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে’-র সুর অন্তর্লীন হয়ে গুনগুন করে বেজে গিয়েছে ‘রথ’ গল্পটিতে। এক লেখিকা যার কেন্দ্রে, যশ, স্বাস্থ্য, ক্ষমতা যাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। স্বজন বিরহিত, অতীতের স্মৃতির জলসাঘরে তাঁর তীব্র প্রশ্ন জেগে ওঠে, “কোথায় গেল সেইসব লেখা আমার…?” সময়ের রথের জড়ভরত চাকার দাগ তাঁর চলার পথে। কিন্তু শর্তহীন এক টান-ভালবাসা যাঁকে ছাড়ে না। লেখিকার পথ চলার দাগটুকু ধারণ করা থাকে এক অনামী সম্পর্কে, চিরসখা ছাড়া ‘ত্রিদিববাবু’কে আর কী-ই বা বলা যায়? যিনি বাইরের সেক্রেটারির পোশাকে আসলে ‘পঁচিশ বছর ধরে একটা তাল বা সুপুরি গাছের মতন দাঁড়িয়ে’ কেবল ওই লেখালিখির জীবন দেখে যাচ্ছেন?
যে কোনও রাস্তাই কি শেষ পর্যন্ত শৈশবে গিয়ে মেশে? প্রিয় সোয়েটারের বোতাম হয়ে ছড়িয়ে থাকে বাতাসিয়া লুপের কুয়াশার মতো স্মৃতিজলে? হঠাৎ সেই অতীত সত্তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার এক অপরূপ আখ্যান ‘বাতাসী’ গল্পটি। ‘স্বপ্নের আলিঙ্গনে কিছুক্ষণ’ এক জাদুবাস্তবতার অভিনব ন্যারেশন। একটি গড়পড়তা হেরে যাওয়া মানুষের গল্প যে গোটা দিনের অপমান আর পরাজয়ের ক্ষত সামলে নেয়, বাড়ি ফিরে মুড়ি আর এক কাপ চায়ে আর তার পর কাঠের ডেস্কে লম্বা খাতা খুলে ঝুঁকে বসে লিখতে। ভিতরের আনন্দ আর বাইরের অপমানের মধ্যে যে নিত্য আসা-যাওয়া, তার সাঁকো এ ভাবেই রচিত হয় প্রতি দিন। কালক্রমে সেই সাঁকো ভেঙে পড়ে ভঙ্গুরতার নিজস্ব বিজ্ঞানে। তবুও গঙ্গায় ভরা কটালে বিসর্জনের কষ্টের মধ্যেও মিনে করা থাকে আনন্দ-নকশা। গল্প শেষে পাঠকেরও স্বপ্ন পর্যটন শুরু হয় যেন।
আসল প্রশ্নটা যে শিকড়ের, ডানার নয়, এই অমোঘ সত্যটির মুখোমুখি হেঁচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘ভূমিষ্ঠ’ গল্পটি। সত্যিই তো, এক ছোট্ট বর্গক্ষেত্র-জোড়া শূন্যতায় আমরা আজীবন খেলা করি, যেখানে লেগে থাকে অসুখের, লড়াইয়ের, প্রেম ও শৈশবের দাগ, সেই বাড়ি বদলের সময় এলে টান পড়ে শিকড়েই। নগরায়ণ, উন্নয়ন, প্রগতির এই মারহাব্বা খেলায় ‘বিদেশি আড়তদার’-এর হাতে এই শূন্যস্থানগুলি তুলে দিয়ে, এই বসতভিটে ছেড়ে শহরের উপান্তে চলে যাওয়ার সময় স্মৃতিকীটে কাটে মহাকাল।
৩৭১ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থপাঠ হয়তো হয়ে যাবে এক টানে, এর নিহিত চুম্বক ধর্মের কারণেই। কিন্তু মায়া জেগে থাকবে দীর্ঘ সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy