Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
book review

Book review: প্রতিচিন্তার কোনও বিকল্প নেই

অথচ ‘মার্ক্সের সত্য’কে সম্মান করলে আমাদের মার্ক্সবাদীরা এই চিন্তাশক্তিহীন আনুগত্যসর্বস্ব গতানুগতিকতার দাস হয়ে পড়তেন না।

উত্তরাধিকার: নিউ ইয়র্কে ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

উত্তরাধিকার: নিউ ইয়র্কে ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২২ ০৫:০৩
Share: Save:

গত কয়েক বছরে অনুষ্টুপ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় কার্ল মার্ক্সের চিন্তা ও তার প্রয়োগ (এবং অপপ্রয়োগ) বিষয়ে সুদীপ্ত কবিরাজের লেখাগুলি যে বাংলা ভাষায় মার্ক্স-চর্চার ধারায় অত্যন্ত মূল্যবান এক সংযোজন, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রয়োজন ছিল তাদের এক জায়গায় আনার। ন’টি প্রবন্ধের এই সঙ্কলন সে-প্রয়োজন মিটিয়েছে। প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সুগভীর চিন্তা এবং প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ দীর্ঘ আলোচনাগুলির বিষয়-পরিধি ও বিশ্লেষণের ব্যাপ্তি এতটাই যে, নিতান্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঝাঁকিদর্শনের বেশি কিছু সম্ভবই নয়। অতএব শুরুতে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মহাবিদ্যাটি প্রয়োগ করাই শ্রেয়।

সঙ্কলনের ভূমিকায় লেখক খুব অল্প কথায় সযত্নে তাঁর ভাবনার ‘অন্তর্নিহিত সংহতি’র সূত্রগুলি ধরিয়ে দিয়েছেন। বড় অর্থে চারটি সূত্র নির্দেশ করেছেন তিনি, যার ভিত্তিতে লেখাগুলি বিন্যস্ত হয়েছে চারটি ভাগে: তত্ত্ব, গণতন্ত্র, ইতিহাস এবং স্বর্গ। তাঁর কথায়, “...মনে হয়েছে চারটে বড় বিষয় এই ভাবনাগুলোর মধ্যে তন্ত্রিত হয়ে আছে— প্রথমটা হল তত্ত্বকে নেয়া— মুখস্থ করে নয়, নিজের মতো করে; দ্বিতীয় তন্তু হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে— গণতন্ত্র একেবারে অন্তর্নিহিত না থাকলে সমাজতন্ত্র হয় না; তৃতীয় বিষয় ইতিহাস— কীভাবে ইতিহাস অন্য জায়গার চিন্তাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিতে চায়; চতুর্থ, মানুষ থাকলে স্বর্গ না থাকলেই নয়: কিন্তু সেই স্বর্গের নির্মাণ ইতিহাসের সাথে সাথে ক্রমশই বদলে নিতে হয়, না হলে সে স্বর্গের পথরেখা খুঁজে পাওয়া যায় না।” এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিষয় চারটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পর একেবারে ওতপ্রোত এবং, লেখকের ব্যবহার করা চমৎকার একটি পারিভাষিক শব্দ দিয়ে বলা যায়, অধিনির্ধারিত, অর্থাৎ ‘ওভারডিটারমিনড’— একটি বিষয়-সূত্র আর একটিকে কেবল প্রভাবিত করে না, একে অন্যের দ্বারা ক্রমাগত নির্মিত হয়ে চলে।

মার্কস ও স্বর্গের সন্ধান
সুদীপ্ত কবিরাজ
৪৮০.০০
অনুষ্টুপ

এই সূত্রগুলিকে নিয়ে এবং তাদের মধ্যে দিয়ে লেখকের ভাবনার যে ধর্মটি প্রবল ভাবে নাড়া দেয় তার নাম ‘প্রতিচিন্তা’। বইয়ের উপসংহারে পড়ি, “প্রতিচিন্তা বলতে বোঝায় কোনো সমাজে যে ধরণের চিন্তা আধিপত্য করে তার বিরুদ্ধে ভাববার চেষ্টা করা”। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রামশির কথা মনে পড়বে। গ্রামশি নিয়ে মূল্যবান আলোচনা আছেও এই গ্রন্থে। তবে প্রতিবাদী চিন্তা, প্রতিস্পর্ধী চিন্তা, বা ‘চিন্তার বিরুদ্ধে চিন্তা’র ধারণাটি এখানে ‘কাউন্টারহেজিমনি’-র প্রচলিত পরিধিতে নিজেকে সীমিত রাখেনি, তত্ত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে কী ভাবে ভাবব, এবং সেই ভাবনাকে নিয়ে কী ভাবে ভাবব, সেই বিষয়ে আলো ফেলেছে, যে আলো কেবল নতুন চিন্তার পথ দেখায় না, নতুন কাজের পথও দেখায়। দুটো পথ আবার অধিনির্ধারিতও বটে— সংস্কৃতে ভাবনা শব্দটা যে নিছক ভাবা নয়, কোনও ব্যাপার ঘটিয়ে তোলাও বোঝাতে পারে, চিন্তা করা এবং কাজ করার সেই যুগ্ম অর্থটি লেখক খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। এই শব্দভেদী বিশ্লেষণ প্র্যাক্সিস-ভাবনাকে একটা নতুন মাত্রা দিতে পারে, যে মাত্রাটি নিয়ে আমাদের তাত্ত্বিকরা সম্ভবত যথেষ্ট ভাবেননি।

এই সূত্র ধরেই লক্ষ করতে পারি ‘মার্কসবাদ ও গণতন্ত্র’ প্রবন্ধের শেষে উচ্চারিত একটি মন্তব্য: “যে চিন্তার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীকে পরিবর্তন করার চেষ্টা হচ্ছে, তার অভ্যন্তরীণ অপূর্ণতার সমালোচনাও একটা বিরাট দায়িত্ব। প্রতিবাদ বা পরীক্ষা করার ক্ষমতা কেবল পৃথিবীর দিকে প্রসারিত করাই পর্যাপ্ত নয়। তাকে আমাদের স্বচিন্তার ভিতরে প্রসারিত করাও প্রয়োজন।” এখান থেকে দুটো কথা আসে। প্রথমটা স্বচিন্তা সম্পর্কে। ‘পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদ ও গণতন্ত্র’ নামক লেখাটির প্রস্তাবনায় লেখক বলেন, যে কোনও ভাবনায় যে ব্যক্তি ভাবছে এবং সে যে বিষয় নিয়ে ভাবছে, দুটোকেই গভীর ভাবে বিচার করা দরকার, তা না হলে ভাবনার প্রক্রিয়াটা অস্পষ্ট থেকে যায়। এই যুক্তির দাবি মেনেই তিনি যখন লেখেন যে, “আমার মতো বহু-প্রবাসীর” (একই সঙ্গে বহুদিন প্রবাসী ও বহু স্থানে প্রবাসী) “চিন্তার এবং অভিজ্ঞতার অবস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গ পদার্থটার ইতিহাসে হয়ে ওঠা— এই দুটোর আলোচনা দিয়েই শুরু করা উচিত”, তাঁর স্বচিন্তাও
তখন প্রতিচিন্তার বিচারাধীন হয়ে পড়ে। বস্তুত, বিভিন্ন লেখায় বারংবার লেখক নিজের চিন্তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান, অন্য ভাবে ভাববার প্রয়োজন নির্দেশ করেন। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে এ-বইয়ের ‘শেষের কথা’ শুরু হয় এই বাক্যটি উচ্চারণ করে যে— লেখা শেষ করা যায়, চিন্তা শেষ করা যায় না।

এবং এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে মার্ক্সের চিন্তার স্বধর্ম। কারণ সব কিছুকে প্রশ্ন করার যে বিধান তিনি দিয়েছিলেন, নিজেকেও কখনও তা থেকে ছাড় দেননি সেই নিরন্তর সন্ধানব্রতী। ‘মার্কসের সত্য’ প্রবন্ধে এই জঙ্গমতার দৃষ্টান্ত আছে। যেমন— “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র পরে যতই মার্কসের পৃথিবীর ইতিহাসের ভিন্নতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, মার্কস তাঁর ইতিহাসের স্তরচিন্তাকে বারবার পরিবর্তিত করেছেন...”। ভারতের ইতিহাস নিয়ে মার্ক্সের ধারণা ও বিশ্লেষণ কী ভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, সেই কাহিনিও বহুচর্চিত। চিন্তার এই স্বাভাবিক জঙ্গমতাই মার্ক্সীয় সমাজভাবনার প্রধান সম্পদ, সেই ভাবনাকে সমাজ-বদলের হাতিয়ার করে তোলার প্রধান শক্তি।

ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে মার্ক্সবাদী বলে যাঁরা পরিচিত, বহুদিন একটানা যাঁরা শাসনক্ষমতা ভোগ করে গিয়েছেন, তাঁদের চিন্তায় ও আচরণে এই জঙ্গম, প্রশ্নবাচী আত্মসমীক্ষার পরিচয় মেলেনি, পরিচয় মিলেছে তার বিপরীত এক মানসিক স্থবিরতার। এ-রাজ্যে তাঁরা একটা বিরাট সুযোগ পেয়েছিলেন, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের যৌথ অভিযানের সুযোগ, সেই অভিযানের পদে পদে ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব আর টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে পথ খোঁজার সুযোগ। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে, বস্তুত সুযোগটাকে সুযোগ বলে চিনে নিতে হলে ক্রমাগত নিজেকে, নিজেদের প্রশ্ন করার যে শর্ত মানতে হয়, তাঁরা সেই শর্ত স্বীকারই করেননি, তার বদলে তৈরি হয়েছে “পার্টির ভেতরে একটা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বলে সম্পূর্ণ মিথ্যার প্রতিষ্ঠান— কেউ কখনো এই গণতন্ত্র থেকে কোনো সমালোচনা বা চিন্তার পরিবর্তন হতে দেখে নি।”

পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সবাদ ও গণতন্ত্র বিষয়ে লেখাটি শেষের দিকে পৌঁছে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়, “এই লেখায় সিপিএমের সমালোচনাই বেশি। কিন্তু এটা দূরস্থিত স্বদেশের সম্পর্কে একটা অবিচ্ছিন্ন বিষণ্ণতার থেকে লেখা।” বহুপ্রবাসী লেখকের এই বিষাদের শরিক হবেন, এমন অনেক মানুষ এ দেশে এবং এই রাজ্যেও আজও আছেন, কিন্তু তাঁদের দীর্ঘশ্বাস পার্টির অচলায়তনের রুদ্ধদ্বার এবং বন্ধ জানলা ভেদ করে পৌঁছয়, এমন কথা মনে করার কোনও কারণ দেখি না।

অথচ ‘মার্ক্সের সত্য’কে সম্মান করলে আমাদের মার্ক্সবাদীরা এই চিন্তাশক্তিহীন আনুগত্যসর্বস্ব গতানুগতিকতার দাস হয়ে পড়তেন না। বস্তুত, সর্বশক্তিমান পার্টির তন্ত্র জারি করার অপরাধে লেখক যে লেনিনকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন, তিনি কিন্তু প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সচেতন জীবনের শেষ ক্ষণে পৌঁছেও পার্টিকে আত্মসমীক্ষা এবং আত্মসংশোধনের নির্দেশ দিতে তৎপর হয়েছিলেন— গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার সদর্থ কী হতে পারে, তাঁর অন্তিম পর্বের ‘টেস্টামেন্ট’ আজও তার এক উজ্জ্বল এবং সম্ভাবনাময় দৃষ্টান্ত।

বঙ্গীয় মার্ক্সবাদী রাজনীতিকরা লেনিনের ‘টেস্টামেন্ট’ পড়বেন, তার ভরসা কম। সুদীপ্ত কবিরাজের বইটিও তাঁরা উল্টে দেখবেন কি না, জানি না। দেখলে ভাল করতেন।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Karl Marx Communist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy