সদ্যপ্রকাশিত রবিজীবনী-র এই খণ্ড ১৩৩৩, ১৩৩৪ ও ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের, তথা ১৯২৬-এর মধ্য-এপ্রিল থেকে ১৯২৯-এর মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত— বিশদ রবীন্দ্র-জীবনাখ্যান। গবেষণাগৌরব এই জীবনী-প্রকল্পের জনক ও ধারক, স্বনামধন্য প্রশান্তকুমার পাল যাঁর হাতে পূর্ববর্তী ন’খণ্ড নির্মিত হয়ে এসেছে, (২০০৭-এ তাঁর মৃত্যুর আগে) এ খণ্ডেরও অনেকটা কাজই করে গিয়েছিলেন। এবং গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁরই নামে।
অবশ্য, তাঁর রেখে যাওয়া ‘অসমাপ্ত’ পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ করেছেন অভীককুমার দে, যাঁকে এ দায়িত্ব দেন এই গ্রন্থের ‘উপদেষ্টা’ শঙ্খ ঘোষ। তিনি, অভীককুমার দে, গ্রন্থ-‘সম্পাদনা’ করতে গিয়ে বেশ খানিকটা ‘সংযোজন’ করেছেন যা ‘< >’ দ্বারা চিহ্নিত...। তাঁকে তা করতে হয়েছে, কেননা সম্পূর্ণকরণের দায়িত্ব পেয়ে তিনি কাজ শুরু করেছেন ২০১৮-র নভেম্বরের পরে। আর তত দিনে রবীন্দ্রচর্চায় কিছু নতুন উপাদান উঠে এসেছে যা দেখার অবকাশ প্রশান্তকুমার পালের হয়নি: যেমন ২০০৯ সালে ছাপা কল্যাণকুমার কুন্ডুর ‘ইতালি সফরে রবীন্দ্রনাথ ও মুসোলিনি প্রসঙ্গ’ বা ২০১৮ সালে চিন্ময় গুহ সম্পাদিত ও, রলাঁর ক্ষেত্রে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনূদিত, রলাঁ-রবীন্দ্রনাথ পত্রবিনিময়। বস্তুত, অভীককুমার দে-র সংযোজনের মাত্রা বিবেচনা করলে বলতে হয়— রবিজীবনী দশম খণ্ডের ঊন-লেখক অভীককুমার দে।
রবীন্দ্রনাথের ছেষট্টি, সাতষট্টি ও আটষট্টি বছরের আখ্যান এই জীবনীখণ্ড। কিন্তু তা এতই পুঙ্খানুপুঙ্খ, এতই উপাদানে উপাদানে ঋদ্ধ, যে মাত্র তিন বছরের আখ্যান হলেও এক টানে পড়ে যাওয়ার মতো কোনও কাহিনিবৃত্ত এ নয়। তা ছাড়া এর সন্নিবেশও হয়েছে দিনানুদিন, যেন বা এক বিশদ দিনপঞ্জিরই নামান্তর এই জীবনী। একদিন প্রতিদিনে নয়, অনন্য প্রতিদিনে প্রতিদিনে যাঁর জীবন গ্রথিত, তাঁর জীবনী লিখতে বসে বুঝি বা এই উপায়ই বেছে নিতে হল রবিজীবনীকারকে। আর তাঁকে তো পাল্লা দিতে হচ্ছে চার খণ্ডের রবীন্দ্রজীবনীকারের সঙ্গে। তাঁর কাছে কখনও কখনও ফিরে যেতেও হচ্ছে, কিন্তু তাঁর ফাঁক ধরতে পারলে তো তেমন অখুশিও মনে হচ্ছে না আমাদের লেখককে।
তবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রজীবনী-কে ‘রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক’-এর মাত্রায় বেঁধে আমাদের এক দিশা দিয়েছেন। অনুরূপ কোনও মাত্রিকতার আভাসও নেই প্রশান্তকুমার পালের ৯+১ রবিজীবনী-তে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখাতে চেয়েছেন সার্বিক ভাবে। আর তাই রবীন্দ্রচর্যার প্রায় সবটাই তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন, এমনকি সংশ্লিষ্ট ‘ক্যাশবহি’ও? এই খণ্ডে তাঁর (ও অভীককুমার দে-র) নিরলস পরিশ্রমের ফসলই তো কুড়োচ্ছি আমরা কেউ কেউ— জানতে পারছি আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯২৬-এই, কাছাকাছি সময়ে দেখা হয়েছিল ফ্রয়েডের সঙ্গেও, রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার জাতিবিদ্বেষী কুখ্যাত ‘কু ক্লাক্স ক্লান’ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন, ১৯২৮-এ সোভিয়েট রাশিয়ায় টলস্টয়ের শতবার্ষিকীতে ইংল্যান্ডের বার্নার্ড শ-র মতো ভারতের রবীন্দ্রনাথও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন।
রবিজীবনী, দশম খণ্ড
প্রশান্তকুমার পাল
১২০০.০০
আনন্দ
১৯৬১-তে, ভবানী ভট্টাচার্য সম্পাদিত টুয়ার্ডস ইউনিভার্সাল ম্যান ও অমিয় চক্রবর্তী প্রস্তাবিত আ টেগোর রিডার-এর যুগ্ম আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “দুই রবীন্দ্রনাথ: আসলে এক।” এই ঐক্যেরই এক দলিল আমরা পাই এই তিন বছরের জীবনায়নে। ১৩৩৩-এর বৃহত্তর ভাগ তিনি ইউরোপে (ফিরছেন গ্রিস ও মিশর হয়ে), এক আমন্ত্রিত ভ্রাম্যমাণ বক্তা— যেমন বিশ্বভারতীর আদর্শ প্রচার করছেন, তেমনই সভ্যতার অগ্রগতির পাশাপাশি বস্তুতান্ত্রিকতার বিপদ গুনছেন। এবং ফাঁকে ফাঁকে শ্রোতাদের কবিতা শোনাচ্ছেন। আবার অন্য দিকে লিখছেন নিত্যনূতন গান বা কবিতা। ১৩৩৪-এর গ্রীষ্মে— শিলং শৈলে তখন দ্বিতীয় বার— শুরু করলেন তিনপুরুষ (পরে নাম পাল্টে যোগাযোগ), তা বিচিত্রা-য় আশ্বিন থেকে বেরোচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে, চৈত্র পর্যন্ত, বেরোতে লাগল জাভা-যাত্রীর পত্র-ও— যে যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ‘বৃহত্তর ভারত’ সন্ধান। আবার, ১৩৩৫-এর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে যোগাযোগ লিখতে লিখতে হঠাৎ শেষের কবিতা-ও (গোড়ায় নাম ছিল মিতা) লিখে ফেললেন। আশ্চর্য! এক দৈব উদ্ভাসেরই নাম বুঝি রবীন্দ্রনাথ!
অথচ এক মানুষী উদ্ভাসেরও নাম যে রবীন্দ্রনাথ, তার সাক্ষ্য কি এই তিন বছরে নেই? ১৩৩৩-এর প্রথম মন্দিরভাষণ ‘ধর্ম ও জড়তা’ যে এখনও প্রাসঙ্গিক, তার প্রমাণ তো আমরা এই আষাঢ়ের হাথরসে পেলাম। যে সমবায়নীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন (ভাণ্ডার পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩৪ সংখ্যা আমরা খুঁজে নিয়ে দেখতে পারি) তার যৌক্তিকতা আজও অনস্বীকার্য। যে শিক্ষাদর্শ তাঁর এত দিনের সাধনার ধন, তার জন্য ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হাতে বেরিয়ে পড়তে তাঁর দ্বিধা নেই। তবু কানাডার আমন্ত্রণ যে তিনি দু’-দু’বার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার কারণ তো ছিল সেই ‘কোমাগাতা মারু’-বাহিত, ইংরেজ-শাসনের শিকার এক দল অভিবাসনপ্রার্থী ভারতীয়ের প্রতি সে দেশের অমানুষিকতা। তবে শেষ পর্যন্ত ১৩৩৫-এ ভ্যাঙ্কুভারের আন্তর্জাতিক শিক্ষাসম্মিলনে যেতে রাজি হয়েছিলেন। এবং গিয়ে খুশিও হয়েছিলেন। আর ভ্যাঙ্কুভার-উত্তর, আমেরিকান অভিবাসন দফতরের অভব্যতা সত্ত্বেও যে লস অ্যাঞ্জেলেসে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, তা বলা বাহুল্য বিশ্বভারতীর কথা মাথায় রেখে অর্থোপার্জনের জন্য। কিন্তু যখন বুঝলেন তাঁকে দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ই টাকা তোলার চেষ্টা করছে, এবং তাঁর উপার্জন তলানিতে ঠেকতে যাচ্ছে, তখন আর প্রস্তাবিত ক্লাস না পড়িয়ে তিনি জাপান হয়ে দেশে ফেরার জাহাজ ধরলেন। এই প্রত্যাবর্তনের যে কারণ রবীন্দ্রজীবনীকার, এবং তদনুসারে রবিজীবনীকার, দেখিয়েছেন (পাসপোর্ট হারানো ও নতুন পাসপোর্টের জন্য পাসপোর্ট দফতরে গিয়ে যারপরনাই অসম্মানিত হওয়া) তা বোধ করি যথার্থ নয়। রথীন্দ্রনাথকে পুরো ব্যাপারটা খুলে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ— দ্রষ্টব্য চিঠিপত্র ২, ১১০ নম্বর চিঠি।
অনুরূপ অসঙ্গতি আরও আছে এই গ্রন্থে। তা যেমন বিদেশি শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে, তেমনই অন্যত্রও। একই পৃষ্ঠায় (৮৫) আছে ‘লাইপজিগ’ ও ‘লিপৎজিগ’— দুটোই উদ্ধৃতিতে, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে কি ‘যদ্দৃষ্টং’ তথা ‘য’ যোগ করে দেওয়া যেত না? ওই পৃষ্ঠাতেই ‘বেনথেন’-এর (‘য’-রোমান হরফে 'u' বোধহয় 'n' পড়া হয়ে গিয়েছিল) চেয়ে ‘বয়টন্’ (য) মূল ‘বয়টেন’-এর নিকটতর, কিন্তু পোল্যান্ড-সীমান্তের এই জার্মান শহর পূর্ব দিকে (এক জন তা-ই বলেওছেন) না হয়ে ‘পশ্চিমদিকে’ (অন্য উদ্ধৃতিতে তা-ই) কী করে হয়? পোল্যান্ড কি জার্মানির পশ্চিমে, না পুবে? একটা ‘য’-র তো এখানে থাকার কথা। ৩১ পৃষ্ঠায় ‘ক্রোচে’-র আগে ‘বেনদেত্তো’ (বেনেদেত্তো) হয়তো বা ছাপার ভুল, কিন্তু ৩৪ পৃষ্ঠায় ‘উফিয়ি’ (উফিৎসি গ্যালারি)? অবশ্য ছাপার ভুল এ গ্রন্থে অনেক। আরও যত্ন নিলে ভাল হত।
তবু পাতা উল্টোলেই তো রবীন্দ্রনাথ। হয় লিখছেন নয় বলছেন নয় কর্মচঞ্চল। এই তিন বছরের কবিতা, ঠিক ক্রমান্বয়ে না হলেও, পরিশেষ, বনবাণী ও মহুয়া-র। গান বৈকালী, নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা ও অন্যান্য গুচ্ছের, অজস্র। নাটক নটীর পূজা ও গীতিনাট্য ঋতুরঙ্গ, যে দুইয়েরই হয় সাধারণ মঞ্চায়ন, মায় তাঁর অভিনয় ও পাঠসুদ্ধ। লেখেন দুই মেজাজের দুই ছোটগল্প ‘সংস্কার’ ও ‘বলাই’। প্রবন্ধও লেখেন নানা বিষয়ে, রম্য, অরম্য, সর্বোপরি ‘সাহিত্যধর্ম’ যা তথাকথিত আধুনিকতা নিয়ে তর্ক তোলে। সেই সঙ্গে লিখছেন অবিরাম চিঠি— এই তিন বছরে তার সংখ্যাও খুব কম নয়। ইংরেজিতেও, যেমন তাঁর বিতর্কিত ইটালি ভ্রমণশেষে এন্ড্রুজ়কে, ফ্যাসিজ়মের প্রতিবাদ করে, যা ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান-এ ছাপা হয়। লেখেন সহজপাঠ ও ইংরেজি সহজশিক্ষা। আর ১৩৩৫-তেই শুরুহয় তাঁর ছবি আঁকা যা, যত দিন যাবে ততই বাড়বে।
এ না হলে রবীন্দ্রনাথ, ১৩৩৩-১৩৩৫! কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি প্রশান্তকুমার পালকে ও নমস্কার জানাই অভীককুমার দে-কে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy