Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
book review

Book Review: যৌনতার গৎবাঁধা ধারণা ভেঙে বেরোনোর প্রয়াস

ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজ বিবর্তনের অতীত মহিমা, বর্তমান দুরবস্থা এবং পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা, সবই বিচার হচ্ছে বিবর্তনবাদী কাঠামোয়।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২১ ০৯:০১
Share: Save:

সংস্কৃতে ‘রণ্ড’ শব্দটির অর্থ হল সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রীলিঙ্গে হয় ‘রণ্ডা’। অর্থাৎ বন্ধ্যা। কালে-দিনে এরই অর্থ সম্প্রসারিত হয়ে, এবং তৎসম থেকে তদ্ভব হয়ে শব্দটি হয়ে দাঁড়ায় ‘রাঁড়’। অভিধানে তার তিন রকম অর্থ দেখতে পাচ্ছি— বন্ধ্যা, বিধবা এবং বেশ্যা। বন্ধ্যা থেকে বিধবা এবং সেখান থেকে বেশ্যা— এই যাত্রাপথের অন্তর্নিহিত ভাবনাক্রম অনুমান করতে পারাটা কঠিন নয়। বস্তুত, এ দেশে একটা বড় সময় ধরে বেশ্যা এবং বেশ্যাবৃত্তিকে ঘিরে নানা ধরনের ভাবনার জাল বোনা হয়েছে, যার মধ্যে পেশাগত নির্দিষ্টতার মূল্যায়নের চেয়ে অনেক বেশি করে প্রতিভাত হয়েছে নারীর ‘অবাধ্য’ যৌনতা সংক্রান্ত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ। দূর্বা মিত্রের ইন্ডিয়ান সেক্স লাইফ: সেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল অরিজিন্স অব মডার্ন সোশ্যাল থট বইটি এই ভাবনার ইতিহাসকেই নথিবদ্ধ করতে চায়। মূলত ঔপনিবেশিক বঙ্গই দূর্বার আলোচনার ক্ষেত্র।

ঔপনিবেশিক ভারতের নথিপত্রে বেশ্যা বলতে উচ্চবর্ণ হিন্দু একগামী বিবাহের গণ্ডির বাইরে যাঁরা, কার্যত তাঁরা সবাই (পৃ ৪)। তার মধ্যে তওয়াইফ (নর্তকী), বাইজি, দেবদাসী, মঞ্চশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, পথশিল্পী যেমন আছেন, তেমনই আছেন উচ্চবর্ণের হিন্দু বিধবা, বহুগামী নারী, মুসলিম নারীশ্রমিক, ভিখারিনি, ভবঘুরে, নার্স, নাবিকের স্ত্রী, পরিচারিকারাও। দূর্বা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বেশ্যা মানে এখানে কেবল কোনও পেশা নয়, বেশ্যা একটি ধারণা— কনসেপ্ট। এবং সেই ধারণার ভিত্তিতে বেশ্যাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনা-বিচার-বিশ্লেষণে কি সাহেব, কি দেশি ভদ্রলোক, সকলেরই সমান উৎসাহ। এবং কি সাহেবি, কি দেশীয়— উভয়ের কাছেই সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে বেশ্যার উপস্থিতি শুধু অনিবার্য নয়, অন্যতম ভিত্তিমূলও।

পাঁচটি পরিচ্ছেদে তাঁর বইকে ভাগ করেছেন দূর্বা— অরিজিন্স (উৎস), রেপিটিশন (পুনরাবৃত্তি), সার্কুলারিটি (চক্রগতি), এভলিউশন (বিবর্তন) এবং ভেরাসিটি (সত্যনির্মাণ)। এই পাঁচটি পরিচ্ছেদে তিনি কাটাছেঁড়া করেছেন যথাক্রমে ভাষাবিজ্ঞান, ফৌজদারি বিধি, ফরেনসিক চিকিৎসা ও জাতিতত্ত্বের নথিপত্র এবং জনপ্রিয় সাহিত্যের বয়ানকে। যেমন, বিবর্তন বিষয়ক পরিচ্ছেদের আলোচনা জাতিতত্ত্বের চর্চায় বেশ্যা এবং অবাধ্য যৌনতার স্থান নিয়ে। বিবর্তনবাদের উদ্ভব এবং অভিঘাত জাতিতত্ত্বের চর্চায় নতুন যুগের প্রবর্তন করেছিল বলা চলে। এখানেও তখন একের পর এক বই বেরোচ্ছে। ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজ বিবর্তনের কোন স্তরে রয়েছে, তার অতীত মহিমা, বর্তমান দুরবস্থা এবং পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা, সবই বিচার হচ্ছে বিবর্তনবাদী কাঠামোয়। সেখানে দূর্বা বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত একের পর এক বইয়ের উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছেন, কী ভাবে যৌনতার নিয়ন্ত্রণকে বিবর্তনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে দেখা হচ্ছিল এবং যৌন ব্যভিচার ও গণিকা গমনকে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল।

ইন্ডিয়ান সেক্স লাইফ: সেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল অরিজিন্স অব মডার্ন সোশ্যাল থট
দূর্বা মিত্র
৪৯৯.০০, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস

আবার চিকিৎসা-ফরেনসিক পরীক্ষা-সুরতহাল সংক্রান্ত নথি এবং বইপত্রের যুক্তিক্রমে এক ধরনের বৃত্তায়ন দেখতে পেয়েছেন দূর্বা। সেখানে ধর্ষণ-গর্ভপাত-শিশুহত্যা-নারীহত্যার বিবরণে নারীশরীরকে ফরেনসিক আতশকাচের নীচে ফেলা হচ্ছে; সেখান থেকে নারীর সামাজিক অবস্থান, ঘটনার কার্যকারণ এবং নারীর চারিত্রিক গড়ন সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে; সেই ধারণা থেকেই আবার নারীশরীরে আঘাত ও হিংস্রতার চিহ্নকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে (পরিচ্ছেদ ৩)। শব ব্যবচ্ছেদ, অবাধ্য যৌনতার শ্রেণিবিভাগ আর অপরাধ বাঁধা পড়ে যাচ্ছে এক অচ্ছেদ্য ত্রিকোণে। গর্ভপাতের কারণে মৃত মহিলাদের শব পরীক্ষা করে যে সব রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে, সেখানে অনৈতিক চরিত্র, রাশ-আলগা চরিত্র, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন, বিধবা, বেশ্যা, পতিতা জাতীয় শব্দবন্ধের ছড়াছড়ি (পৃ ১২১)। রবার্ট হার্ভি তাঁর রিপোর্ট অন মেডিকো-লিগাল রিটার্নস ফর বেঙ্গল ফর ১৮৭০-১৮৭২-এ বলেই দিচ্ছেন, ভারতীয় মহিলাদের নৈতিক চরিত্র ভাল নয়। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঘটনাকে লুকোনোর জন্য তাঁরা প্রায়ই গর্ভপাতের আশ্রয় নেন (পৃ ১১২)।

সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ডেঞ্জারাস আউটকাস্ট: দ্য প্রস্টিটিউট ইন নাইনটিন্থ-সেঞ্চুরি বেঙ্গল (সিগাল বুকস, ১৯৯৮) বইয়ে উনিশ শতকের বাংলায় বেশ্যাজীবন নিয়ে বিশদ আলোচনা আগেই করেছেন। সেখানে বেশ্যা একটি নির্দিষ্ট পেশাগোষ্ঠী হিসেবে এসেছিল। তাকে নিয়ে সাহেবদের মাথাব্যথা এবং ভদ্রলোকের দ্বিমুখিতা— দুই-ই সে বইয়ে বিস্তারিত ভাবে ছিল। দূর্বা মিত্রর আলোচ্য বইয়ের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি বেশ্যা বলতে একটি পেশা-পরিচয়ে— সমাজ এই শব্দটিকে যে পেশা-পরিচয়ে গণ্ডিবদ্ধ করেছে— তাতে সীমিত থাকেননি। বা বলা ভাল, তাঁর গবেষণার অভিমুখ তাঁকে তা থাকতে দেয়নি। তিনি খুঁজে দেখেছেন লিখিত বয়ানের বিরাট ভান্ডার, যেখানে বারংবার বেশ্যা এসে হাজির হয়েছে এক আশ্চর্য তরল ধারণা হিসেবে, যার মধ্যে নানাবিধ অর্থ এসে মেশে, নানাবিধ অর্থ চলকেও পড়ে। সাহেবি নথি থেকে দেশীয় কেতাব, সর্বত্র বেশ্যার আনাগোনা চলতে থাকে সমাজচিন্তা আর যৌনতার নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের এক অত্যাবশ্যক আকর হিসেবে।

বাংলার সামাজিক ইতিহাস এবং মানবীবিদ্যা চর্চায় আগ্রহীদের জন্য এ বই মূল্যবান সংযোজন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE