ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছিলেন, ভারতবর্ষে সাহিত্য সংগ্রহের সূচনা এই বঙ্গভূমিতে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন ন’শো থেকে হাজার বছর আগে শতাধিক কবির কবিতা নিয়ে সঙ্কলিত কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়। অনুমান, এটি সঙ্কলন করেন বৌদ্ধ পণ্ডিত বিদ্যাধর। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রীধরদাস সঙ্কলন করেছিলেন সদুক্তিকর্ণামৃত। পরে ধীরে ধীরে অন্য প্রদেশেও সঙ্কলনের কাজ শুরু হয়। ষোলো শতকে শ্রীরূপ গোস্বামী পদ্যাবলী-তে ভক্ত কবিদের রচনা সঙ্কলন করেন। আর রবীন্দ্রনাথ ১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেন পদরত্নাবলী। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা— সঞ্চয়ন-প্রতিভা বাংলার এক বিশেষত্ব। ২০২৪-এ ইংরেজি অনুবাদে অরুণাভ সিংহ সম্পাদিত বাংলা ছোটগল্পের একটি সংগ্রহ হাতে এল। রবীন্দ্রনাথের কথায় নতুন করে সিলমোহর পড়ল।
বর্তমান সঙ্কলনটি কোনও বিশেষ সময়পর্বের গল্প নিয়ে নয়, বিশেষ কোনও গল্প আন্দোলন ঘিরেও নয়। এটি এ-যাবৎ প্রকাশিত সমস্ত বাংলা গল্পের মধ্য থেকে নির্বাচিত এক সঙ্কলন। বেশ বিস্তৃত এক সময়কাল। ১২৯১ বঙ্গাব্দের কার্তিকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘ঘাটের কথা’ দিয়ে আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের সূচনা, এটিই সাধারণ মত। তার আগে সলতে পাকানোর ইতিহাস নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু যত ক্ষণ না সন্ধের প্রদীপ জ্বলছে, সংসার বা সাহিত্যের শাঁখে ফুঁ পড়ে না।
দ্য পেঙ্গুইন বুক
অব বেঙ্গলি শর্ট স্টোরিজ়
সম্পা: অরুণাভ সিংহ
১২৫০.০০
পেঙ্গুইন ক্লাসিকস
‘ঘাটের কথা’কে উৎস ধরার অন্য এক তাৎপর্যও আছে। ১৮২৯-এ সতীদাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, ১৮৫৬-তে বিধবাবিবাহ আইনের সমর্থন পায়। তার আটাশ বছর পর, ১৮৮৪-তে যুবক রবীন্দ্রনাথ শোনান, বিধবা কুসুম ধর্মকথা শুনতে গিয়ে যৌবনের আকুতিতে এক সন্ন্যাসীর প্রেমে পড়েছে। সে কাহিনির সূত্রেই ছোটগল্প শিল্পরূপটি বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠা পেল। শাস্ত্রকথার বাইরে নতুন সময় ও রূপান্তরিত সমাজ এক ভিন্ন কথারূপ খুঁজছিল, রবীন্দ্রনাথ সেটি গড়ে তুললেন। সেই হিসাবে বাংলা গল্প বাঙালির রূপান্তরিত মনের কথাও। সেই একশো বত্রিশ বছরের সৃষ্টির ভিতর থেকে সাঁইত্রিশ জন লেখকের একটি করে গল্প বেছে নিয়েছেন সঙ্কলক। শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, শেষ সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে।
শুরুতে অরুণাভ একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকা লিখেছেন। সেখানে উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলন, বিশ শতকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন, মার্ক্সবাদী সাহিত্যের প্রসার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রসঙ্গ অল্প কথায় আলোচিত। এই সব ঘটনার কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংসারের অনেক কিছুই আমূল পরিবর্তিত হয়েছিল। দেশভাগের কারণে দেশের মানচিত্রই বদলে গেল, ছিন্নমূল মানুষের স্রোত বন্যার মতো ধেয়ে এল ও বয়ে গেল। এই সঙ্কলনে দেশভাগ-পরবর্তী ওপার-বাংলার গল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং সত্তর দশকের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের কথাও।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা ও দুর্ঘটনার মধ্যে কথাকারেরা বাঁচেন, আর সময়বিশেষে মারাও যান। গল্পের মূল রসদ মানুষজন সমাজ ও রাষ্ট্র-রাজনীতির মধ্যে বসবাস করে বলে তার ছাপ গল্পে পড়ে। তাই রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত জানা থাকলে সে সময়ের সাহিত্যকে বুঝতে সুবিধে হয়। তবে কোনও কোনও সমালোচক যে ভাবে তরবারি ও তার খাপের মাপে সমাজ-রাজনীতি ও কথাসাহিত্যকে মিলিয়ে দিতে চান, বিষয়টি ততখানি যান্ত্রিক নয়। আবার চার পাশ যখন খানিক থিতু থাকে, কথাকারেরা তখন ঘরের কথায় ফেরেন; ব্যক্তি-সম্পর্কের ক্ষেত্রটি গল্পে প্রাধান্য পায়। গত শতকের ষাটের দশকে তেমন এক লেখালিখির পরিসর তৈরি হয়েছিল, সে কথা ভূমিকায় সম্পাদক উল্লেখ করেছেন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও ভূমিকায় উল্লিখিত— গল্পের নির্মাণ ও শৈলী। নামে গল্প হলেও গল্প শুধু কাহিনি শোনায় না। তার মধ্যে কথার ভাব ও ভঙ্গির নানা পরীক্ষা লেখকেরা করে থাকেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সুর ও বাণীর যেমন এক ভারসাম্য থাকে, এও তেমনই। আবার ধ্রুপদী সঙ্গীতে কথাকে শুধুমাত্র ছুঁয়ে থেকে গায়ক সুরকে নানা পথে নিয়ে যান। গল্পকারেরাও তেমনই কথার চেয়ে কথনরীতির উপর বেশি জোর দিয়েছেন, কী বলব থেকে কেমন ভাবে বলব তা নিয়ে ভেবেছেন। অরুণাভ তাঁর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, নকশাল আন্দোলনের পর্বে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হল, তাকে প্রকাশকাল করতে লেখকেরা গল্প বলার পুরনো রীতি ছেড়ে নতুন রীতি তৈরি করলেন, আর ভাষাকে আরও মুক্ত ভাবে প্রকাশের প্রচেষ্টা দেখা গেল।
এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটুকুই বলার, সত্তর ও আশির দশকের বেশ আগেই রীতির সচেতন ও সাবালক রীতিচর্চা দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ও কমলকুমার মজুমদারের কথা বলতে হয়। পঞ্চাশের দশকে তা এক সম্মিলিত প্রয়াস হয়ে ওঠে, গল্পের ঘটনার বিন্যাস থেকে চরিত্র নির্মাণ, গল্পের নাম ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তার স্পষ্ট ছাপ পড়ে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মধ্যে তা বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। এই দশকেই বিমল করের ছোটগল্প: নতুন রীতি পত্রিকা কয়েকটি সংখ্যায় বেশ কিছু গল্প ছেপে আধুনিক বাংলা গল্পে নতুন আদল গড়ে দেয়। এই অনুবাদ সঙ্কলনে এঁদের কারও গল্প নেই বলে ওই সময়ের আঙ্গিকের রূপান্তরিত চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না। বরং রমানাথ রায়ের একটি গল্প সঙ্কলনে থাকায় ষাট দশকের শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের আদল ধরা পড়েছে।
সঙ্কলনটিতে লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পাদক কী রীতি অবলম্বন করেছেন তা উল্লেখ করেননি। গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন নীতি অবলম্বন করেছেন, জানাননি। তবে এ কথা বলেছেন যে, তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে সঙ্কলনটি তৈরি। ফলে তা নিয়ে কোনও তর্ক চলে না। শুধু এটুকুই বলার, তিনি গল্পকার নির্বাচনে বিশেষ নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করেননি। পরিচিত পথই অনুসরণ করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গল্পের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ বাংলা গল্প সঙ্কলনে যে গল্প চোখে পড়ে, অনেকটা সেগুলিই নির্বাচন করেছেন। যেমন শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’, পরশুরামের ‘পরশ পাথর’, বুদ্ধদেব বসুর ‘একটি জীবন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’, সমরেশ বসুর ‘আদাব’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’, শংকরের ‘পুরোহিত দর্পণ’ ইত্যাদি।
কয়েকটি তথ্যের বিষয়ে একটু সন্দেহ আছে। সম্পাদক ভূমিকায় ১৮৬৫-তে প্রকাশিত দুর্গেশনন্দিনী-কে প্রথম বাংলা উপন্যাস বলেছেন। অথচ টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়ে ১৮৫৮-র শেষ দিকে বই রূপে প্রকাশ পায়। বাংলা ১২৯৯ সালে ক্যানিং লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত লুপ্তরত্নোদ্ধার বা ৺প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলী-র যে ভূমিকা বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন, সেখানে তিনি আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসটিকে ‘আদি’ বলে উল্লেখ করেন। সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তিনি দু’হাজারের বেশি গানে সুর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও সুর নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা কিন্তু সংখ্যাটা দু’হাজারের কিছুটা নীচেই রেখেছেন। বলা হয়েছে শরৎচন্দ্র একাধিক নাটক লিখেছেন। সেগুলি কিন্তু মৌলিক নাটক নয়, তাঁর তিনটি উপন্যাসের নাট্যরূপ।
সঙ্কলনটির মধ্যে বাংলা গল্পের একটা বিস্তৃত সময় ধরা আছে। অবাঙালি পাঠকেরা একটি বইয়ের মধ্যে অনেকগুলি ভাল গল্পও পেয়ে যাবেন। সাঁইত্রিশটি গল্পের মধ্যে বত্রিশটিই অরুণাভ সিংহের নিজের অনুবাদ, এ বিষয়ে তাঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়। অন্য পাঁচটি গল্পের অনুবাদও খুবই ভাল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের একটি কোলাজ প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে। এক কথায় দৃষ্টিনন্দন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy