সংযোগ: মদনপল্লে থিয়োসফিক্যাল কলেজ (এখন বেসান্ত থিয়োসফিক্যাল কলেজ)
শীর্ষেন্দু মজুমদার সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড জেমস হেনরি কাজ়িনস: আ কনভার্সেশন ইন লেটারস, ১৯১৫-১৯৪০ গ্রন্থটি রবীন্দ্রচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ এক অবদান। পত্রাবলিটিও মনোরম, দুই বন্ধুর মধ্যে যেমন প্রত্যাশা করা যায়। পত্রসংখ্যা খুব বেশি না হলেও এই পত্রবিনিময়ে রয়েছে কাজ়িনস (১৮৭৩-১৯৫৬) ও রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী কাজ ও প্রেরণা সম্বন্ধে সংবেদনশীল মানসিকতা। পরস্পরের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ওঁদের বিশ্ববোধ, সেই সঙ্গেই দর্শন ও শিক্ষা, কাব্য ও শিল্প বিষয়ে দুই জনের আগ্রহ ও চিন্তাধারা। ওঁদের দুই জনের বিনিময় ছিল সূক্ষ্ম ও কোমল। দুই জনেই কবি, দুই জনেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, দুই জনের বন্ধুমহলে ছিলেন কয়েক জন পূর্বপরিচিত ব্যক্তি, যেমন ডব্লিউ বি ইয়েটস, এ ই বা জর্জ রাসেল, সর্বোপরি অ্যানি বেসান্ত। ওই মহলে আগে থেকেই সঙ্গতি ছিল আদর্শে ও কাজে, চিন্তায় ও দর্শনে।
জেমস কাজ়িনস-এর বিষয়ে আমরা যে খুব বেশি জানি, তা নয়। উনি এবং ওঁর স্ত্রী মার্গারেট কাজ়িনস দীর্ঘ দিন ভারতে ছিলেন। ওঁদের যৌথ আত্মজীবনী, উই টু টুগেদার পড়লে আমরা জানতে পারি, ওঁরা ভারতকে কত ভালবেসেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের নাগরিক ও থিয়োসফিস্ট জেমস হেনরি কাজ়িনস ১৯১৫ সালে অ্যানি বেসান্তের আমন্ত্রণে মাদ্রাজে আসেন এবং সেখানকার থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির কাজে নিযুক্ত হন। মিসেস বেসান্তের সৃষ্টি নিউ ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। তার পরে ১৯১৮ সাল থেকে মদনপল্লে থিয়োসফিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষপদে প্রতিষ্ঠিত হন। সেই বছরেই প্রকাশিত হয় কাজ়িনস-এর লেখা দ্য রেনেসাঁস ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থটি। ১৯২২ থেকে কাজ়িনস আদিয়ার-এর ব্রহ্মবিদ্যা আশ্রমের অধ্যয়ন চর্চা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিশ্বভারতীর সংসদে সদস্যপদে মনোনীত হন। কাজ়িনসকে বিশ্বভারতীর কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ভারতে আসার পর পরই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ়িনস-এর যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় আসেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এর বার্ষিক প্রদর্শনী দেখতে। প্রদর্শনী দেখে পরের দিনই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। শিল্পকলার সমঝদার ছিলেন কাজ়িনস, ভারতের প্রাচীন শিল্পকলার প্রতি তাঁর বিশেষ কৌতূহল ছিল। ওই প্রদর্শনীর একটা সমালোচনা লিখে নিউ ইন্ডিয়া-য় প্রকাশ করেন, সেই সংখ্যাটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠান। এ ভাবে শুরু হয় তাঁদের পঁচিশ বছরের আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব।
এ বারে আসি ওঁদের পত্রাবলির বিষয়বস্তুতে। স্বল্পাকারে হলেও সেই যুগের কিছু জটিল সমস্যার আলোচনা রয়েছে এই পত্রাবলিতে। দু’টি মূল বিষয়ে উল্লেখ করছি। একটি যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সেই সূত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত করার প্রবণতার বিষয়ে মতবাদ। আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের কিছু আগেপরে মানুষের জীবনে প্রথম মহাযুদ্ধের ঝড় এসে পড়েছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ থেকে কিছু শিক্ষা লাভ হয়েছে। ১৯১৪-তে কাজ়িনস লেখেন তাঁর ওয়র: আ থিয়োসফিক্যাল ভিউ। ১৯১৬-১৭’তে রাষ্ট্রশাসনাধীন জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে, উচ্চারিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজ়ম গ্রন্থে এবং বক্তৃতামালায়। একমত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে কাজ়িনস লিখেছেন, “আই হু হ্যাভ লিভড থ্রু অ্যান্ড এসকেপড ফ্রম ‘দ্য নেশন’ নো হাউ ক্লোজ় টু ট্রুথ ইউ হ্যাভ গট।” (কাজ়িনস টু টেগোর, ২৬ জুলাই ১৯১৭, পৃ ৭৩-৭৪)
একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন জর্জ রাসেল বা এ ই (১৮৬৭-১৯৩৫), অর্থাৎ দেশ দখল করার রাজনীতির বিরুদ্ধে পাশাপাশি তুলে ধরেছেন সমবায় নীতির আদর্শ ও উপকারিতা; ওঁদের আলোচনায় কৃষি সমবায়ের প্রয়োজনীয়তার কথা উত্থাপন করা হয়। রাসেল-ই ছিলেন আয়ারল্যান্ডের সমবায় আন্দোলনের স্রষ্টা। শ্রীনিকেতনের কৃষি সমবায়ের কাজে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে রাসেলের সাহায্য চেয়েছিলেন, আয়ারল্যান্ডের এগ্রিকালচারাল কোঅপারেশন মুভমেন্টের অভিজ্ঞতা ভারতে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কাজ়িনসকে তাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “আই অ্যাম শিয়োর ইউ উইল বি এবল টু হেল্প আওয়ার বিশ্বভারতী বাই দি এক্সপিরিয়েন্স ইউ গেন ইন ইয়োর ইউরোপিয়ান টুর। উই স্পেশালি ওয়ান্ট ইউ টু স্টাডি এগ্রিকালচারাল কোঅপারেশন ইন আয়ারল্যান্ড অ্যান্ড লেট আস নো হাউ ফার ইটস মেথডস ক্যান বি অ্যাডাপটেড টু আওয়ার ইন্ডিয়ান কন্ডিশন। উই শ্যাল বি ভেরি থ্যাঙ্কফুল টু ইউ ইফ ইউ ক্যান পারসুয়েড সাম এক্সপিরিয়েন্সড ম্যান হু হ্যাজ় ওয়ার্কড উইথ এ ই, টু কাম অ্যান্ড হেল্প আস ইন আওয়ার ভিলেজ ওয়ার্ক ফর অ্যাবাউট সিক্স মান্থস, অর লঙ্গার ইফ ইট ইজ় পসিবল।” (টেগোর টু কাজ়িনস, ১৯২৩, পৃ ৯৩)
কাজ়িনসকে রবীন্দ্রনাথ অনুরোধ করেছিলেন অন্তত দু’এক বছরের জন্য বিশ্বভারতীতে এসে থাকতে। কাজ়িনসও সেই রকমই চেয়েছিলেন। তবে দুই পক্ষেরই কিছু না কিছু অসুবিধার জন্য তা সম্ভব হয়নি। দুই জনের বিশ্ববোধে অসাধারণ সমন্বয় ছিল, সময়ের সঙ্গে যা আরও গভীর হয়ে ওঠে। কাজ়িনস লিখেছিলেন, বিশ্বভারতীর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রাণসত্তা, ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পিরিট’ (পৃ ৯১)।
‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানটির সবচেয়ে বেশি প্রচার হয়েছিল মদনপল্লে থিয়োসফিক্যাল কলেজ থেকে। ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে কাজ়িনস লেখেন, “ডিয়ার গুরুদেব, এভরি ওয়ার্কিং মর্নিং ‘জনগণমন’ ইজ় সাং বাই হানড্রেডস অব ইয়ং পিপল ইন আওয়ার বিগ হল। উই ওয়ান্ট টু এক্সটেন্ড ইটস পিউরিফাইং ইনফ্লুয়েন্স বাই সেন্ডিং কপিজ় অব ইট টু আদার স্কুলস অ্যান্ড কলেজেস ইন ইন্ডিয়া, অ্যান্ড বাই মেকিং ইট নো অ্যাব্রড। আই সেন্ড ইউ আ কপি অব আ লিফলেট গিভিং ইটস ফার্স্ট টু স্ট্যানজ়াস। বিফোর আই ব্রডকাস্ট দেম আই অ্যাম ইন ডিউটি বাউন্ড টু রিকোয়েস্ট ইয়োর পারমিশন টু ডু সো।” (কাজ়িনস টু টেগোর, ২৩ জুলাই ১৯৩৪, পৃ ১০২)
রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড জেমস হেনরি কাজ়িনস: আ কনভারসেশন ইন লেটারস, ১৯১৫-১৯৪০
সম্পা: শীর্ষেন্দু মজুমদার
৯৯৫.০০
রাটলেজ ইন্ডিয়া
শেষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পত্রটির কথায় আসি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার খুব ভক্ত ছিলেন কাজ়িনস। আগেই উল্লেখ করেছি ওঁরা দু’জনেই কবি। কাজ়িনসের কাব্য বোধ করি রবীন্দ্রনাথ মনে ধরেছিলেন। বলাকা-র ৮ নম্বর কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করে কাজ়িনসকে পাঠিয়েছিলেন। তার একটা ব্যাখ্যা করেছিলেন কাজ়িনস-এরই উদ্দেশে। সাধারণত রবীন্দ্রনাথ কবিতার বিশ্লেষণ করতেন না, যেন একটু বিরক্ত হতেন কেউ কবিতার মানে বা তাৎপর্য জিজ্ঞেস করলে। আমার এই প্রিয় পত্রটি কিন্তু এর ব্যতিক্রম। বলাকা কাব্য সঙ্কলনের ৮ নম্বর কবিতাটির পর পর দু’টি অনুবাদ করে কাজ়িনসকে পাঠান। অনুবাদ করেছিলেন দ্য ফিউজিটিভ কাব্যগ্রন্থের জন্য। দু’টি অনুবাদে কিছুটা তফাত ছিল, কারণ নিজের ইংরেজির বিষয়ে বরাবর সংশয় ছিল বলে খুব সাবধানে অনুবাদ করতেন। সে কথা এই চিঠিতে রয়েছে। কিন্তু যেটা অমূল্য ও ব্যতিক্রমী, তা হল কাজ়িনসকে জোরালো ইংরেজিতে ও মন খুলে কবিতাটির ব্যাখ্যা করেছিলেন। লিখেছিলেন, আমাদের চলমান জীবনের যা শাশ্বত, যা অক্ষয়, যা অনন্ত, তাই নিয়ে তাঁর এই কবিতা। “দ্য সাবজেক্ট অব মাই পোয়েম ইজ় দ্য এভারমুভিং স্পিরিট অব এগজিসটেন্স হুজ় বডি ইজ় দি ইনফাইনাইট সিরিজ় অব চেঞ্জিং ফর্মস।” (টেগোর টু কাজ়িনস, ৫ মার্চ, ১৯১৮, পৃ ৭৮)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy