‘ম্যাপ অব দ্য কাশিমবাজার আইল্যান্ড’ থেকে পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র
দি নটা ছিল ১৭৬৩ সালের ২১ অক্টোবর। এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে মাদ্রাজ উপকূলের সব জাহাজ বিধ্বস্ত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বারোটা বড় বড় জাহাজের একজন ইউরোপীয় নাবিকও প্রাণে বাঁচেননি। ভাগ্যের জোরে এরই একটি জাহাজের সদ্য-ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জেমস রেনেল সে দিন তীরে ছিলেন। প্রাণে বাঁচলেও জাহাজের সঙ্গেই তিনি সর্বস্বান্ত হন। এগিয়ে এলেন মাদ্রাজের গভর্নর রবার্ট পক স্বয়ং। রেনেলকে তিনি প্রথমে একটি জাহাজ, পরে ছোট এক নৌবহরের দায়িত্ব দিলেন। সামরিক কাজের ফাঁকে চলল সমীক্ষাও। সাফল্যের সঙ্গে কাজ শেষ করে কলকাতা পাড়ি দিলেন রেনেল। বন্ধুভাগ্য এতটাই জোরালো, কলকাতায় পা দিয়েই যোগাযোগ হল গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের সঙ্গে, ক্লাইভের পর যিনি তখন বাংলার সর্বেসর্বা। ভ্যান্সিটার্টও যেন এমনই একজনকে খুঁজছিলেন, বাংলার প্রথম সার্ভেয়র-জেনারেল নিযুক্ত হলেন জেমস রেনেল। ১৭৬৪ সালের এপ্রিলে ভারতে আধুনিক মানচিত্র নির্মাণের সূচনা হল সদ্য একুশ পেরনো তরুণটির হাতে।
ভারতে ইউরোপীয়রা আসার আগেও মানচিত্র তৈরির ঐতিহ্য ছিল। কালিদাসের মেঘদূত-এ বিরহী যক্ষ যে ভাবে মেঘকে পথনির্দেশ দেয়, তাতে মনে হয় কবির সামনে যেন নিখুঁত মানচিত্র খোলা। প্রাচীন সাহিত্যে এমন উদাহরণের অভাব নেই। কিন্তু এই সময়ের কোনও মানচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ দেশে দীর্ঘ মুসলিম শাসনকালে সারা দেশের খুঁটিনাটি ভৌগোলিক বিবরণ সংকলনে অনেক দূর এগোনো গেলেও মানচিত্র চর্চা তেমন এগিয়েছিল বলে মনে হয় না। সতেরো শতকে জৌনপুরের সাদিক ইস্পাহানি-র বিশ্ব-মানচিত্রে ভারতও স্থান পেয়েছিল। তবে এটি নেহাতই ব্যতিক্রম। আঠেরো শতকে ভারতীয় রাজাদের উদ্যোগেও কিছু মানচিত্র তৈরি হয়। তত দিনে অবশ্য পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকদের সূত্রেই পশ্চিমী মানচিত্রের ধারণা এ দেশে এসে গিয়েছে।
জেমস রেনেল ।
ফলে ষোড়শ শতক থেকে আঠেরো শতকের মাঝামাঝির মধ্যে তৈরি হয়ে ওঠে ‘বাংলা’ অঞ্চলের বেশ কিছু মানচিত্র। সুজান গোল এই সব মানচিত্রের বিস্তারিত তালিকা দিয়েছেন তাঁর ইন্ডিয়া উইদিন দ্য গ্যাঞ্জেস বইয়ে। ইতালীয় মানচিত্রকর গাস্তালদি (১৫৪৮), পর্তুগিজ জাও দে বারোস (১৬১৫), ব্রিটিশ থর্নটন (১৬৭৫, ১৭০২), ওলন্দাজ ফান লিনেন (১৭২৬, সম্ভবত ফান ডেন ব্রোক-এর ১৬৬০-এর দশকের মানচিত্রের ভিত্তিতে), ব্রিটিশ প্লেস্টেড (১৭৫০), বা ফরাসি দঁভিল (১৭৫২) যে সব মানচিত্র এঁকেছিলেন, গুণগত মানে তা আস্তে আস্তে উন্নতির দিকে গেলেও প্রকৃত মানচিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। নাবিক, পর্যটক ও মিশনারিদের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে শিল্পীরা এই সব মানচিত্র এঁকেছিলেন, সার্ভেয়ররা নন। নদীপথ ও বন্দর এই সব মানচিত্রে গুরুত্ব পেলেও অন্যান্য ভৌগোলিক তথ্য ছিল অবহেলিত। স্থাননাম অধিকাংশই বিকৃত, স্থানাঙ্ক ঠিক না থাকায় মানচিত্রের চেহারায় ছিল অনেক অসংগতি। আসলে অভাব ছিল সরেজমিন সমীক্ষার, রেনেল ঠিক সেই কাজটাতেই হাত দিলেন।
কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। একে তো অজানা-অচেনা ভূখণ্ড, তার উপর পলাশির যুদ্ধের পর মাত্র সাত বছর কেটেছে, কোম্পানির শাসনের প্রতি আনুগত্য তখনও সর্বস্তরে চারিয়ে যায়নি। মাপজোক করতে গিয়ে কম বাধা পাননি রেনেল। ভুটান সীমান্তের কাছে সন্ন্যাসী-ফকিরদের সঙ্গে আকস্মিক সংঘর্ষে প্রাণটাই যেতে বসেছিল। পিঠে গভীর ক্ষত নিয়ে খোলা নৌকোয় ছ’দিনে তিনশো মাইল পেরিয়ে ঢাকা পৌঁছন তিনি, ভারতীয় অনুচররা ক্ষতে পেঁয়াজের প্রলেপ দিয়ে পচন ঠেকিয়ে রেখেছিল। সার্জেন ফ্রান্সিস রাসেল-এর চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত সেরে ওঠাটাও হয়তো ভাগ্যেরই জোরে। ১৭৬৭-তে তিনি ভারতের প্রথম সার্ভেয়র-জেনারেল হন। ভ্যান্সিটার্ট-এর পর ক্লাইভ, ভেরেল্স্ট, কার্টিয়ার, ওয়ারেন হেস্টিংস— গভর্নরদের সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে রেনেল নিশ্চিন্তে কাজ করেছেন, মোটা পেনশন সহ অবসর নিয়েছেন এবং ইংল্যান্ডে ফিরে মানচিত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন কোম্পানিরই আংশিক আনুকূল্যে। পাশাপাশি নিজের যোগ্যতায় রয়্যাল সোসাইটির ফেলো-র মর্যাদা থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে সমাধি, কিছুই আর অনায়ত্ত থাকেনি।
১৭৬৪-১৭৭৭, এই তেরো বছরের সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হল ১৭৮০-তে, আ বেঙ্গল অ্যাটলাস কন্টেনিং ম্যাপস অব দ্য থিয়েটার অব ওয়ার অ্যান্ড কমার্স অন দ্যাট সাইড অব হিন্দুস্তান নামে। তেরোটি মানচিত্রে ধরা রইল কোম্পানি-অধিকৃত বাংলা ও বিহার। পরের বছর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। এর পর আরও অনেক কাজ। ১৯১০-এ সার্ভে অব ইন্ডিয়া এক বার পুনর্মুদ্রণ করলেও রেনেলের বেঙ্গল অ্যাটলাস বহু দিনই দুর্লভ। এ বার কল্যাণ রুদ্রের সম্পাদনায় বইটি দু’খণ্ডে প্রকাশিত হল। প্রথমটিতে হুবহু বেঙ্গল অ্যাটলাস-এর প্রথম সংস্করণ, সঙ্গে গঙ্গার প্রবাহপথের মানচিত্র। সযত্নে মানচিত্রগুলি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, প্রতিটি স্থাননাম স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। ব্যবহারিক সুবিধার জন্য যে ভাবে মানচিত্রগুলি ভাঁজ করে বাঁধাই করা হয়েছে, তা সত্যিই দেখার মতো। দ্বিতীয় খণ্ডে রেনেলের জার্নাল (১৭৬৪-’৬৭), আ ডেসক্রিপশন অব দ্য রোডস ইন বেঙ্গল অ্যান্ড বাহার (১৭৭৮), রয়্যাল সোসাইটিতে দেওয়া বক্তৃতা, এবং ক্লিমেন্টস মার্কহ্যামের রেনেল-জীবনী। এমন সামগ্রিকতায় রেনেলকে পাওয়া এই প্রথম।
রেনেলের মানচিত্র এখনও কতটা দরকারি, ভূগোলের দিক থেকে তা ভূমিকায় স্পষ্ট করেছেন সম্পাদক। তুলনা করলে বোঝা যায়, সব থেকে বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে নদীগুলির প্রবাহপথে। যেমন রাজমহল ও জলঙ্গির মধ্যে গঙ্গার প্রবাহ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। সরস্বতী, যমুনা ও আদিগঙ্গা যে তখনই মজে গিয়েছিল, তা-ও স্পষ্ট এই মানচিত্রে। উত্তরবঙ্গ কি সুন্দরবনের আদি চেহারা এখানেই দেখা যাবে। আবার রাস্তাঘাটের যে বিবরণ রেনেল দিয়েছেন তা থেকে প্রাক-ঔপনিবেশিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ছবি পাওয়া যায়। সেই পর্বের গুরুত্বপূর্ণ জায়গার হদিশও রয়েছে।
কতটা নির্ভুল ছিল রেনেলের মানচিত্র? বড় স্কেল, খুঁটিনাটি তথ্য, এই সবের জন্যই তো তাঁর খ্যাতি। তবে কয়েক দশকের মধ্যেই এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। উনিশ শতকের গোড়ায় বিহারে সমীক্ষা করতে গিয়ে ফ্রান্সিস বুকাননও ঠারেঠোরে রেনেলের খামতির কথা বলতে ছাড়েননি। তা হলে কি নিছক কোনও ভূখণ্ডের শাসনক্ষমতা পেয়ে রাজস্ব নির্ধারণ, রাস্তা তৈরি, সেনা ও পণ্য চলাচল— এই সবের সুবন্দোবস্তের জন্যই রেনেলকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল? না ইয়ান ব্যারো যেমন দেখিয়েছেন, এর পিছনে ছিল সদ্য-প্রতিষ্ঠিত ও আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা? ইংল্যান্ডে তখন কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। বোল্ট্স-ভেরেল্স্ট কাজিয়া, রেগুলেটিং অ্যাক্ট, অ্যাডাম স্মিথের দি ওয়েলথ অব নেশনস, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। যেন কোম্পানিকে বৈধতা দিতেই রেনেল মানচিত্রে তার নাম না করে বাংলাকে ব্রিটিশ অধিকৃত বলে দেখিয়েছেন, যাতে বোঝানো যায় যে কোম্পানি শাসনের আসল সুফল পাচ্ছে ইংল্যান্ডের মানুষ; কোম্পানি যেন শুধু দখলদারি নয়, সুশাসন ও উন্নয়নে আগ্রহী। প্রতিটি মানচিত্রকে সে সময়ের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে সেটাই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নজরে পড়ে।
উদ্দেশ্য যাই থাক, বাংলা তথা ভারত-ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে নির্মিত হয়েছিল রেনেলের মানচিত্র। চমৎকার মুদ্রণে পরিপূরক বহু তথ্য সহ তা হাতে পাওয়া গবেষক ও আগ্রহী পাঠকের কাছে সৌভাগ্য বলেই বিবেচিত হবে।
আ বেঙ্গল অ্যাটলাস। মেজর জেমস রেনেল। সম্পা: কল্যাণ রুদ্র। সাহিত্য সংসদ, দুই খণ্ড ৫০০০.০০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy