পান্ডার খাতা। উজ্জয়িনী। ছবি: শেখর ভৌমিক
জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘নির্জন সৈকতে’-র পান্ডা চরিত্রে রবি ঘোষকে মনে পড়ে? হাওড়া থেকেই ছায়া দেবীর টিমকে ধাওয়া করা এবং শেষে পুরী স্টেশনে ঝোলা থেকে লম্বা খাতা বার করে বাপ-ঠাকুরদার নাম ইত্যাদি প্রশ্নে যিনি অনিল চ্যাটার্জিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন? শেষ অবধি সে খাতায় নাম-ধাম পাওয়া গিয়েছিল কি না জানি না, তবে খাতা থেকে যে ভাবে মাহেশের বসু বংশের তালিকা বার করেছিলেন, তাতে যাজপুরের ‘পাণ্ডাগণের বাহাদুরী’ দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু। শেষে লিখেওছিলেন— ‘বলিতে কি, যাঁহাদের পূর্ব্বাপর কুর্শীনামা বা বংশলতা হারাইয়াছে যাজপুরের পাণ্ডাগণের খাতা হইতে তাঁহাদের বংশলতা কতক উদ্ধার হইতে পারে।’ মহার্ঘ এই সূত্রটি হাতিয়ার হিসাবে পেশাদার ইতিহাসবিদদের ব্যবহারের অনেক কাল আগেই তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন রাজকুমার চক্রবর্তী এবং অনঙ্গমোহন দাস, সন্দ্বীপের ইতিহাস গ্রন্থে। বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলোর বংশতালিকা খুঁজতে তাঁরা সেই যাজপুরেই উপস্থিত হয়েছিলেন।
২০০১-এ ‘ট্র্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ট্র্যাডিশনাল নলেজ’ নামে একটি পত্রিকাও বেরোয়। কিন্তু হিন্দু তীর্থস্থানের পান্ডাদের কাছে থাকা অমূল্য তথ্য সম্পর্কে বিশদে আলোচনা হয়নি। পুরী, কামাখ্যা, হরিদ্বার ও রামেশ্বরের তীর্থ-পুরোহিতদের ‘বহি’তে থাকা বংশলতিকাই ভারতীয় নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষণ আলোচ্য গ্রন্থে ধরতে চেয়েছেন।
সম্পাদক সূচনাতেই লিখে দিয়েছেন, বহু শতাব্দী ধরে পান্ডাদের কাছে থাকা তীর্থযাত্রীদের নথিপত্তরের সাহায্যে একটি ঐতিহ্যগত জ্ঞান পরম্পরাকে আবিষ্কার করেছে এই গ্রন্থ এবং যা কিনা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু মূল আলোচ্য বিষয়ের বিশদে না গিয়ে, ১৮৪ পৃষ্ঠার বইয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জু়ড়ে রয়েছে শিরোনাম-বহির্ভূত বিষয়। অন্তত পুরীর ক্ষেত্রে যে-সব বিবরণ রয়েছে, তা ব্রজকিশোর ঘোষ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৭০ বছর আগেই দিয়ে গিয়েছেন।
হোঁচট খেতে হল প্রথমেই। সেখানে বলা হচ্ছে, প্রতিহারীদের ‘জগন্নাথের মহিমা-প্রচারে’ দূত হিসাবে দূর দেশে পাঠানো হত। এ রকম নিয়োগ কারা করতেন জানা নেই। যাত্রী নিয়ে আসতে তাঁরা দূর-দূরান্তরে যেতেন বটে, তবে মহিমা প্রচারের কোনও উদ্দেশ্য তার মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মতো গবেষক লিখেছেন, এঁদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মন্দিরের ভেতরের সাতটি দ্বার রক্ষা করা, যাত্রীদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আর ‘এজেন্ট’ হয়ে যাঁরা দূর দেশে যেতেন, তাঁদের বলা হত ‘বাটুয়া’। পুরীর তুলসীচৌরা, বলঙ্গা-র (বিশ্বময় পতি এর কথা উল্লেখ করেছেন) মতো বেশ কিছু গ্রাম ছিল, যেখানকার বহু মানুষের পেশা-ই ছিল যাত্রীদের পুরীতে নিয়ে আসা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এঁরাই ‘সাথুয়া’, ‘সেথো’— এই সব নামে পরিচিত ছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতী বা লালবিহারী দে’র গোবিন্দ সামন্ত-র মতো বহু উপন্যাসে এঁদের উল্লেখ আছে। শুধু প্রতিহারী বা খুন্টিয়া নয়, ‘ছত্রিশ নিয়োগ’-এর অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকলেই যাত্রী টানতে দূর-দূরান্তে যেতেন অনেক কাল আগে থেকেই, সাধারণ মানুষের কাছে যাঁরা সকলেই ‘পান্ডা’ নামে পরিচিত হয়ে আসছেন।
পুরীর চারটি পান্ডা-এস্টেট সংক্রান্ত আলোচনা প্রাসঙ্গিক। যেমন প্রাসঙ্গিক হল পর্যটনের প্রভাবে যজমানি সংস্থার সুদীর্ঘ পরম্পরাটি বিলুপ্তপ্রায়— এই উপলব্ধি। হরিদ্বারের যাত্রী-বহির কথা অনেক কাল আগেই ইতিহাসবিদ টম কিসিঙ্গারের বিলায়তপুর গ্রন্থে উঠে এসেছিল। কামাখ্যার ক্ষেত্রে মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে যাত্রীদের নথি আপডেট করার তথ্যটি বেঠিক। মন্দিরে যাত্রীদের কোনও নথিই রক্ষিত নেই, আপডেট তো পরের প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা, লাল কাপড়ে মোড়া বংশাবলির যে-ছবি কামাখ্যা মন্দিরে ‘রক্ষিত’ বলে দেওয়া হয়েছে, তা-ও গোলমেলে। যে ছবিগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, তা সম্ভবত গুয়াহাটি পানবাজারে অসম সরকারের ‘বুরঞ্জি আরু পুরাতত্ত্ব’ বিভাগ (ডিরেক্টরেট অব হিস্টরিক্যাল রেকর্ডস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ) থেকে সংগৃহীত এবং যার বিষয়বস্তুও বংশাবলি নয়। যাঁদের ঋণ স্বীকার করা হয়েছে, কামাখ্যা মন্দিরের সেই কমল শর্মা বা প্রতাপ শর্মার মতো দু’-এক জন মানুষ এতই মহানুভব যে নিজেদের ‘অবদান’-এর কথা তাঁরা মনেই করতে পারেননি।
কামাখ্যা বিষয়ক আলোচনার তিনটি পরিশিষ্ট রচনায় যে মানুষটি সাহায্য করেছিলেন বলে দাবি করছেন, তাঁর নামটিই বাদ পড়েছে দেখলাম। কামাখ্যার পান্ডাদের যে নথিগুলি মুদ্রিত হয়েছে, তার মানও যথেষ্ট খারাপ। রামেশ্বরমের ক্ষেত্রে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুর যাত্রীদের মধ্যে পান্ডার খাতায় নথি রাখার প্রচলন নেই বললেই চলে। পুরীর ক্ষেত্রেও যা আংশিক ভাবে সত্য। বঙ্গসন্তান আজ প্রায় অধিকাংশই নিজ জেলার পান্ডার পরিবর্তে যেখানে উঠেছেন, সেই হলিডে হোম বা হোটেল-এর নির্দিষ্ট পান্ডা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। অথচ হিন্দি বলয়, বা অসমের লোকজনকেও দেখেছি, মন্দির সন্নিহিত এলাকায় নিজ নিজ রাজ্যের পান্ডা-ঠাকুরের অতিথিশালায় ক’দিন দিব্যি কাটিয়ে দেন। এর কারণ অবশ্য বৃহত্তর গবেষণার বিষয়। যজমানি সম্পর্কের কথা বহু বার বলা হলেও, আশি বছর আগে ওয়াইজার সাহেবের লেখা দ্য হিন্দু যজমানি সিস্টেম বইটির অনুল্লেখ নজর কাড়ল।
‘দশখতি’ খাতা, অর্থাৎ যেখানে যাত্রী নিজের ভাষায় স্বাক্ষর করেন, ক্ষেত্রবিশেষে অনেক তথ্যও রেখে যান, আশা করা যায় লেখকরা তা দেখেছেন। বহু ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক ভাবে যজমানি সম্পর্ককে একচেটিয়া করতে যাত্রীকে দিয়ে ‘আমার বংশে যে আসবে, সে এই পান্ডাকে স্বীকার করবে, না হলে নরকগামী হবে’ জাতীয় বাক্য লেখানো হত। হরিদ্বারের পান্ডারা কী ভাবে কালি তৈরি করেন, এ সবের চেয়ে এ জাতীয় তথ্য কিছু পেলে সমৃদ্ধ হওয়া যেত। আবার, পান্ডারা বহু ক্ষেত্রে আজও জেলার পরিবর্তে পুরনো পরগনা পরিচয় দিয়েই যাত্রীকে চেনেন (অন্তত পুরী বা গয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই)— মন্ডলঘাট, কাশীজোড়া, সেলিমাবাদ— এই সব নামে। এও তো ঐতিহ্যগত জ্ঞান, প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভৌগোলিক পরিচিতি। এ ধরনের বিষয় কেন লেখকদের নজর এড়িয়ে গেল, বুঝলাম না।
বিষয়টি নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ইতিহাসবিদরা নাড়াচাড়া করে আসছেন অনেক কাল। বি এন গোস্বামী পাহাড়ি চিত্রকলার শিল্পীদের সঠিক বংশলতা খুঁজতে কুরুক্ষেত্র বা হরিদ্বারের পান্ডাদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। সে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগেই। রাজস্থানের চারণ সম্প্রদায়ের কাছেও এ ধরনের বংশলতা থাকে। কালিকারঞ্জন কানুনগো তাঁদের নিয়ে লিখেছিলেন। বাংলার ভাট-দের কাছেও এ ধরনের নথি ছিল বা আজও কিছু থাকতে পারে, যা কাজে লাগিয়ে ‘আগামী দিনের’ গবেষক নতুন ইতিহাস নির্মাণ করবেন বলে আশাবাদী ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। ইতিহাসবিদ আর নৃতত্ত্ববিদ-এর সমন্বয়টা এই সব কাজে জরুরি। বার্নার্ড কন তো কবেই সে কথা বলে গিয়েছেন। সেটা প্রায় হয় না বললেই চলে।
নৃতত্ত্ববিদ্যা চর্চায় ‘ভারতীয় সভ্যতা’ একটি বিশেষ ঘরানা হিসেবে একদা সক্রিয় ছিল। ইরাবতী কার্ভে, নির্মলকুমার বসু, ললিতাপ্রসাদ বিদ্যার্থী বা বৈদ্যনাথ সরস্বতীর মতো মানুষ হিন্দু মন্দির/তীর্থ— এ সব নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই ধারায় উজ্জ্বল সংযোজন হতে পারত এই বই। তবে পান্ডাদের কাছে এ ধরনের তথ্য থাকার উল্লেখটুকু অন্তত এঁরা করেছেন। কত লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই কাজ হয়েছে জানা নেই। তবে যেহেতু সরকারি অর্থ, তাই এই নথির অভিলেখাগার তৈরি করা উচিত নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষণে, যাতে সুপটু হাতে আগামী দিনে তার উপযুক্ত ব্যবহার হতে পারে।
জিনিয়লজিক্যাল রেকর্ডস অ্যান্ড ট্রাডিশনাল নলেজ সিস্টেম। সম্পাদনা: কাকলি চক্রবর্তী। অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া/ জ্ঞান পাবলিশিং হাউস, ৫৫০.০০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy