বাংলা ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চার ধারাকে সূচনায় প্রসারিত করেছিলেন ‘অপেশাদার’ ঐতিহাসিকরা। আজও স্থানিক ইতিহাসচর্চার ধারা সমৃদ্ধ করছেন তাঁরাই। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন পেশার মানুষ অপরিসীম পরিশ্রমে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে যে বিপুল তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন, মূলধারার ঐতিহাসিকরা তা পুরোপুরি ব্যবহার করে উঠতে না পারলেও কিছু উদ্যোগ নজরে পড়ছে। মহিষাদল রাজ কলেজের ইতিহাস বিভাগ প্রকাশ করেছে সাময়িকপত্রে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসচর্চা/ ১৯০২-১৯৪৮ (সম্পা. সমীর পাত্র শেখর ভৌমিক, পরি: আশাদীপ, ১৭৫.০০)। রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গুরুদাস সরকার, হরিহর শেঠ, দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য থেকে নলিনীকান্ত ভট্টশালী, সুশোভন সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদারের ১৪টি দুর্লভ নিবন্ধ এই বইয়ে সংকলিত। একই ধারায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক ইতিহাস ভাবনা (মুখ্য সম্পা. অনন্ত চক্রবর্তী, তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় ও আশাদীপ, ১৫০.০০)। সাম্প্রতিক ইতিহাস গবেষণার বহুমাত্রিক রূপ তুলে ধরেছে অমলশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর ভৌমিক, সোমশংকর রায়, অনন্ত চক্রবর্তী, রক্তিম সুর প্রমুখের ১৩টি নিবন্ধ। বিভিন্ন জেলার ইতিহাস চর্চার বিশ্লেষণের সঙ্গে আছে নানা বিষয়।
উত্তরবঙ্গের ইতিহাস চর্চায় সম্প্রতি গতি এনেছে অনেকগুলি প্রকাশনা। জয়নাথ মুন্সির রাজোপাখ্যান (রচনা ১৮৪৫) কোচবিহার তথা বাংলার ইতিহাস বিষয়ে সর্বপ্রথম গ্রন্থ, আকরগ্রন্থ হিসাবে তা গুরুত্ব পায় আজও। ১৯৩৮-এ প্রথম মুদ্রিত বইটি বিশ্বনাথ দাস সম্পাদনা করেন ১৯৮৫ সালে। এ বার বিস্তারিত টীকা, প্রাসঙ্গিক তথ্য, গ্রন্থকারের জীবনী ও সংযোজন সহ সটীক রাজোপাখ্যান প্রকাশ পেল তাঁরই সম্পাদনায় (দি সী বুক এজেন্সি, ৩০০.০০)। কোচবিহারের ইতিবৃত্ত (সাহিত্যশ্রী, ৩০০.০০) সম্পাদনা করেছেন রণজিত্ দেব। এই বইয়ে কোচবিহার পরিচয়, নৃপতিবর্গ, সমাজ-সংস্কৃতি, প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা, ভাষা ও সাহিত্য, নারায়ণী মুদ্রা ও বিচারব্যবস্থা: এই ক’টি বিভাগে ২০টি নিবন্ধ সংকলিত। সব মিলিয়ে ফুটে উঠেছে কোচবিহারের ঐতিহাসিক চিত্র। রণজিত্ দেব প্রয়াসী হয়েছেন উত্তরবঙ্গের ইতিবৃত্ত সংকলনে। তাঁর উত্তরবঙ্গের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (দেশ প্রকাশন, ৩৫০.০০) প্রকাশিত, এটি চার খণ্ডে সম্পূর্ণ হবে বলে সূচনায় জানিয়েছেন লেখক। প্রথম খণ্ডের তিনটি অধ্যায়ে উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলা কোচবিহার, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহ ও দার্জিলিঙের নামকরণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, গম্ভীরা-ভাওয়াইয়া-চা বলয়ের গান-গোরক্ষনাথের গান, জনজাতি, সমাজজীবন, ছিটমহল ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
সমিত ঘোষ দীর্ঘ দিন গ্রামগ্রামান্তরে ঘুরে সরেজমিন ক্ষেত্রানুসন্ধানে তথ্য সংগ্রহ করে লিখেছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের পুরাকীর্তি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস (অমর ভারতী, ৫৫০.০০)। ভৌগোলিক প্রেক্ষিত, প্রশাসনিক ইতিহাস, বিপ্লব আন্দোলন, ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, পর্যটন, পুজো-পার্বণ, জমিদারি ব্যবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে তিনি খঁুটিয়ে লক্ষ করেছেন আরও নানা দিক: লৌকিক জলযান, প্রাচীন দিঘি, ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক সৌধ, প্রাচীন শিল্প, শ্মশান ও গোরস্থান, জেলার মাড়োয়ারি ও মুসলিম সম্প্রদায়, পত্রপত্রিকা, নাটক-যাত্রা-সিনেমা, ব্রহ্মোত্তর-পিরোত্তর-চার্চল্যান্ড, ধর্মসংস্কার, হাটবাজার ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
প্রণব রায়ের মেদিনীপুর/ ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন, ষষ্ঠ খণ্ড (সাহিত্যলোক, ৪৫০.০০) প্রকাশিত হয়েছে। অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার পূর্ব ও পশ্চিম ভাগের পুরাকীর্তি যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডের উপজীব্য। বিভিন্ন থানার অনুক্রমে জেলার সমৃদ্ধ পুরাস্থলগুলি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন প্রবীণ প্রত্নবিদ। ১৫০টি আলোকচিত্র এবং সংগৃহীত তথ্যভাণ্ডার এটিকে আকরগ্রন্থের মর্যাদা দেবে। স্থানিক ইতিহাস অনুসন্ধিত্সু তাপস মাইতি মেদিনীপুরের খণ্ড ইতিহাসকে সামগ্রিকের অবয়বে ধরতে চাইছেন নিয়মিত প্রয়াসে। তাঁর সম্পাদিত তাম্রলিপ্তের কথা (উপত্যকা, মেদিনীপুর, ৭০০.০০) এক ইতিহাসমৃদ্ধ অঞ্চলের অতীত থেকে বর্তমানকে ধরে রেখেছে ২৯টি নিবন্ধে। চিন্ময় দাশের ‘পরিবহণ পরিচিতি’, ‘বারো মাসে বাইশ পার্বণ’, অসীমকুমার মান্নার ‘জীব-বৈচিত্র’ কৌতূহল জাগায়। তাপস মাইতির সম্পাদনায় উপত্যকা থেকেই প্রকাশিত মেদিনীপুরের রাজবাড়ি জমিদার বাড়ি ২ (২০০.০০) ৩৫টি রাজবাড়ি-জমিদারবাড়ির কথা, আগের খণ্ডে ছিল ২৫টি। অনেক তথ্য এখানেই প্রথম সংকলিত হল। একই সম্পাদকের মেদিনীপুরের গ্রামের কথা ৮ (৩০০.০০), যেখানে ৭৯টি গ্রামবিবরণ সংকলিত। এর আগের ৭টি খণ্ডে ছিল ৫৭৭টি গ্রামের কথা। এমন গ্রামকোষ যদি সব জেলায় তৈরি হত!
নদিয়া জেলার ইতিহাস অনুসন্ধানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছেন মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল (নদিয়া চর্চা। অমর ভারতী, ৫৫০.০০)। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে সংগৃহীত প্রায় ষাটটি নিবন্ধে উঠে এসেছে ইতিহাস-পুরাতত্ত্ব, মেলা, পাল-পার্বণ ও সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সামাজিক আন্দোলন, শিল্প ও খেলাধুলা, নদনদী খালবিল, নবদ্বীপের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়। বীরভূমের ইতিহাস সংক্রান্ত প্রথম বাংলা বইটি সযত্নে সম্পাদনা করেছেন পার্থশঙ্খ মজুমদার (বীরভূম রাজবংশ, মহিমানিরঞ্জন চক্রবর্তী। আশাদীপ, ২০০.০০)। দুর্লভ বইটির সঙ্গে রয়েছে বিস্তারিত টীকা, মহিমানিরঞ্জনের জীবনী ও আলোকচিত্র। বীরভূমের শহর সাঁইথিয়ার বিবরণ সংকলন করেছেন দেবাশিস সাহা ও আদিত্য মুখোপাধ্যায় (সাঁইথিয়ার ইতিহাস। সঞ্জীব প্রকাশন, ২০০.০০)। ২৭টি নিবন্ধে এই বাণিজ্য শহরের অতীত-বর্তমানের নানা প্রসঙ্গের মধ্যে জমিদারদের কথা, জৈন ধর্ম ও উত্সব, মুসলিম সমাজ উল্লেখযোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy