অধিকার: শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েরা। রামপুরহাটে একটি নবজাতক কেয়ার ইউনিটের সূচনায় Sourced by the ABP
অধ্যাপক জেরাল্ডিন ফোর্বস মানবীবিদ্যা চর্চা ও ভারতে নারীর ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গবেষকদের শুধু অনুপ্রেরণাই নন, পথপ্রদর্শকও বটে। সম্পাদকদ্বয় বইটির মুখবন্ধেই ভারতে নারীর ইতিহাসের যাত্রাপথের গতিপ্রকৃতি বিশদে বর্ণনা করেছেন। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের আগে মূলত রাজনীতি, কূটনীতি, রাষ্ট্রযন্ত্র ও অর্থনীতি নিয়েই ইতিহাস রচনার প্রচলন ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে নারীরা অজ্ঞাতই ছিলেন, কারণ তা লিঙ্গ-পক্ষপাতে নিমজ্জিত। নারীর ভূমিকা এ ভাবে অলক্ষ্য ও প্রান্তিক করে তোলার প্রবণতার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই গণপরিসরে নারীর সক্রিয় ভূমিকা পুনরুদ্ধার করে ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা শুরু করেন নারীর ইতিহাস লেখা ইতিহাসবিদরা। পরিস্থিতি সংশোধনের আশায় ইতিহাসের কালপঞ্জি ও পর্যায়ক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেন, দৃষ্টিভঙ্গির আমূল রূপান্তর ও পুনর্গঠনের প্রয়াস শুরু করেন তাঁরা। উদ্দেশ্য ছিল আপাততুচ্ছ মেয়েদের সাবেক গার্হস্থ জীবন— তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবসরযাপন, রন্ধনশৈলী, যৌনতা, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, ‘মেয়েলি’ প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের জগৎ— থেকে ইতিহাসের রসদ খুঁজে নেওয়া। তাঁরা মেয়েদের ডায়েরি, চিঠি, নোটবুক, স্মৃতিকথা, ছবি, সৃষ্টিশীল লেখা, মৌখিক সাক্ষ্য ইত্যাদিকে গবেষণার অঙ্গনে ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের পরিধিতে নিয়ে আসেন।
আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে প্রবন্ধগুলিকে। প্রথম বিভাগের সূচনায় অধ্যাপক ফোর্বস জানিয়েছেন, কতটা দুরূহ ছিল প্রাথমিক ভাবে ভারতীয় ইতিহাসে লিঙ্গ-বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিক অসমতা নিরসন করে মহিলাদের অবদানের গুরুত্ব বোঝানো। এই বিভাগেই স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়, সংযুক্তা দাশগুপ্ত, তপতী সেনগুপ্ত, সোনিয়া নিশাত আমিন ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করেছেন ফোর্বসকে নিয়ে।
দ্বিতীয় বিভাগে রয়েছে ‘উপেক্ষিত মহিলা’দের কথা— যাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসে তাঁদের কীর্তি অদৃশ্য ও অজ্ঞাতই থেকে গিয়েছে। বৈদিক যুগের ‘দাসী’দের নিয়ে লিখেছেন কণাদ সিংহ। ঋগ্বেদে একত্রিশ জন মহিলা কবির নাম পাওয়া যায়। মৌ সরকার তাঁদের মধ্যে চোদ্দো জন, যেমন অপালা, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারাকে আসল ঐতিহাসিক চরিত্র বলে চিহ্নিত করেছেন। উত্তরা চক্রবর্তী বিশ শতকের ত্রিশের দশকের বিভিন্ন মহিলার— সতী গুপ্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, ফজিলতুন্নিসা, ইমাম আখতার— স্মৃতিচারণা, ডায়েরি, চিঠি থেকে বদলে যাওয়া সময়ের প্রতি মেয়েদের যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তাঁরা যে ভাবে সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছিলেন, তা ধরার চেষ্টা করেছেন। টুম্পা মুখোপাধ্যায় ‘রায় বাড়ি’র তিন প্রজন্মের বৌমা— বিধুমুখী, সুপ্রভা, পুষ্পলতা ও বিজয়াকে ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরেছেন।
তৃতীয় বিভাগ ‘লিঙ্গায়িত অতীত অনুসন্ধান’-এ জাতকের গল্প ভিত্তি করে প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থান নিয়ে লিখেছেন তানিয়া রায়; বিজয়নগর সাম্রাজ্যে অভিজাত মহিলা, মধ্যবিত্ত মহিলা, শ্রমিক মহিলা, মন্দিরের নর্তকী, গণিকাদের নিয়ে লিখেছেন রেখা পাণ্ডে; ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক উন্নতি ও নারী শিক্ষায় ব্রাহ্ম মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন রচনা চক্রবর্তী; আর আদর্শ ভদ্রমহিলার ভাবমূর্তি গঠনের জন্য মহিলাদের পোশাকের গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন দেবশ্রী সরকার।
চতুর্থ বিভাগ ‘ওষুধ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা’ নিয়ে। সুজাতা মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক স্বাস্থ্য উদ্যোক্তারা কী ভাবে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় নারীর প্রজনন, শিশু ও তাদের মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঔপনিবেশিক জনস্বাস্থ্য উদ্যোগের নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল হাসপাতালে ওষুধের দ্বারা নিরাময়মূলক চিকিৎসার অনুশীলন, মা এবং শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে প্রচার। মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যেই বেশ কিছু হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘিরে নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, এমনটাই মনে করেন শমিতা সরকার। অসুস্থ ও দুর্দশাগ্রস্ত মহিলাদের রক্ষা করার আদর্শ নিয়ে কী ভাবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দিকে মহিলারা নার্সিং-কে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন, তা দেখিয়েছেন অপরাজিতা ধর।
ভ্রমণকাহিনি ও আত্মজীবনী লিখে, মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে মহিলারা কী ভাবে আত্মগঠন করেছিলেন, সে বিষয়ে প্রবন্ধের সঙ্কলন পঞ্চম বিভাগ ‘আত্মগঠন প্রক্রিয়া সম্পাদন’-এ। ১৯৩৬-এ প্রকাশিত দুর্গাবতী ঘোষের ইউরোপ ভ্রমণ নিয়ে লেখা পশ্চিম যাত্রীকি ‘আপন’ বনাম ‘পর’ প্রতর্ক নির্মাণের নিরিখে পড়েছেন সীমন্তী সেন। রেণুকা রায়, মণিকুন্তলা সেন, ফুলরেণু গুহ, অশোকা গুপ্ত, কনক মুখোপাধ্যায় প্রমুখের আত্মজীবনী পাঠের মাধ্যমে ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায় তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব গঠন দেখিয়েছেন, স্বাধীন ভারত গঠনে তাঁদের সমালোচনামূলক সদর্থক ভূমিকার কথাও লিখেছেন। উনিশ ও বিশ শতকে বাংলা থিয়েটারের সফল অভিনেত্রীদের ব্যক্তিজীবন কী ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রত্যাখ্যানের সাক্ষ্য ছিল, এবং তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত ঘর ও সংসার কেন অধরাই রয়ে যায়, তা নিয়ে লিখেছেন সুনেত্রা মিত্র। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর থিয়েটার গ্রুপের অভিনেত্রীরা কেন ইতিহাসে অখ্যাত অজ্ঞাত রয়ে গেছেন, তা নিয়ে লিখেছেন সর্বাণী গুপ্তু।
ষষ্ঠ বিভাগ ‘শরীরে বন্দি’-তে অপর্ণা বন্দোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, সহবাস সম্মতি বিল ১৮৯১ প্রণীত হলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর সম্মতির কোনও অবকাশ ছিল না, কারণ হিন্দু বিবাহের ভিত্তিই ছিল নারী ও পুরুষের অসম্মতিমূলক, অদ্রবণীয়, অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। কেশবচন্দ্র সেনের স্ত্রী জগন্মোহিনী দেবী ও প্রকাশ্চন্দ্র রায়ের স্ত্রী অঘোরকামিনী দেবী কী ভাবে নিজ শারীরিক কামনা উপেক্ষা করে ব্রাহ্ম সমাজের ‘আধ্যাত্মিক বিবাহ’ মেনে নেন, তা নিয়েই নন্দিনী জানার প্রবন্ধ।
সপ্তম বিভাগ ‘আন্তঃসম্পর্ক পন্থা’ নিয়ে। শমিতা সেন ১৯২০-১৯৪০ সময়ে বাংলার পাটশিল্পের প্রেক্ষাপটে লিঙ্গ, সম্প্রদায় ও শ্রেণির জটিল সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। অভিষেক বিশ্বাস স্বাধীনতা-উত্তর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গে দলিত মহিলাদের অনালোচিত নিপীড়নের আখ্যান নিয়ে লিখেছেন নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়ায় অভিবাসিত মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে।
অষ্টম বিভাগ ‘ঘর ও বাহির’ নিয়ে। সুতপা সেনগুপ্ত দেখিয়েছেন, গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলন সূত্রে মহিলারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত হলেও তিনি মনে করতেন না যে, তাঁরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নেতৃত্ব প্রদানের উপযোগী। পাটশিল্পের ধর্মঘটই হোক বা গান্ধীবাদী রাজনীতি বা অগ্নিযুগ, পিতৃতান্ত্রিক নেতৃত্ব মহিলাদের প্রথাগত ভূমিকাতেই দেখতে চেয়েছিল, মত তনিকা সরকারের। কমলা দাশগুপ্তের লেখা রক্তের অক্ষরে-তে আত্মনির্মাণ, প্রতিরোধের রাজনীতি ও স্মৃতি কী ভাবে সম্পৃক্ত, লিখেছেন শ্রেয়া রায়। তিস্তা দাসের প্রবন্ধটি বোঝার চেষ্টা করে, উদ্বাস্তু নারী, উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করা নারী বা উভয়েই যে ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা দেখিয়েছিলেন, তা কী ভাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বামপন্থী ‘হাই পলিটিক্স’-এর দ্বিতীয় স্তর তৈরি করেছিল। ১৯৯৬-এর সংসদীয় রাজনীতিতে মহিলা সংরক্ষণ বিলের সূত্রপাত যে ঔপনিবেশিক ভারতে, এবং তার দরুন যে রাজনৈতিক জটিলতা ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে লিখেছেন মেরি ই জন।
কিছু পুনর্মুদ্রণ যেমন আছে, তেমনই আছে বহুচর্চিত বিষয় নিয়ে লেখা। এই সঙ্কলন দমবন্ধ করা লিঙ্গবাদ থেকে ইতিহাসকে মুক্ত করবে, মহিলাদের বৃহত্তর দৃশ্যমানতার যাত্রা সহজতর করবে। ইতিহাসে নারীদের অস্পষ্ট ভূমিকাকে প্রকট করা, তাঁদের কণ্ঠস্বর ও এজেন্সি পুনরুদ্ধার করা, দৈনন্দিন জীবনে পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নের প্রতিরোধগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা এই সময়েও যে সমান জরুরি, মনে করিয়ে দেয় এই বই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy