—প্রতীকী চিত্র।
দেশভাগের কারণে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের একাংশের ঠাঁই হয়েছিল কলকাতার আশপাশে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গায়, যার নাম হয়েছিল কলোনি। তার বাসিন্দাদের পরিচিতির নির্মাণে স্মৃতি ছিল এক প্রধান উপাদান। “একটি উদ্বাস্তু পরিবার গর্বভরে নিজেদের বাড়ির উঠান ও আমগাছ দেখিয়েছিলেন… বলেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে নিয়ে আসা এককৌটো মাটি এই উঠানে মেশানো হয়েছে। আমগাছটি দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ আমগাছের আঁটিও পূর্ববঙ্গ থেকে নিয়ে আসা।” কিন্তু, সেই গাছ থাকল না, ‘গাছ কেটে উঠানের মাটি উপড়ে ফেলে ফ্ল্যাট বাড়ির নির্মাণকার্য’ চলতে দেখে এসেছেন আলোচ্য বইয়ের লেখক। প্রজন্মের প্রভেদ স্মৃতির উপর নতুন পরত ফেলে যায়। যা নিয়ে বয়স্কা গৃহকর্ত্রীর গর্ব ছিল, তা নিয়ে তাঁর উত্তরপ্রজন্মের মাথা ঘামানোর অবকাশ নেই— ঘামাতে হলে থেমে থাকতে হয়, অথচ কাল বহমান। তাই “কলকাতা শহরতলির বহু কলোনি আজ ‘কলোনি’ শব্দবন্ধ বর্জন করেছে”, এবং “উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয় প্রজন্মের একাংশ ও প্রায় সম্পূর্ণ তৃতীয় প্রজন্ম উদ্বাস্তু কলোনির পরিচয়ে গ্লানি বোধ করে।” আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উদ্বাস্তু পরিচিতির নির্মাণ ও পরবর্তী কালে সেই পরিচিতির সচেতন বিসর্জনকে লেখক যুক্ত করছেন উদ্বাস্তুদের এক বাস্তব স্বার্থের সঙ্গে: তা হল জমির উপর অধিকার। সেই প্রয়োজন যখন শেষ হল, তখন “ওই ব্যবহারিক আত্মপরিচয়কে বহন করে চলার প্রয়োজন সাঙ্গ হয়েছে।” অবশ্যই “রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ এই বর্জনকে শক্তির জোগান দিয়েছে।”
লেখক এই রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ নিয়ে প্রভূত তথ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন। ভারত সরকারের উদ্বাস্তু-স্বার্থ-বিরোধী ভূমিকা, কংগ্রেসের দোদুল্যমানতা, এবং উদ্বাস্তু আন্দোলনের সংগঠনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের মতো রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে ইতিহাসবেত্তারা নানা রকম আলোচনা করেছেন। বর্তমান লেখক তাঁদের মতোই ‘প্রচলিত ইতিহাস নির্মাণ পদ্ধতি ব্যবহার’ করে সেগুলোর পুনরালোচনার পাশাপাশি নির্ভর করেছেন বস্তিবাসীদের স্মৃতির উপর। কারণ, তাঁর মনে হয়েছে, “নির্বাক সরকারি তথ্য, পুলিশ রেকর্ড ঘেঁটে পাওয়া তথ্যগুলি বাঙ্ময় হয় না, উদ্বাস্তুদের মানসিকতার হদিশও দেয় না।” তাই, ‘কলকাতা শহরতলির উদ্বাস্তু কলোনির ইতিহাস রচনায়’ থেকে যাওয়া ‘গুরুতর ফাঁক’ ভরাট করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে বহু বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই সব সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে উঠে আসা স্মৃতিগুলোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই ভাবে, উদ্ধৃত স্মৃতিগুলোর সাহায্য নিয়ে উদ্বাস্তু আন্দোলনের মধ্যেকার এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর রাজনীতির সম্পর্কের দিকটা নিয়ে পাঠককে আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন।
বইটি লেখকের পরিশ্রমের সাক্ষ্য বহন করে। বিড়ম্বনা একটাই, কেবল পরিশ্রম দিয়েই একটা বই গড়ে উঠতে পারে না, তার সঙ্গে দরকার হয় চিন্তার যত্ন, এবং পেশার প্রতি আনুগত্য। দুর্ভাগ্যবশত, পুরো বই জুড়েই চিন্তাগত অযত্নের ছাপ— এ যেন উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতৃত্বের এক প্রতিরূপ, যাঁদের চিন্তাগত রক্তাল্পতা উদ্বাস্তু আন্দোলনকে কেবল একটি ‘ঘটনা’ করে রেখে দিল, তাকে রাজনীতি ও সমাজের গুণগত পরিবর্তনে যুক্ত করতে অসমর্থ হল। পাশাপাশি আশঙ্কা হয়, প্রকাশনার ব্যাকরণকে একেবারে ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়েছেন প্রকাশক। তার ফলে, চিন্তাগত খামতি সত্ত্বেও বইটির মধ্যে যে সারটুকু ছিল, তাকে গ্রহণ করার কাজটি পাঠকের কাছে দুঃসাধ্যতর হয়েছে।
নজরে
আমরা তোমাদের ছেড়ে এসেছিলাম কেন? তাতে আমাদের দু’পক্ষেরই কী উপকার হল, সেটা আজও বোঝা গেল না কেন? লাহোরের স্কুলে কৃষ্ণ কুমার ও তাঁর সহকর্মীদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল কয়েক জন ছাত্রী। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এই সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ, ইউপিএ জমানায় বছর চারেক যিনি ছিলেন এনসিইআরটি-র কর্ণধার। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার স্কুল ও কলেজে ইতিহাস পড়ানোর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেছেন। হিস্ট্রি ফর পিস ট্র্যাক্টস গ্রন্থমালার এই ছোট্ট বইটিতে কৃষ্ণ কুমার বুঝতে চেয়েছেন, ইতিহাসের পাঠ কী ভাবে সংঘর্ষের কারণ না হয়ে শান্তির পথে এগিয়ে দিতে পারে। কেন আজকের ভারত, দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বে এ বই মূল্যবান, তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
পঁচিশ বছর আগে পাকিস্তানের সেই কিশোরীরা যে প্রশ্ন তুলেছিল, তা এ বইয়ের অন্তর্নিহিত আলোচনার পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ দেশভাগ, তার প্রেক্ষাপট ও পরবর্তী কাহিনিকে কেন্দ্র করেই সেই আলোচনা এগিয়েছে। সীমান্তের দু’পারে দুই দেশে ইতিহাসের পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি এবং ক্লাসের শিক্ষায় এই একই ইতিহাস কতখানি আলাদা রূপ নিয়েছে এবং তার সুর ও ঝোঁক কেমন ভাবে প্রায় বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে, সেই বাস্তব স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন লেখক।
এবং সরাসরি জানিয়েছেন, ইতিহাস শিক্ষাকে শান্তি ও সহিষ্ণুতার প্রকরণ করে তোলা কোনও সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে রাষ্ট্র যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে তার নিজস্ব জাতীয়তার ধারণা গড়ে তোলার হাতিয়ার হিসাবে উত্তরোত্তর জোরদার করে গড়ে নিতে বদ্ধপরিকর। মুশকিল আসানের কোনও তৈরি সূত্র পেশ করেননি তিনি, কারণ তেমন কোনও সূত্র নেই। কিন্তু একটি মূল্যবান কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। সেটা এই যে, জাতি-রাষ্ট্রের বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ও ইতিহাসকে অতীত হিসাবে দেখেই তাকে নানা দিক থেকে পড়া দরকার, সেই বিভিন্ন পাঠের মধ্যে কথোপকথন তৈরি করা দরকার। সীমান্ত বাস্তব, কিন্তু কথোপকথনের জন্য সীমান্ত বাধা হবে কেন? অতিজাতীয়তার সওদাগর রাজনীতিক আর তাঁদের অনুগামী ও প্রসাদভোজী শিক্ষা-শাসকরা এ প্রশ্ন শুনতেও চাইবেন না, ইতিহাস শিক্ষার নতুন ইতিহাস গড়তে হলে কাজটা সুচেতন নাগরিকদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy