হট্টমেলা: উনিশ শতকে ভারতীয় আদালত। জে এফ অ্যাটকিনসনের কারি অ্যান্ড রাইস (১৮৫৯) বই থেকে
বেনারস শহরের ইউরেশীয় ডেপুটি কালেক্টর জর্জ ওয়েট ওরফে পাঁচকড়ি খানের বই রিভিলেশনস অব অ্যান অর্ডার্লি (বঙ্গানুবাদে ‘আর্দালি পাঁচকড়ি খানের ঝাঁকিদর্শন’) ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এ অঞ্চলের ব্রিটিশ নিম্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঘিরে নানা স্তরে দুর্নীতির এক অসাধারণ দলিল।
ওয়েটের বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র হল এক হতদরিদ্র যুবক পাঁচকড়ি। তার হঠাৎ দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধু শুন্তা ক্যা সিং-এর সঙ্গে, যে তারই মতো সহায়সম্বলহীন অবস্থা থেকে ভাগ্যের জোরে এবং বুদ্ধিবলে তখন ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুরের খাস আর্দালি। শুন্তা ক্যা-র সুপারিশে পাঁচকড়ির কেবল চার টাকা মাসিক বেতনে আর্দালির চাকরিই জোটে না, কী ভাবে ঘুষ নিয়ে এবং নানা জালিয়াতির মাধ্যমে সহজে অর্থাগম ঘটতে পারে সে সব বিষয়ে যথেষ্ট পরামর্শও মেলে। কিছু দিনের মধ্যেই পাঁচকড়ি অর্থ উপার্জনের এবং মুরুব্বি ধরার নানা পন্থা আবিষ্কার করে ফেলে তার বন্ধুর মতোই প্রভাবশালী ও বিত্তবান হয়ে ওঠে।
চৌত্রিশ অধ্যায়ের বইটির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে পাঁচকড়ির এ দফতর থেকে ও দফতরে দাখিল হওয়ার এবং নিম্ন প্রশাসনিক মহলের বিভিন্ন দুর্বলতা বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির আখ্যান। লেখকের ঘোষিত উদ্দেশ্য অনুযায়ী এই বিবরণ ছিল উপর মহলকে নিম্নস্তরের এই দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে সজাগ করা এবং উচ্চস্তরীয় কিছু প্রশাসনিক ভুলভ্রান্তিও সামনে আনা। আর, এ কারণেই ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী ওয়েটকে নিতে হয়েছিল ছদ্ম চরিত্র ও ছদ্ম নামের আড়াল।
আর্দালি পাঁচকড়ি খানের ঝাঁকিদর্শন
সম্পাদনা ও অনুবাদ: অরিন্দম দাশগুপ্ত
৩০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
পাঁচকড়ির বয়ানে ক্রমশ উন্মোচিত হয় বিভিন্ন দফতরের দুর্নীতি— পুলিশ কী ভাবে কোনও যথাযথ কারণ না দেখিয়েই লোকজনকে আটক করত, আদালতে কী ভাবে নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা হত, ন্যায়পরায়ণ কর্মচারীরা দুর্নীতির এই মহলে কী ভাবে নির্যাতিত, অপদস্থ হত, কেমন করে আইনের মারপ্যাঁচের সুযোগ নিয়ে হাকিমরা নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাত ইত্যাদি।
পাঁচকড়ির বহু বিবরণেই একটি বিষয় বার বার উঠে এসেছে যে অর্থলোভী দুর্নীতিগ্রস্ত দেশজ মানুষজনের— যেমন, তহশিলদার, কানুনগো, মুহুরি প্রমুখ— উপর নির্ভরশীলতার জন্যই যেমন ইংরেজ বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনের বদনাম হত, তেমনই দুর্দশার শিকার হত সহায় সম্বলহীন সাধারণ মানুষ।
যেমন, জমিদারের দেয় রাজস্ব বাকি পড়লে তা আদায়ের জন্য কালেক্টর ‘খুম তহসিল’ প্রথা অনুযায়ী নিজের হেপাজতে জমিদারের জায়গায় ‘সাজোয়াল’ বসাত যার কাজ ছিল বকেয়া খাজনা আদায় করা। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যেত যে কাজটির বরাত পেয়েছে কোনও কানুনগো। সরকারের নামে নিজের আয়েশ আরামের জন্য সে করে যেত যত সম্ভব বেআইনি উসুল। আর এ সব যদি কখনও সরকার বাহাদুরের নজরে আসত তৎক্ষণাৎ কানুনগো হয়ে যেত বেপাত্তা। কিছু দিনের মধ্যেই তার দেখা মিলত অন্য কোথাও, অন্য কোনও সাজোয়ালের গদিতে।
নিলামদার এবং ‘বদমাশ’ পাটোয়ারিরা বিবিধ ফিকিরে কিষানের জমি বাজেয়াপ্ত করত। যেমন করেছিল রামকিষনের জমি, তার অনুপস্থিতিতে। নিরুপায় কিষান আদালতে আর্জি জানাতে পারত, কিন্তু নথিপত্র কী ভাবে তৈরি হবে তার উপর তার কোনও হাত ছিল না। অন্য দিকে ‘নাচার সাহেব কী করবেন?’ নকল নথির ভিত্তিতে তাঁকে আসল হকদারের বিপক্ষে রায় দিতে হত। সাহেব বড় জোর বলতে পারতেন যে হতভাগ্য কিষান দেওয়ানি আদালতে আর্জি জানাতে পারে।
ঠিক একই ভাবে অনেক সময় ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে দারোগার মর্জিতেই পালটে যেত মামলার হাল। তার দেওয়া সাক্ষ্য প্রমাণের উপরই নির্ভর করত মামলা কোন রাস্তায় চলবে। পাঁচকড়ি শুধুমাত্র নিজের অভিজ্ঞতাই বয়ান করে না, কখনও কখনও তার নিজের মতামতও খোলসা করে জানায়। “আমি তো বলব ম্যাজিস্ট্রেটের নাগাল পাওয়াটাই যেখানে এত হয়রানি সেখানে কিছুতেই তাঁর উপর বিশ্বাস তৈরি হয় না, হুজুরের দরকার সবার কথা শোনা। কেবল জোরালো প্রমাণ বা সাক্ষী আছে তাদের কথাই শোনা হবে এমনটা না হওয়াই উচিত।”
সাক্ষীসাবুদ-নির্ভর ব্রিটিশ বিচার পদ্ধতি সব সময়ে দেশজ রীতি রেওয়াজের সঙ্গে মিলত না। তার বেশ কয়েকটি কৌতুকপূর্ণ গল্প আমরা পাই এই বইয়ে। যেমন, এক আফগান তার চাকরকে চুরি করতে হাতে-নাতে ধরে ফেলে নিয়ম অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে নিয়ে আসে। ম্যাজিস্ট্রেট তার নালিশের প্রমাণস্বরূপ সাবুদ চাইলে, আফগান তার চাকরকে পেটাতে পেটাতে বলে, “তুই যখন আমার লুঠছিলি তখন কেন তার সাক্ষী রাখিসনি?”
দারোগা, সর্দার, জমিদার চক্কর যে কী কী ফন্দি ফিকিরে বেকুব বানাতে পারে তার কোনও হদিশ সরকারের কাছে ছিল না। এর ফলে, এক বার ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জবরদস্ত চক্রান্তকারীরা ধরা পড়েও বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
কাশী শহরে পান্ডাদের মৌরসিপাট্টা নিয়ে যে বিবরণ পাঁচকড়ি দেয় তার সঙ্গে আজকের পাঠকের অভিজ্ঞতাও হয়তো কিছুটা মিলবে। জাল, জুয়াচুরি, মিথ্যে ভাষণে তাদের সবিশেষ সিদ্ধি। এ প্রসঙ্গে পাঁচকড়ি পান্ডাদের সঙ্গে পোপের তুলনা টানে, “পোপ যেমন ভান করেন এই দুনিয়ার দায় তাঁর আর তাই তাঁর এখতিয়ারের ভিতর পড়ে আম-আদমির খবরদারি করা। মাঝে মাঝে এই হামবড়া মেজাজ টমাস-এ-বেকেট-কেও ছাড়িয়ে যায়। নানা সব নামী-দামি মন্দিরে সারাদিনের যে আমদানি তার জিম্মেদার হচ্ছে সেখানকার বড় পুরোহিত। তাকে আবার অন্য পাণ্ডাদের কাছে হিসেব দাখিল করতে হয়।” এ রকম দু’একটি অংশে পাঁচকড়ির পেছনে যেন ওয়েট সাহেবকে উঁকি দিতে দেখা যায়।
অরিন্দম দাশগুপ্তর এই অনুবাদ এবং সম্পাদনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ঔপনিবেশিক আমলে শাসন চালানোর কাজে ‘নেটিভ ইনফর্মান্টস’-দের ভূমিকা নিয়ে ঐতিহাসিক গবেষণা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-প্রসূত এ রকম দলিল খুব বেশি আমাদের হাতে আসে না। এর আগে মিয়াজান দারোগার একরারনামা নামে আরেকটি দুর্লভ গ্রন্থ তিনি অনুবাদ এবং সম্পাদনা করেছেন। এমন সব পুরনো আকরগ্রন্থ সহজলভ্য করে তোলার জন্য অরিন্দম ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের ধন্যবাদার্হ।
কিন্তু একটু অস্বস্তি থেকে গেল। এটা বোঝা গেল যে আকছার ফারসি শব্দের ব্যবহারের উদ্দেশ্য হল অনুবাদটি সময়-গন্ধি করে তোলা। কিন্তু এ জাতীয় শব্দের বাহুল্য অনেক সময়ই পড়া বিঘ্নিত করে। কিছু শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আরও অনেক শব্দের অর্থ দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কখনও কখনও এমনও মনে হয়েছে যে অনুবাদকের বক্তব্যের মর্মোদ্ধারের জন্য মূল ইংরেজি গ্রন্থটির সাহায্য জরুরি হয়ে পড়ছে।
‘তর্জমা নিয়ে দু’ চার লব্জ’-তে অরিন্দম জানিয়েছেন যে শুভেন্দু মুণ্ড দাবি করেছেন এই বইটিই ইংরেজি ভাষায় কোনও ভারতীয়ের লেখা প্রথম উপন্যাস। অরিন্দম শুভেন্দুর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন এই বলে যে শৈলী বিচারের কোনও অর্থেই ‘ঝাঁকিদর্শন’-কে উপন্যাস বলা চলে না। সে তো বলা চলেই না, কিন্তু তার থেকেও বড় আপত্তির বিষয় হতে পারত যে এ বই তো কোনও ভারতীয়ের লেখাও নয়। পাঁচকড়ি ভারতীয় হতে পারে। কিন্তু, ইউরেশীয় ওয়েট সাহেব ভারতে থাকা ও ভারতের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা গভীর ভাবে অনুভব করা সত্ত্বেও, নিজেকে ঠিক ভারতীয় ভাবতেন এমন সাবুদ মেলে না। আর একটা কৌতূহল থেকে গেল, রিভিলেশনস অব অ্যান অর্ডার্লি-র নাম ‘ঝাঁকিদর্শন’ কেন হল তা জানবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy