Advertisement
E-Paper

নীরবতার পিছনে থাকা কণ্ঠস্বরের খোঁজ

‘অবগুণ্ঠিতা’ শব্দটি রূপক অর্থে গ্রহণ করাই ভাল। এই মেয়েরা যে সব সময় অবগুণ্ঠনের আড়ালে ছিলেন, তা মনে হয় না।

কলঙ্কিনী: মোহন্ত-এলোকেশী সাক্ষাৎ, পরে নবীনের এলোকেশী-হত্যা। কালীঘাট পট। উইকিমিডিয়া কমনস

কলঙ্কিনী: মোহন্ত-এলোকেশী সাক্ষাৎ, পরে নবীনের এলোকেশী-হত্যা। কালীঘাট পট। উইকিমিডিয়া কমনস

ভাস্বতী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ ০৯:৪৮
Share
Save

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজ়িয়মে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে শোভা পাচ্ছে উনিশ শতকের বাঙালি মেয়ের কাঁথা শিল্পের কয়েকটি নিদর্শন। একটি কাঁথায় অখ্যাত শিল্পীর স্বাক্ষর— ‘শ্রীমতি বসন্ত কুমারি দাশী-র এই বয়ন’। বাংলার অখ্যাত মেয়ের সেলাই করা নকশি কাঁথা লন্ডনের মিউজ়িয়মে ঠাঁই পেয়েছে, বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। উনিশ শতকের অখ্যাত মেয়েদের সূচিশিল্প বা অবসর যাপন নয়, তাঁদের যাপিত জীবনের আখ্যান উঠে এসেছে আলোচ্য গ্রন্থটিতে।

‘অবগুণ্ঠিতা’ শব্দটি রূপক অর্থে গ্রহণ করাই ভাল। এই মেয়েরা যে সব সময় অবগুণ্ঠনের আড়ালে ছিলেন, তা মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এ তাঁদের অবগুণ্ঠন ছেড়ে বেরিয়ে আসার গল্প। বিষয়বস্তুকে মোট পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে লেখক শিক্ষিত সমাজ থেকে চাষি-মজুরের পরিবার, শহর-মফস্‌সল, নানা অঞ্চলের ঘটনাকে একত্র করেছেন, যার কেন্দ্রে রয়েছেন মেয়েরা— সধবা, বিধবা বা অবিবাহিতা, গৃহবধূ, যৌনকর্মী, নর্তকী ইত্যাদি। লেখক গল্পই বলতে চেয়েছেন— তত্ত্ব খাড়া করার দায় তিনি পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

শেখর ভৌমিক উনিশ শতকের বহু পত্রপত্রিকা ঘেঁটে গার্হস্থ হিংসার নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে মেয়েরা যে বিচিত্র পেশায় নিযুক্ত ছিলেন সেই তথ্য আমরা জানছি, যেমন যৌনকর্মীদের আড়কাঠি, পান্ডাদের সাতুয়ানি। ভালবাসার আশায় মেয়েরা ঘর ছেড়েছেন, প্রতারিতও হয়েছেন। তাঁদের পরিবার সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। মেয়েরা মেয়েদের হত্যা করেছেন, নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।

সাধারণ মেয়েদের সাধারণ গল্পই বলতে চেয়েছেন লেখক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হওয়ার কাহিনি আমরা আগেও শুনেছি। রাসসুন্দরী দেবী নিজের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া শিখে, তনিকা সরকারের ভাষায় ‘জিতাক্ষরা’ হয়েছিলেন। শ্রমজীবী মেয়েদের প্রতিরোধের কথা লিখেছেন শমিতা সেন।

অবগুণ্ঠিতা: উনিশ শতকে বাংলার অখ্যাত মেয়েদের কথা

শেখর ভৌমিক

৪০০.০০

আশাদীপ

উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থা বিধবা বিবাহ আইন প্রচলিত হওয়ার পরেও বর্তমান ছিল। যৌনতাহীন জীবনের অপূর্ণতা দূর করতে সমাজনির্দিষ্ট ছক ভেঙে তাঁদের নানাবিধ অভিযান। কখনও তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা, কখনও বা তাঁরা শুধুই পরিস্থিতির শিকার। এক-একটি ঘটনা যেন হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুরতার দলিল। যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের নিস্পৃহতার নানা বিবরণ লেখক তুলে ধরেছেন। এমনকি ব্রাহ্ম সমাজের নিস্পৃহতাও ছিল উল্লেখযোগ্য। বেশ্যা হত্যা, যা ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা, তার প্রতি সমাজের উদাসীনতা তো ছিলই, অনেক সময় চাপা উল্লাসও দেখা যেত।

অন্তঃপুরের অন্ধকার জগৎকে খুঁড়ে বার করেছেন লেখক। প্রেম, বিবাহ, বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম, ত্রিকোণ প্রেম ঘিরে হত্যা বা হত্যার প্রচেষ্টা, যা সমসাময়িক সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে, চর্চার বিষয় হয়েছে— তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন। এই সব ঘটনাই নারীকে কেন্দ্র করে। উনিশ শতকের মোহন্ত-এলোকেশীর কেচ্ছার কথা তনিকা সরকারও লিখেছেন। কলকাতা শহর বা শহরের বাইরের অজস্র শিক্ষিত ও অশিক্ষিত পরিবারের কেচ্ছা দেখায় অন্তঃপুরের অন্ধকার চিত্রটি। মানুষের চরিত্রের বিভিন্ন দিক ধরা পড়েছে এই বিবরণে, যা শুধু ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদেরই নয়, মনোবিদদেরও আগ্রহের বিষয়।

প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় মেয়েদের কথা কখনওই সে ভাবে গুরুত্ব পায় না। উনিশ শতকের বাংলার বিখ্যাত পরিবারের মেয়েরা কিন্তু অখ্যাতই থেকে যান। নারী-ইতিহাস চর্চার অন্যতম উদ্দেশ্যই হল জাতি, বর্ণ, বর্গের ছক ভেঙে সব মেয়ের বিষয়েই আলোচনা। অভিনেত্রী, গৃহবধূ, গৃহপরিচারিকা সকলেরই চিঠিপত্র, ডায়েরি, পোশাক, ছবি— সব কিছুই এখন ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিবেচ্য। নারীবাদী ইতিহাস চর্চার অন্যতম লক্ষ্যই হল নীরবতার ইতিহাস প্রকাশ্যে আনা। নীরব অধ্যায়ের পিছনের কণ্ঠস্বরকে খুঁজে বার করা, ইতিহাসের পুনর্গঠন। আলোচ্য গ্রন্থটি নারী-ইতিহাস চর্চায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। পরিশিষ্ট অংশে যৌনকর্মী, দেশীয় স্ত্রীলোক, ‘ডান্সিং গার্লস’-এর এক দীর্ঘ তালিকা দেওয়া আছে, যা গবেষকদের সাহায্য করবে।

শেষে একটি কথা। ইতিহাসবিদরা গল্প বলতে ভালবাসেন। কিন্তু সেই গল্পগুলোকে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে যুক্ত করে সাধারণীকরণ বা জেনারেলাইজ়েশনের দাবি থেকেই যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review editorial

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}