Advertisement
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথের প্রসারণ

যাঁদের ভাষার প্রমিত রূপ তিনি প্রায় নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেই জাতি আজ নিজেরই কৃতকর্মের ফলে দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত, এবং পৃথিবীর অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মাঠে কমজোরি।

দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৪৯
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি ‘কেমব্রিজ কম্প্যানিয়ন’ প্রকাশিত হওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের সংবাদ। এই পাঠ-সহায়িকা সিরিজ়টি বিখ্যাত লেখক-লেখিকা, দার্শনিক, শিল্পী প্রমুখের সৃষ্টি সামগ্রিক ভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এক জন মানুষের সৃষ্টি ও চিন্তার সঙ্গে সে বিষয়ে কৌতূহলী কিন্তু বিশেষজ্ঞ নন, এমন পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেয় এই সিরিজ়; আবার যাঁরা সেই মানুষটিকে নিয়ে নিয়মিত চর্চা করেন, তাঁদের জন্যেও চিন্তার খোরাক থাকে এই সব গ্রন্থে সঙ্কলিত বিশেষজ্ঞ-রচিত প্রবন্ধে। এখানে বিষয় যে হেতু রবীন্দ্রনাথ, আমার মতো পাঠক হয়তো দুই কোঠাতেই পড়েন। রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ নই, আবার শুধু লেখাপড়ার নয়, জীবনধারণের সূত্রেও রবীন্দ্রনাথ নানা ভাবে এসেই পড়েন, তাই প্রকাশকের একটি দাবি মেনে নিতে দ্বিধা নেই— বৈচিত্রময় রবীন্দ্রপ্রতিভার বিভিন্ন দিকের মননশীল ও গবেষণাপুষ্ট আলোচনা এমন একটি খণ্ডে একত্রিত করার দৃষ্টান্ত আগে চোখে পড়েনি। এই প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই সাধুবাদযোগ্য।

সম্পাদক তাঁর কাজ নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ বলেই কাজটি সহজ ছিল না। কেন সহজ ছিল না, তা মাথায় রাখলে বর্তমান সময়ে এই বইটির ভূমিকা ও তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য হয়। তাই সেই আলোচনাটা প্রথমে সেরে বইটির পরিচয় দিই।

মূল যে অসুবিধের কথা সুকান্ত চৌধুরী বইয়ের ভূমিকার গোড়াতেই বলেছেন, তা হল এই— রবীন্দ্রনাথ বহুশ্রুত নাম ঠিকই, যে ভাষাকে আশ্রয় করে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ, সেই বাংলা আজ জনসংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর সপ্তম ভাষা ঠিকই, কিন্তু বিশ্বের সাহিত্যের দরবারে সে প্রায় অনুপস্থিত (পৃ xiii)। এমনকি, ভারত-পাকিস্তানে অবাঙালি যাঁরা আজ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁদের মধ্যেই বা ক’জন আজও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভাবিত হন? এই বইয়ে সঙ্কলিত তাঁর প্রবন্ধে হরিশ ত্রিবেদী জানাচ্ছেন যে, বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভারতের ‘সাহিত্যিক চেতনা’ থেকে লুপ্তপ্রায় বলা যেতে পারে (পৃ ১৯৮)।

এটা রবীন্দ্রনাথের দোষ নয়, দুর্ভাগ্য। যে বাঙালি জাতির উত্থানের কালে তিনি ‘বিশ্বকবি’ হয়ে উঠেছিলেন, যাঁদের ভাষার প্রমিত রূপ তিনি প্রায় নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেই জাতি আজ নিজেরই কৃতকর্মের ফলে দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত, এবং পৃথিবীর অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মাঠে কমজোরি। এ কথা ঠিক যে, একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা এখন একটা রাজনৈতিক সম্মান পায়, যা হয়তো ১৯৪৭-এর ভারত ও পরবর্তী কালে পাকিস্তান অখণ্ড থাকলে সম্ভব হত না। কিন্তু দুই বাংলার বাইরে আজ আর বাংলার আধুনিকতা বা রবীন্দ্রনাথ, ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’ যাকে বলা হয়, তার অংশ নন। একটা সময় ছিল, যখন ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে মানুষ শান্তিনিকেতনে আসতেন: রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে বাঙালিকে জানার জন্য। শ্রদ্ধেয় আবু সইদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে নিবিড় ভাবে জানবেন বলেই বাংলা শিখেছিলেন। সেই সম্প্রসারিত বাঙালি জীবন— রবীন্দ্রনাথ নিজেই যার এক অগ্রণী স্রষ্টা— আজ অন্তর্হিত। এই বইয়ের উদ্দিষ্ট পাঠক পৃথিবীর যে কোনও দেশের আগ্রহী মানুষ হতে পারেন, অথচ এই বইতে সঙ্কলিত পঁচিশটি প্রবন্ধের মধ্যে কুড়িটিরই রচয়িতা বাঙালি। এই তথ্য থেকেও তো হালফিলের রবীন্দ্রচর্চার অবস্থা কিছুটা বোঝা যায়।

দ্য কেমব্রিজ কম্প্যানিয়ন টু রবীন্দ্রনাথ টেগোর
সুকান্ত চৌধুরী
৬৯৫.০০
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস

দ্বিতীয় অসুবিধের কথাটা সহজেই অনুমেয়। বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথে আগ্রহী পাঠকের সংখ্যা কম। আগ্রহী পাঠক তৈরি করা এই ধরনের গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়— কোনও কারণে পাঠক রবীন্দ্রপাঠে আগ্রহী হয়ে থাকলে তবেই এই বই একটি সহায়িকা। আশার কথা এই যে, সংখ্যায় কম হলেও আমাদের উপমহাদেশে ও পৃথিবীর অন্যত্র নানা জায়গায় কিছু মনোযোগী রবীন্দ্রগবেষক ও পাঠক ছড়িয়ে আছেন। তা ছাড়া, গত কয়েক দশকে পৃথিবীতে আগ্রাসী, হিংস্র জাতীয়তাবাদের

উত্থান ও শিল্পসভ্যতার প্রাকৃতিক ক্রমবর্ধিষ্ণু বিপর্যয় আমরা যত দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ততই স্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। এমনকি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আদৌ নন, বাংলাও জানেন না, কিন্তু আজকের পৃথিবী নিয়ে ভাবিত পাশ্চাত্যের এক প্রখ্যাত দার্শনিককে দেখেছি আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়তে। এই রকম মানুষেরা এই বই হাতে পেয়ে আহ্লাদিত হবেন।

বইটির তিনটি ভাগ। প্রথম ভাগে দুই বাংলায় রবীন্দ্রচর্চার দুই প্রধান ও অগ্রণী পথিক— শঙ্খ ঘোষ ও সদ্যপ্রয়াত আনিসুজ্জামান সাহেব— এঁদের রবীন্দ্রনাথের জীবন ও চিন্তার সম্পর্ক ও স্ববিরোধ-সন্ধানী দু’টি প্রবন্ধ সাবলীল ইংরেজি অনুবাদে উপস্থাপনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে আছে ন’টি প্রবন্ধ। লেখকেরা রবীন্দ্রসৃষ্টির এক একটি দিক ধরে সেই দিকটির একটি সার্বিক বা পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই পর্বে প্রবন্ধ লিখেছেন বিশ্বজিৎ রায় (রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সময়), সুকান্ত চৌধুরী (রবীন্দ্রকাব্য), আশীষ লাহিড়ী (রবীন্দ্রসঙ্গীত), আনন্দ লাল (রবীন্দ্রনাট্য), সুপ্রিয়া চৌধুরী (গদ্যসাহিত্য), ফকরুল ইসলাম (ইংরেজি রচনা), হরিশ ত্রিবেদী (ভারতীয় সাহিত্যে প্রভাব), শুভা চক্রবর্তী দাশগুপ্ত (বিদেশি সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ) এবং আর শিবকুমার (রবীন্দ্রশিল্প)। শেষ পর্বের নাম ‘স্টাডিজ়’— অর্থাৎ রবীন্দ্রজীবন ও কর্মের কোনও একটি বিশেষ দিক ধরে বিশদ আলোচনা। বিষয়গুলিকে যেন বলা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ও...’। এই পর্বে লিখেছেন হিমানী বন্দ্যোপাধ্যায় (নারী), শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় (শিশু), সব্যসাচী ভট্টাচার্য (ইতিহাস), শোভনলাল দত্তগুপ্ত (সমসাময়িক রাজনীতি), ক্যাথলিন ও’ডনেল (শান্তিনিকেতন), সৌরীন ভট্টাচার্য (গ্রামীণ অর্থনীতি), অসীম শ্রীবাস্তব (পরিবেশচিন্তা), পার্থ ঘোষ (বিজ্ঞান), স্বপন চক্রবর্তী (সাহিত্য সমালোচনা), জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায় (সৌন্দর্যতত্ত্ব), ফ্রাঁস ভট্টাচার্য (ভক্তিসাহিত্য), নির্মাল্য নারায়ণ চক্রবর্তী (মুক্তির ধারণা), শেফালী মৈত্র (ধর্মচিন্তা), শরণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (মানবিকতাবাদ)।

প্রবন্ধগুলোর বিশদ আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, যুক্তির বিন্যাসে বা বক্তব্যের উপস্থাপনায় সব প্রবন্ধ একই মানের নয়। কিন্তু প্রতিটি প্রবন্ধেই চিন্তা ও পরিশ্রমের ছাপ আছে। সম্ভাব্য সমস্ত বিষয়ই যে এখানে আলোচিত হয়েছে, তা-ও নয়। যেমন, ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ এই বইয়ে অনুপস্থিত। লেখকসূচিতেও হয়তো কেউ তাঁদের প্রিয় বা পরিচিত কোনও রবীন্দ্রগবেষককে না পেয়ে ভাববেন।

কিন্তু মানতেই হবে যে, রবীন্দ্রপাঠের সহায়ক হিসেবে এই প্রয়াস বহুলাংশে সফল। যাঁরা রবীন্দ্রচর্চার মধ্যে আছেন, তাঁরা এই বইয়ে চিন্তা বা তর্কের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন। আর যাঁরা ইংরেজিতে রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক খুঁজছেন, তাঁরা পরিচয় পাবেন সেই রবীন্দ্রনাথের, যিনি শুধু কবি বা সাহিত্যিক বা প্রাবন্ধিক বা ভাবুক নন; যিনি শিক্ষা, প্রকৃতি ও পরিবেশ, পল্লি-উন্নয়ন, নাট্যকলা, শিল্পচর্চার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতা ও হাতেকলমে কর্মীও বটে। তাঁর প্রতিভার বিস্তৃতি যে কত বিশাল, এই কথা বইটি পাঠককে খুব সচেতন ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।

অবাঙালি পাঠকের আরও একটি বড় প্রাপ্তি আছে। তিনি বুঝতে পারবেন যে, রবীন্দ্রনাথকে নিবিড় করে জানতে গেলে শুধু ইংরেজি-নির্ভর হলে হবে না। একটি সচেতন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তের (পৃ xiv) ফলে এই বইয়ের প্রায় সমস্ত রচনার শেষস্থ টীকা ও মন্তব্য পাঠককে জানিয়ে দেয় যে, বাংলায় রবীন্দ্রচর্চা ও আলোচনার এমন একটি সুবিশাল ক্ষেত্র পড়ে আছে, যা রবীন্দ্র-গবেষকের জন্য অপরিহার্য। হয়তো সেইটাই এই বইটির মূল শিক্ষা। “কবিকে পাবে না তাঁহার জীবনচরিতে,” বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; শুধু জীবনচরিতে নয়, দূরাত্মীয় ইংরেজি ভাষার গোত্রান্তরেও রবীন্দ্রনাথকে নিবিড় বা অন্তরঙ্গ ভাবে পাওয়া প্রায়-অসম্ভব।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy