Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Book Review

পুঁথিচর্চার নানা দিক স্পর্শ করে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যচর্চার সুপরিচিত উল্লেখযোগ্য নাম।

সত্যবতী গিরি
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৯
Share: Save:

আলোচ্য গ্রন্থটি বাংলা পুঁথি ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে মূল্যবান সংযোজন। পুঁথিচর্চার বিভিন্ন দিকে অতীত ও বর্তমানের যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁদের মূল্যবান মননঋদ্ধ আলোচনায় গ্রন্থ দু’টি সমৃদ্ধ। প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তুকে মোট ছ’টি বিষয়ে ভাগ করা হয়েছে। পুঁথি সম্পর্কিত বিশেষ আলোচনার প্রথমেই আছে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘হারিয়ে যাওয়া’। কম্পিউটার-শাসিত আধুনিক পৃথিবীতে পুঁথিচর্চার চূড়ান্ত হতাশাব্যঞ্জক অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর আছে তাঁর প্রবন্ধের শেষে। তাঁর আলোচনারও আগে ‘নিবেদনমিদং’ ও ‘প্রারম্ভে’ অংশে দুই সম্পাদকের প্রতিবেদনে পুঁথির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব ধরা পড়েছে।

প্রথম ভাগের ‘পুঁথি সম্পর্কিত বিশেষ আলোচনা’ অংশটির প্রত্যেকটি প্রবন্ধই অত্যন্ত মূল্যবান। রমাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর ‘পুঁথিপাঠ’ প্রবন্ধে পুঁথিপাঠ ও পুঁথি সম্পাদনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। করুণাসিন্ধু দাসের প্রবন্ধে আমরা সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় রচিত পুঁথিচর্চা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা পাই। ‘ভারতীয় হিমালয়ের বিভিন্ন জনের বিচিত্র পাণ্ডুলিপি’ প্রবন্ধে সুনীতিকুমার পাঠক সিকিম, তিব্বত, ভুটান প্রভৃতি অঞ্চলের পুঁথির প্রকৃতি ও বিষয়বৈচিত্র সম্পর্কে অবহিত করেন। নীরদবরণ মণ্ডল তাঁর প্রবন্ধে বলেন পুঁথি বার বার পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। ত্রিপুরা বসুর আলোচনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পুরাণ অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রাজা বিশ্বসিংহের যে অভিমত উদ্ধৃত, তা আসলে সমগ্র ভারতবর্ষেরই বিদগ্ধ সচেতন মানুষের অনুবাদচর্চার গুরুত্ব সম্পর্কিত ধারণা।

দ্বিতীয় অংশ ‘পুঁথির পাতার শিল্পকলা’। এই অংশে দিলীপকুমার কাঞ্জিলাল একটি অজ্ঞাত পুঁথির পরিচয় দিয়েছেন। কল্পিকা চট্টোপাধ্যায়, বন্দনা মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন সেন, প্রণবরঞ্জন সাহা প্রমুখের গভীর বিস্তৃত আলোচনার বিষয়বৈচিত্র আমাদের বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করে। চর্যাপদের আলোচনায় সৈয়দ মোহাম্মদ সাহেদ, নির্মল দাসের চর্যাপদ সম্পর্কিত প্রবন্ধে চর্যাগীতির সটীক পুঁথিটি আকর-সম্পদ হিসাবে কতটা মূল্যবান তার পরিচয় রেখেছেন। এর আগে চর্যাপদের টেক্সটের সম্পাদনায় তাঁর বহু মূল্যবান সিদ্ধান্ত আমাদের সমৃদ্ধ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যচর্চার সুপরিচিত উল্লেখযোগ্য নাম। সঙ্কলনের ‘মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: পাটিগণিত চর্চা প্রসঙ্গ’ নামের প্রবন্ধেও তার নিদর্শন আছে। সনৎকুমার নস্কর ও অরুণকুমার মণ্ডলের প্রবন্ধ দু’টিও তাঁদের পুঁথিচর্চা ও প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের কালজ্ঞাপকতা নির্ণয়ে অত্যন্ত মূল্যবান। বিশ্বনাথ রায়ের মূল্যবান প্রবন্ধটিতে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনার সঙ্গে অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাসের মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গলের একটি শব্দকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তকে ভ্রান্ত বলা হয়েছে। কিন্তু যে কারণে তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম্মত, তাঁর নিজের সঠিক শব্দ নির্ধারণেও সেই একই ভ্রান্তির পরিচয় আছে বলে আমাদের মনে হয়। সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পুঁথি সম্পাদনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত আলোচনা করেছেন।

পুঁথির ইতিবৃত্ত, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড

সম্পা: অণিমা মুখোপাধ্যায়, অনিল আচার্য

১২০০.০০ (দুই খণ্ড একত্রে)

অনুষ্টুপ

সুমঙ্গল রাণা, সুনীল ওঝা ও শক্তিনাথ ঝা, মধ্যযুগের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও পুঁথিচর্চায় এই তিন জনের নামও অপরিহার্য। তাঁদের প্রত্যেকের পুঁথি সম্পর্কিত আলোচনা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও গবেষককে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করবে। পুঁথি বিশেষজ্ঞ পঞ্চানন মণ্ডলের কন্যা সুমিত্রা কুণ্ডু তাঁর পিতৃদেবের পুঁথি সংগ্রহ ও সাধনার ইতিহাস বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। সচ্ছল-সম্পন্ন পরিবারের সন্তান হয়েও পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর কঠোর পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধানে বহু পুঁথি সংগ্রহ করেন। কখনও তাঁকে এর জন্য বন্যার কবলে পড়তে হয়েছে, আবার কখনও বা পুঁথি দিতে অনিচ্ছুক গৃহস্থের থেকে তিনি কৌশলে পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। প্রধানত তাঁরই পরিশ্রমে বিশ্বভারতীর সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া, চিনা, তিব্বতি ও ইসলামি সাহিত্যের পুঁথি বিভাগের পুঁথি সংখ্যার চেয়ে বাংলা বিভাগের পুঁথির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজে যে পুঁথিগুলি সম্পাদনা করেছেন সেগুলিও মধ্যযুগের সাহিত্যচর্চায় অমূল্য সম্পদ। পঞ্চানন মণ্ডল এবং আরও অন্য অনেকের মাতৃভাষার এই লুপ্ত রত্ন উদ্ধারের প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে পরবর্তী গবেষকদের উৎসাহিত করে। পুঁথিসংগ্রহ ও সমস্যার কথা আমরা পঞ্চানন মণ্ডলের প্রচেষ্টাতেই জেনেছি। এই বিষয়ে বিশ্বরঞ্জন ঘোড়ুইয়ের প্রবন্ধটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

যূথিকা বসু ভৌমিক বাংলা পুঁথির পুষ্পিকা নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান গবেষণা করছেন। পুঁথির ইতিবৃত্ত-এর শেষ প্রবন্ধ ‘ঘরোয়া কথা পুষ্পিকা পরিচয়’-এর মধ্যেও তাঁর সেই গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। পুষ্পিকার মধ্যে শুধু পুঁথি ও পুঁথির লিপিকরের পরিচয় থাকে না, সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতির চিহ্নও পুঁথি শেষের পুষ্পিকায় পাওয়া যায়। লিপিকর এবং পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণকারীদের কাছে পুঁথি যে কী অমূল্য সম্পদ রূপে বিবেচিত হত তার পরিচয়ও পুঁথির পুষ্পিকায় পাওয়া যায়। পুঁথি হরণকারীদের কঠোর অভিশাপ দিয়ে তাঁরা পুঁথি চুরি থেকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন।

পুঁথির ইত্তিবৃত্ত: ২য় খণ্ড-এর প্রথম অংশে নতুন পুঁথির আলোচনায় জ্যোৎস্না চট্টোপাধ্যায়ের ‘সীতার বারমাস্যা’, অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আত্মবিবরণীর নতুন পুঁথি’ প্রবন্ধ দু’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নন্দকুমার রায় ও বিমলকুমার থান্ডারের প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। এই পর্বে দিলীপকুমার কাঞ্জিলালের প্রবন্ধটির কথা বিশেষ ভাবেই উল্লেখ করতে হয়। ভারতবর্ষে চিত্রাণুগোলক বা স্ক্রোল প্রিন্টিং-এর ইতিহাসসমৃদ্ধ এই প্রবন্ধটিতে বৃত্তাকার মণ্ডলের মধ্যে আঁকা চিত্রগুলি রাজপুত চিত্রশৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। বহু প্রাচীন কাল থাকেই এর উৎপত্তি, আবার সপ্তদশ শতাব্দীতে এর কারণহীন বিলুপ্তি। এই সঙ্কলনে মুসলিম পুঁথি সম্পর্কে সম্পদকুমার ভট্টাচার্য ও সুরঞ্জন মিদ্দের মাত্র দু’টি আলোচনা পাওয়া যাচ্ছে। দু’টিই বিষয়বস্তুর গৌরবে সমৃদ্ধ।

অণিমা মুখোপাধ্যায়ের ‘পুঁথির পাতার বর্ণ, শব্দ ও লিপি বৈচিত্র’ শিরোনামের প্রবন্ধটি যে কোনও পুঁথি গবেষকদের ও সাধারণ পাঠকের কাছেও অত্যন্ত মূল্যবান একটি আলোচনা। কল্যাণকিশোর চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটিতে পুঁথির লিপি সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে সেই আলোচনা গবেষকদের শুধু লিপি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা তৈরি করে দেওয়া ছাড়াও পুঁথিপাঠের কাজে সহায়তা করবে। পরবর্তী অংশে পুঁথিচর্চাকারী উনিশ ও বিশ শতকের কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। এটি ছাত্রছাত্রীদের পুঁথিচর্চা ও পুরাতন সাহিত্যের গবেষণায় আগ্রহী করবে।

‘পরিশিষ্ট: খ’ অংশে এই পুঁথি বিশারদদেরই গুরুত্বপূর্ণ এক-একটি প্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়েছে। এর সব ক’টি প্রবন্ধ সহজলভ্য নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সাধারণ পাঠক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীরা পুরনো প্রবন্ধের এই সঙ্কলনে সমৃদ্ধ হবেন। ‘পরিশিষ্ট: গ’-তে বাংলা পুঁথি পঞ্জিকরণের ইতিহাসে প্রণবকুমার সাহা পুঁথি পঞ্জিকরণের কালানুক্রমিক গ্রন্থ তালিকা প্রস্তুত করেছেন। এই তালিকার সময়-পরিসর দীর্ঘ, ১২৪৫ থেকে ১৪২২ বঙ্গাব্দ। তিন শতাব্দী জুড়ে তৈরি হওয়া বাংলা পুঁথির গ্রন্থতালিকার এই বিবরণ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মূল্যবান। এর বাইরেও হয়তো বাংলার মন্দিরে বা বৈষ্ণব শ্রীপাঠগুলিতে অন্য তালিকা অথবা এই তালিকাগুলিতে অসংযুক্ত পুঁথি থেকে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় জুড়ে তৈরি হওয়া পুঁথির তালিকাগুলি প্রস্তুত করা পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এর পরেও ‘পরিশিষ্ট: ঘ’-তে পুঁথির অনুষঙ্গি শব্দটীকা যুক্ত হয়েছে। আর সব শেষে আছে লেখক পরিচিতি।

এর আগে উভয় বঙ্গেই আমরা পুঁথি সম্পর্কে সমৃদ্ধ কিছু আলোচনা গ্রন্থ পেয়েছি, কিন্তু এই ভাবে বাংলা পুঁথির নানা দিক স্পর্শ করে বৃহদায়তন এই খণ্ড দু’টির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্পাদকদ্বয়কে ধন্যবাদ, তাঁরা পুরাতন বাংলা সাহিত্যের প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ ও অনুরাগ থেকে এই মহার্ঘ খণ্ড দু’টি বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সাধারণ পাঠক, ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের উপহার দিয়েছেন। গ্রন্থের প্রচ্ছদ শুধু নয়নাভিরাম নয়, বিষয়ের সঙ্গেও সঙ্গতি রেখেছে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা উল্লেখ করতে হয়, গ্রন্থের প্রচ্ছদে সম্পাদক অণিমা মুখোপাধ্যায়ের নামের বানান ‘স্পাইন’ অংশে পরিবর্তিত হয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Ancient Pamphlet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy