Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

বেদনা যখন আখ্যানের আধার

সূচনাপর্বের তাত্ত্বিক আলোচনার পর বইটির চারটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে কালিদাস-পূর্ব ভারতীয় সাহিত্যে শোক ও বিলাপের বর্ণনা ও ব্যবহার বিশদে আলোচিত হয়েছে।

বিরহতাপিত: পদ্মপাতায় দুষ্যন্তকে চিঠি লিখছে শকুন্তলা। রাজা রবি বর্মার ছবি। উইকিমিডিয়া কমন্স

বিরহতাপিত: পদ্মপাতায় দুষ্যন্তকে চিঠি লিখছে শকুন্তলা। রাজা রবি বর্মার ছবি। উইকিমিডিয়া কমন্স

কুণাল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ১০:০১
Share: Save:

শোক, বিশেষত বিচ্ছেদ-শোক, মানবমনে যে অভিঘাত সৃষ্টি করে তার তাৎপর্য বিহানী সরকারের নতুন বই ক্লাসিক্যাল স্যানস্ক্রিট ট্র্যাজেডি-র মূল আলোচ্য বিষয়। আলোচনার অবলম্বন হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের তর্কসাপেক্ষে শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের তিনটি কাব্য ও দু’টি নাটক। ট্র্যাজেডি বলতে যে বিশেষ শিল্পরূপটিকে বোঝায়, সংস্কৃত সাহিত্যে তা অনুপস্থিত— এটাই ছিল প্রচলিত মত। লেখক বলছেন, পাশ্চাত্য সাহিত্য আলোচনায় সঙ্কট, সংঘাত ও মানবজীবনের ব্যর্থতাকেন্দ্রিক যে বিয়োগান্ত কাহিনিগুলিকে ট্র্যাজেডি বলে নির্দেশ করা হয়, ঠিক তার অনুরূপ কোনও উদাহরণ হয়তো সংস্কৃত সাহিত্যে নেই। কিন্তু তীব্র শোকানুভূতির বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অভাব নেই। তবুও তা বিদ্বজ্জনের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি ‘দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি’র ফলে। লেখক বলছেন, কাহিনির শেষে বিচ্ছেদ না খুঁজে রচনার সামগ্রিক কাঠামোয় শোকানুভূতির স্থান এবং তা পরবর্তী আখ্যান আমাকে কী ভাবে প্রভাবিত, এমনকি নিয়ন্ত্রিত করে, সংস্কৃত সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার আলোচনা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। বর্তমান গ্রন্থটি এই অন্বেষণেরই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

সংস্কৃত দৃশ্য ও শ্রাব্য কাব্যের নায়ক-নায়িকারা (কোনও কোনও ক্ষেত্রে পার্শ্বচরিত্ররাও) শোকবিহ্বল হয়ে যে আক্ষেপ প্রকাশ করে, যাকে প্রকরণগত ভাবে বিলাপ বলা হয়, তার সূক্ষ্ম ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণই বইটির প্রধান উপজীব্য। লেখক বলছেন, ভারতীয় সাহিত্যে ট্র্যাজেডির অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, কিন্তু তা কাহিনির শেষাংশে নয়, মধ্যভাগে। তিনি একে চিহ্নিত করেছেন বিষাদ-মধ্য (ট্র্যাজিক মিডল) নামে। এই বিষাদ-মধ্য— মৃত্যু, বিপর্যয় ও দীর্ঘ অনুধ্যান যার প্রধান লক্ষণ— যেন পীড়াকাতর চরিত্রটির জন্য একটি পরীক্ষা (ট্রায়াল), যা সংস্কৃত রসশাস্ত্র ‘বিমর্শ’ বা ‘অবমর্শ’ নামে অভিহিত হয়েছে। বিষাদ-মধ্য কাহিনিকে এমন ভাবে খণ্ডিত করে, যাতে মনে হয় কাহিনিটি আর কখনওই তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। একই সঙ্গে এই দুঃখাত্মক অভিজ্ঞতা কাহিনির নায়ক এবং আখ্যানের চরিত্রটিরও রূপান্তর ঘটিয়ে দেয়। ভরতের নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী আখ্যানের শিল্পরূপের উপাদানসমূহ, যেমন ঘটনাক্রম (অবস্থা), কার্যসাধনের উপায় (অর্থপ্রকৃতি), এবং সঙ্কটমুহূর্ত (সন্ধি), এর মধ্যে বিমর্শ-সন্ধিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কালিদাস বিমর্শকে দ্বিধা বা প্রতিবন্ধক রূপে উপস্থাপিত করেন, যা কাহিনির অগ্রগতিকে বাধা দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে চরিত্রগুলির দার্শনিক উপলব্ধি ও বিকাশের মাধ্যমে কাহিনিকে তার নির্ধারিত সম্পূর্ণতা পেতেও সাহায্য করে।

ক্লাসিক্যাল স্যানস্ক্রিট ট্র্যাজেডি: দ্য

কনসেপ্ট অব সাফারিং অ্যান্ড পেথস

ইন মিডিয়েভাল ইন্ডিয়া

বিহানী সরকার

৮৫.০০ পাউন্ড

আই বি টরিস

সূচনাপর্বের তাত্ত্বিক আলোচনার পর বইটির চারটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে কালিদাস-পূর্ব ভারতীয় সাহিত্যে শোক ও বিলাপের বর্ণনা ও ব্যবহার বিশদে আলোচিত হয়েছে। যেমন পালি বেসান্তর জাতক-এ, রামায়ণ মহাকাব্য ও অশ্বঘোষ-এর সৌন্দরনন্দ আখ্যান-কাব্যে। এদের প্রতিটিতেই কালিদাস বর্ণিত শোকানুভূতির কিছু চরিত্রলক্ষণ প্রকাশিত, যা কালিদাস-উত্তরাধিকার, কিন্তু লেখক মনে করেন, কালিদাসের রচনায় শোকোপলব্ধির ব্যঞ্জনা ও সামগ্রিক তাৎপর্য তাঁর নিজস্ব, বরং তিনি শোকের মানচিত্র নির্মাণে দৈব মধ্যস্থতা ও অভিশাপের মতো এমন কিছু উপাদান যোগ করেন, পরবর্তী সাহিত্যে যা গভীর প্রভাব ফেলে। ভবভূতির উত্তররামচরিত-ই দুঃখাত্মক কাব্যের আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হয়। লেখক শেলডন পোলকের গবেষণা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌-এর সঙ্গে উত্তররামচরিত-এর মৌলিক সাদৃশ্য আছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে রঘুবংশম্‌-এর অজবিলাপ ও কুমারসম্ভবম্-এর রতিবিলাপ অংশ দু’টির বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিষাদের অভিব্যক্তির ক্রমপর্যায় আলোচিত হয়েছে। লেখক দেখাচ্ছেন, কালিদাসের প্রধান চরিত্রগুলি সঙ্কটাপন্ন হলে তাদের সত্তায় যেন একটা বনিয়াদি পরিবর্তন ঘটে। এতটাই যে, মনে হয় সে যেন আর সে নেই, অন্য কেউ। বিলাপ অংশটি ঘটনাক্রমের মধ্যে একটি দার্শনিক যতি যা কেন্দ্রীয় চরিত্রের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অনুঘটকের কাজ করে।

স্মৃতিবিভ্রম ও তৎসংক্রান্ত সমস্যা তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়। কালিদাসের মূল চরিত্রগুলি যখন পরীক্ষা-পর্বের মধ্য দিয়ে যায় তখন তারা বিভ্রান্ত ও অস্থির। কিন্তু আরও বেশি মনোবেদনার কারণ ঘটে যখন তারা তাদের লুপ্ত স্মৃতি ও চেতনা ফিরে পায়, কারণ তখন তারা কৃতকর্মের পাপবোধ সঞ্জাত অনুশোচনায় ভোগে। কিন্তু এই অনুতাপ তাদের পরিশুদ্ধ করে। রাজ-অঙ্গুরীয় সন্দর্শনে দুষ্যন্ত যখন শকুন্তলাকে নিজের স্ত্রী বলে চিনতে পারলেন তা শুধু বাহ্য পরিচয় নয়, আন্তরিক উপলব্ধি— প্রত্যভিজ্ঞা। অভাববোধ ও তজ্জনিত মর্মবেদনা ছাড়া দুষ্যন্তের এই রূপান্তর সম্ভব এবং বিশ্বাসযোগ্য হত না।

কালিদাসের নায়কেরা কখনও কখনও যুক্তিহীন ব্যবহার করে, যেমন তারা চেতন ও অচেতন পদার্থের মধ্যে প্রভেদ করতে পারে না। সাধারণত মেঘদূতম্-এর মতো সন্দেশকাব্যের নায়করাই এমন আচরণ করে থাকে তাদের এই মানসিক ভারসাম্যহীনতা অবশ্য সাময়িক, নিতান্তই প্রিয়বিচ্ছেদ-শোকপ্রসূত। চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচ্য তাই বিরহ-শোকের মনস্তত্ত্ব। লেখক দেখিয়েছেন, বিষাদ ও মনস্তাপের চরম সীমায় পৌঁছেও কিন্তু এই চরিত্রেরা জীবনের প্রতি আসক্তি হারায় না, যা তাদের এই বৈকল্য অতিক্রম করতে ও পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। সংস্কৃত সাহিত্যের ট্র্যাজেডির সঙ্গে গ্রিক ট্র্যাজেডির যে সব মৌলিক পার্থক্য আছে, এটি তার অন্যতম।

বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় খুব দুরূহ না হলেও বিশ্লেষণ জটিল ও গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ। কিন্তু লেখা প্রাঞ্জল বলে পাঠে তা বাধা সৃষ্টি করে না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করি, তিনি জর্জ এলিয়টের উপন্যাস, অ্যারিস্টটল ও উইলিয়াম জেমস-এর দর্শন, নরথ্রপ ফ্রাই-এর সাহিত্য সমালোচনা, বৈদিক ও পালি সাহিত্য, মীমাংসা ও ন্যায় দর্শন, জৈমিনির মীমাংসাসূত্র-র শবরভাষ্য, অভিনবগুপ্তর নন্দনতত্ত্ব, এবং বল্লভদেব ও অরুণগিরিনাথ-এর মতো কালিদাসের টীকাকারদের নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহার করেছেন। প্রদর্শনীর মতো শোনালেও এদের ব্যবহার যথোপযুক্ত। তারা আলোচনা প্রসঙ্গে এসেছে। আলোচনার অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে। স্বভাবতই গ্রন্থটি অনায়াসপাঠ্য নয়, পাঠকের মনোযোগ ও মনন দাবি করে। যাঁরা সেটা দিতে প্রস্তুত থাকবেন তাঁরা পুরস্কৃত হবেন।

একটি অপেক্ষাকৃত অবান্তর প্রসঙ্গের উল্লেখ করতেই হয়। শিরোনাম থেকে বইয়ের সর্বত্র লেখক কালিদাসকে মধ্যযুগের কবি বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতেতিহাসের যুগবিন্যাস ও তার যৌক্তিকতা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে গুপ্ত রাজত্বের অবসান পর্যন্ত সময়পর্বকে ইতিহাসবিদরা আদি-ঐতিহাসিক (আর্লি হিস্টোরিক্যাল) যুগ বলে নির্দেশ করে থাকেন। গুপ্তোত্তর সময়কাল থেকে আদি-মধ্যযুগের (আর্লি মিডিয়েভাল) সূচনা— এ বিষয়েও ইতিহাসবিদরা মোটামুটি সহমত। কালিদাস গুপ্তযুগে তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন, কাজেই তাঁকে মধ্যযুগের মানুষ বলা চলে না। লেখক অবশ্য তাঁর মতের সমর্থনে স্টাইন এবং কুল্কে ও রোটারমুন্ড-এর দু’টি পাঠ্যবইয়ের (টেক্সট বুক) উল্লেখ করেছেন। তিনি সম্ভবত লক্ষ করেননি যে, এঁরাও গুপ্ত রাজত্বকালকে মধ্যযুগের অন্তর্ভুক্ত করেননি। কতকগুলি সুনির্দিষ্ট চরিত্রলক্ষণ আদি মধ্যযুগকে একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব দেয় যা অবিমিশ্র মধ্যযুগের থেকে আলাদা। সবচেয়ে বড় কথা, কালিদাস যে গুপ্তযুগের কবি এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। লেখকও এই মতের বিরুদ্ধতা করেননি। সে ক্ষেত্রে বইটির বক্তব্যের নিরিখে কালিদাসের যুগনির্দেশের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। এই অনাবশ্যক বিতর্ক অযথা পাঠকদের মনোযোগ বিঘ্ন ঘটাবে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Medieval Period
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy