আলোচ্য বইটি ইউরোপীয় গণতন্ত্রের নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনের দাবিদাওয়ার সঙ্গে অভিবাসী মুসলিম সমাজের খাপ খাওয়ানোর সমস্যার দলিল। প্রধানত সালাফি ইসলামের সঙ্গে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: মানবাধিকার, আইনের শাসন, লিঙ্গসাম্য, উদারনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বন্দ্বই এ ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে উঠেছে। সালাফি মতবাদ অনুযায়ী ‘ভাল মুসলমানরা’ ধর্মীয় ভাবে গোঁড়া, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও সাম্যভাবনার বিরোধী, নারীদের হিজাব পরিয়ে রাখে, যৌন স্বাধীনতাকে পাপ মনে করে এবং অমুসলিমদের সংস্রব এড়িয়ে চলে। যারা তা করে না, তারা ‘খারাপ মুসলমান’— পশ্চিমী সভ্যতার অবক্ষয়ে গা ভাসিয়ে অধঃপতিত। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের জীবনধারা অভিন্ন নয়, তাদের সংস্কৃতি ও লোকাচারেও ভিন্নতা রয়েছে, যেমন রয়েছে তাদের জাতীয় ও জনজাতীয় পরিচিতিতে।
মুসলিমরা ইউরোপের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’, কেননা তারা ইউরোপীয় সমাজের মৌলিক উদারনৈতিক মূল্যবোধগুলি বিপন্ন করে তোলে। শহরাঞ্চলে বেকার তরুণ ও বস্তিবাসিন্দা হিসাবে সরকারের কাছে বোঝাও বটে। আর তারা ‘বাইরের শত্রু’ হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের ফলে। এই প্রেক্ষিতে হিজাবে মাথা ঢাকা থেকে শুরু করে হালাল করে মাংস খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম বৈশিষ্ট্যই এক-একটি ‘রাজনৈতিক ক্রিয়া’ হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে, যা ইউরোপীয় সমাজের চোখে ‘অবৈধ’। আর এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় মুসলিমরা ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘বাইরের লোক’ হয়ে পড়ছেন, যা ইউরোপীয় জাতীয়তার সঙ্গে মিশে যেতে তাঁদের বাধা দিচ্ছে।
গির্জা থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করা, ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপকে একান্ত ব্যক্তিগত আচরণের আঙিনায় ঠেলে দেওয়া এবং সাধারণ ভাবে ধর্মাচরণে আগ্রহ হারানো ইউরোপীয় সেকুলারিজ্ম-এর যা চেহারা, সেটাকেই ধর্মনিরপেক্ষতার সর্বজনীন আদর্শ বলে ধরে নেওয়ার চল বহু দিন। তাই মুসলিমরা যখন পোশাক, খাদ্যাভ্যাস কিংবা ধর্মাচরণে (সমবেত নমাজপাঠ) আত্মপরিচয় আঁকড়ে থাকছেন, তখন ইউরোপীয় সেকুলার সভ্যতা প্রমাদ গুনছে। সেকুলারিজ্ম নিজেই একটি পাল্টা ধর্মবিশ্বাসের মতো অনমনীয় মতাদর্শ হয়ে উঠছে, যা প্রকাশ্য জনস্থান থেকে সর্বতোভাবে ধর্মকে নির্বাসিত করতে চায়। ইউরোপীয় মুসলিমরা এই ‘ন্যারেটিভ’টার পরিবর্তন চান।
জসলিন সেসারি সম্পাদিত এই হ্যান্ডবুকটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় ইসলাম (ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম), ১৯৭৪-পরবর্তী অভিবাসনের হাত ধরে ইসলামের ইউরোপে (ইতালি, স্পেন, গ্রিস ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া) আগমন, ইসলামের প্রাচীন ইউরোপীয় ভূমি (বসনিয়া-হারজেগোভিনা, আলবেনিয়া, রাশিয়া ও বুলগেরিয়া) ছাড়াও ইসলাম ও ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ইসলাম ও ইউরোপীয় রাজনীতিতে বিন্যস্ত। প্রতিটি রচনা তথ্যে ঠাসা, অসংখ্য পাদটীকায় ঋদ্ধ। তবে ইসলামের সঙ্গে ইউরোপের আদি পরিচয় বা সংঘাত কিংবা ইউরোপীয় ভূখণ্ডে (স্পেন বা সিসিলি) দীর্ঘস্থায়ী ইসলামি শাসনের কথা কিংবা ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও রিফর্মেশন-এ সেই শাসনের প্রভাবের কথা গ্রন্থে অনুক্ত, অনালোচিত। কেননা এর আলোচনার পরিধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মুসলিম অভিবাসনের সঙ্গে ইউরোপের ঘাত-প্রতিঘাতে সীমাবদ্ধ।
২০০৯ সালে সুইস পিপল্স পার্টির নির্বাচনী স্লোগান ছিল—‘শরিয়া নয়, মারিয়া’। অন্য দিকে উগ্রপন্থী মুসলিম গোষ্ঠীগুলি ‘শরিয়া ফর বেলজিয়াম’, ‘শরিয়া ফর হল্যান্ড’ স্লোগান দিয়ে ভোটে নেমেছিল। শরিয়ত অর্থাত্ ইসলামি আইনবিধির কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ ব্রিটিশ আইনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ (কার্যত অ্যাঙ্গলিকান চার্চের পোপ) সেই মন্তব্য করে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল যখন বললেন, ইহুদি ও খ্রিস্টান ঐতিহ্যের মতো ইসলামও জার্মানির সভ্যতা-সংস্কৃতির অঙ্গ, তখনও সমালোচনা কম হয়নি। পশ্চিম ইউরোপের যে সব দেশ প্রাচ্যে উপনিবেশ গড়েছিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে সেখান থেকে লাখে-লাখে মুসলিম রুজির খোঁজে ইউরোপে অভিবাসী হন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি এঁদের বসবাস, জীবনচর্যা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার, গোষ্ঠীগত ও জনজাতীয় কৃষ্টি, প্রতীক লোকাচার আঁকড়ে থাকা একটা সামাজিক অস্বস্তি ও বিরোধ সৃষ্টি করে। ইউরোপীয় গণতন্ত্র যে বহুত্ববাদ ও অধুনা বহুসংস্কৃতিবাদের ঢাক পেটায়, তাতে খ্রিস্টীয় ও ইহুদি সংস্কৃতির সমান্তরালে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশেরও সুযোগ থাকা উচিত, অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে। কিন্তু মুসলিমরা ইউরোপে ‘অপর’ই থেকে যান। সেই সূত্রেই তাঁদের বেশভূষা, মুসলিম মহিলাদের হিজাব-নকাব-বোরখা পরার অধিকারকে বৈষম্যমূলক, নারীবিদ্বেষী, অতএব ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী বলে শনাক্ত করা হয়। প্রাচ্যে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান, জেহাদি জঙ্গিপনার বাড়বাড়ন্ত, মার্কিন-ইউরোপীয় আধিপত্যকামিতার সঙ্গে তার সংঘাত যে বৈরিতা লালন করে, আল-কায়দা, তালিবান, সাদ্দাম হুসেনের স্বাধিকারপ্রমত্ততা, খোমেইনির ইসলামি বিপ্লব, ৯/১১-র পরম্পরা মিলে তা ক্রুসেডের সময়কার শত্রুতাপূর্ণ বিদ্বেষকেই যেন পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। ফলে অভিবাসী মুসলিমদের প্রতি ইউরোপের মনোভাব উত্তরোত্তর কঠোর, অনমনীয় হতে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসলীলা এবং তা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পুনর্নির্মাণের তাগিদ যে বাড়তি জনসম্পদ ও শ্রমসম্পদ দাবি করে, তা মেটাতে উত্তর আফ্রিকার উপনিবেশ থেকে দলে-দলে মুসলিম অভিবাসী হন। ফ্রান্সে এর সঙ্গে যুক্ত হয় (১৯৫৪-’৬২) আলজিরীয় যুদ্ধোত্তর অভিবাসন। পরবর্তী প্রজন্মে শিক্ষার সুযোগের অভাব, বেকারত্ব এবং বর্ণবৈষম্যের শিকার অস্থির, ভবিষ্যত্হীন, হতাশাগ্রস্ত ও মরিয়া মুসলিম তরুণরা আত্মপরিচয়ের উপাদান হিসাবে ধর্মাচরণকে আঁকড়ে ধরেন। তখনই ইউরোপীয় সেকুলারিজমের সঙ্গে তাঁদের বিরোধের সূচনা। প্রকাশ্য জনস্থানে ধর্মাচরণ বা ধর্মীয় প্রতীক (যথা হিজাব) ব্যবহার করা যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে এই বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। মাদ্রাসা জাতীয় বেসরকারি মুসলিম শিক্ষায়তনের জন্য ইউরোপে কোনও সরকারি অনুদান বা ভর্তুকি নেই। মসজিদ বানাবার কিংবা সমবেত নমাজ পাঠের জন্যও সরকার কোনও স্থায়ী প্রাঙ্গণ ছেড়ে দিতে নারাজ, মক্কার দিকে মুখ করে কবর দেওয়ার মতো গোরস্তানের জমিও অমিল। অনেক ফরাসি মুসলিম তাই তাঁদের ফেলে-আসা স্বদেশের কবরেই সমাধিস্থ হতে চান।
ফ্রান্সে ইসলাম-আতঙ্কের সূচনা ১৯৯৫ সালে প্যারিসের মেট্রো স্টেশনে আলজিরীয় সন্ত্রাসবাদীদের ফিদাইন হামলা থেকে। এর পর ঘটে আলজিরীয় ফরাসি মহম্মদ মেরা’র ২০১২-র হামলা। ১৯৯৫ থেকেই ফ্রান্সে মুসলিম অভিবাসন নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। ব্রিটেনের ২৭ লক্ষ মুসলিম সে দেশের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ, যাঁদের অধিকাংশই ১৯৪৫ সালের পর রুজির টানে আসতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে স্থায়ী আস্তানা গড়ে ওঠে নানা নাগরিক কেন্দ্রে। প্রথম দিকের অভিবাসীরা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের, পাক পঞ্জাব ও বাংলাদেশের শরণার্থী। কিন্তু ৯০-এর দশক থেকে বসনিয়া, সোমালিয়া, কুর্দিস্তান, পরে আলজিরিয়া, আফগানিস্তান, মিশর ও নাইজিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধদীর্ণ দেশ থেকেও অভিবাসন চলতে থাকে। ব্রিটিশদের ধারণা, মুসলিমরা মূল স্রোতে মিশতে দেরি ও দ্বিধা করেন পশ্চিমী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি সন্দেহ ও বিরূপতার কারণে। ইসলামি সন্ত্রাসের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণে তাঁরা তত্পর নন। তবে ইউরোপে মুসলিমদের প্রতি বিরূপতা সবচেয়ে বেশি জার্মানি, হাঙ্গারি, ইতালি ও পোল্যান্ডে। তার পরে আছে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস। তুলনায় পর্তুগাল অপেক্ষাকৃত সহনশীল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ভূমিকা এর পিছনে কম নয়।
জর্জ বুশ ইসলামকে ‘অবরুদ্ধ আমেরিকার উপর হামলে পড়া বাইরের শত্রু’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ইউরোপ কিন্তু ইসলামকে ‘অন্দরের শত্রু’ বলে মনে করে। তাকে বাগে আনতে তাই রকমারি নাগরিকত্বের পরীক্ষা চালু হয়েছে। পাশ্চাত্য মূল্যবোধ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ইউরোপীয় জীবনচর্যা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি বিষয়ে মুসলিম অভিবাসীদের কাছে প্রশ্নমালা পাঠিয়ে উত্তর জানতে চাওয়া হচ্ছে।
যাঁরা ইউরোপীয় ইসলাম নিয়ে, বিশেষত ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইসলাম নিয়ে চর্চা করতে আগ্রহী, তাঁদের কাছে এই বইটি আকরগ্রন্থের মর্যাদা পাবে। এত বিপুল তথ্য একত্র করা এবং আরও বিপুলতর তথ্যের উত্সের সন্ধান দেওয়া দুরূহ কাজ। গ্রন্থের লেখকরা সেই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে নিষ্পন্ন করে গবেষকদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy