হাফ লায়ন/ হাউ পি ভি নরসিংহ রাও ট্রান্সফর্মড ইন্ডিয়া। বিনয় সীতাপতি। পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস, ৬৯৯.০০
ব্রি টিশ সাংবাদিক ইয়ান জ্যাককে একদা রাজীব গাঁধী বলেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ভারতের মতো ধর্মপ্রবণ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সে কথা প্রকাশ্যে বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব না।
ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের এ এক মস্ত গেরো। দেশের সমাজ-মনস্তত্ত্বের কথা ভেবে অনেক কথাই প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারেন না তাঁরা। আর এই কারণেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী হয়ে ওঠে একঘেয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের দীর্ঘ অনুলিপি। আত্মজীবনীকার রাজনৈতিক নেতাদের সত্য স্বীকারের সৎসাহস থাকে না, আর জীবনী মানেই হেজিয়োগ্রাফি।
এই চলতি প্রবণতার গুমোটের মধ্যে সামান্য দখিনা বাতাসের মতো বাজারে প্রকাশিত সাংবাদিক-গবেষক-শিক্ষক বিনয় সীতাপতির হাফ লায়ন/ হাও পি ভি নরসিংহ রাও ট্রান্সফর্মড ইন্ডিয়া। ৩৯১ পাতার এই জীবনী থেকে হঠাৎ জানা যায়, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে পরেই কী ভাবে রাওয়ের সঙ্গে সনিয়া গাঁধীর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হয়। সাংবাদিকদের কাছে এত দিন যা ছিল গুজব, জীবনীকার রাওয়ের অপ্রকাশিত ডায়েরি চিঠি ও অন্যান্য নথির ভিত্তিতে তাকেই দিয়েছেন সত্যের মর্যাদা। জানা যাচ্ছে, ৬ ডিসেম্বরের পরেই রাওয়ের সন্দেহ হয় তাঁকে সরানোর গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে দলের মধ্যে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের নিন্দা করে সনিয়া একটি বিবৃতিও দেন। যদিও সে বিবৃতিতে প্রকাশ্যে রাও-বিরোধিতা ছিল না, কিন্তু প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অশনি-সংকেত দেখেন। গোয়েন্দা-ব্যুরোকে (আইবি) তিনি ১০ জনপথের উপর নজর রাখতে বলেন। ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক বারো দিন পর আইবি রাওকে এক রিপোর্টে জানায় যে, ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর সনিয়ার সঙ্গে যাঁরা ঘনঘন দেখা করেন তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক জন ছিলেন অর্জুন সিংহ, দিগ্বিজয় সিংহ, নারায়ণদত্ত তিওয়ারি, মাধবরাও সিন্ধিয়া, আহমেদ পটেল, অজিত যোগী ও সালামুতাল্লা। সনিয়ার কাছে এঁরা রাও সম্পর্কে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন।
দলের মধ্যেই যে একটা বিদ্রোহ দানা বাঁধছে তা বুঝতে পেরে রাও সনিয়ার উপর এই নজরদারি চালিয়ে যান। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও তাঁর রাও-জমানা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বইতে বলেছেন, দলের মধ্যে শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ কর্মী মনে করেন যে বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য রাও দায়ী। রমেশ আরও বলেছেন, একটা সময় ছিল যখন প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের প্রশংসা করাই সম্ভব ছিল না। প্রশংসা করলে ধরা হত ওই কংগ্রেস নেতা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পক্ষে। রাহুল গাঁধী পরে বিবৃতি দেন, গাঁধী পরিবারের কেউ ক্ষমতাসীন থাকলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হত না।
জীবনীকার এই গবেষণালব্ধ গ্রন্থে রাওয়ের মৃত্যুর প্রায় বারো বছর পর ঠিক কী বার্তা দিতে চেয়েছেন? এই প্রশ্নের জবাবে একটাই কথা বলা যায়। ভারতে নেহরু-গাঁধী পরিবারের বাইরে থেকেও কোনও কংগ্রেস নেতা যদি ভারত-নির্মাণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন তবে তিনি নরসিংহ রাও। কিছু নিন্দুক বলতে পারেন এই বইটি রাওয়ের মরণোত্তর হেজিয়োগ্রাফি, যার মাধ্যমে লেখক তাঁকে এ দেশের আর্থিক সংস্কার থেকে ভারতকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কৃতিত্ব অর্পণ করতে চান। লেখক তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য সফল রাজনৈতিক নেতা জওহরলাল নেহরু, তং শিয়াও ফিং, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, রোনাল্ড রেগন, মার্গারেট থ্যাচার এবং শার্ল দ্য গল-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এমনকী লেখক এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, তং-কে দেশের ভিতর রাওয়ের মতো এক খণ্ডবিখণ্ড গণতন্ত্রের পরীক্ষা দিতে হয়নি, এ দেশে রাওয়ের ক্ষমতা ছিল অনেক সীমাবদ্ধ। রুজভেল্ট বা দ্য গলের মতো ক্যারিশমা বা জনসমর্থন রাওয়ের ছিল না, রুজভেল্ট, রেগন, থ্যাচার ও নেহরুর মতো সংসদের উপর তাঁর দলীয় নিয়ন্ত্রণও ছিল না। তবু রাও অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হন।
বইটিতে রাওয়ের রাজনীতির শিকড় খোঁজা হয়েছে ১৯২১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশে তাঁর রাজ্য রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। এমনকী, ঠিক কী ধরনের শিক্ষিত রক্ষণশীল সাবেকি পরিবারে তিনি জন্মান এবং সেই অতীত দিনে কী ভাবে রাও এক অন্ধ্র-সমাজতন্ত্রী হিসাবে বিকশিত হন, তার অনুসন্ধানপর্বটি অনবদ্য। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৯১ সালে এই রাও কী ভাবে আর্থিক উদারবাদকে এ দেশের জমিতে জনপ্রিয় করে তোলেন সেই রূপান্তর পর্বটিও মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ঘটনাপ্রবাহ আর ভারতের অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংকটের মোকাবিলার চাহিদা থেকেই রাওয়ের প্রশাসনিক অভিমুখের পরিবর্তন হয় আর সেই কর্মযজ্ঞে তিনি সঙ্গে পান মনমোহন সিংহের মতো এক অর্থমন্ত্রীকে।
আবার এই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজনীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি পর্যন্ত পৌঁছেও যে ভাবে ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন, দু’দু’বার তিনি হাইকমান্ডের রোষের মুখে পড়ে রাজ্য রাজনীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর পদও ছাড়তে বাধ্য হন। রাজ্য রাজনীতি থেকে তাঁকে সরাতে দিল্লির রাজনীতিতে আনা হয়েছে, আবার দিল্লিতে এনেও কী ভাবে তাঁর মতো দশটি ভাষা জানা, প্রবীণ বয়সে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে প্রথম কম্পিউটার শিখে ফেলা রাওকে রাজনৈতিক ভাবে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়, সে সব সবিস্তার জানা যায়। বোঝা যায়, এক দিন হঠাৎ নয়, ধীরে ধীরে বহু দিন ধরে রাও নেহরু-গাঁধী পরিবার সম্পর্কে তীব্র অসন্তোষ গড়ে তোলেন মনের ভিতর। যদিও প্রকাশ্যে রোষ প্রদর্শন ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। আর তাই তিনি ‘আনন্দ’ নামের এক চরিত্র সৃষ্টি করে উপন্যাসের ফর্মে আত্মজীবনী লেখেন।
গোপাল গাঁধী দীর্ঘদিন রাওকে দেখেছিলেন খুব কাছ থেকে। তিনিও লিখেছেন, প্রকাশ্যে অসৌজন্য প্রকাশ, এমনকী নিজেকে মেলে ধরার স্বভাব নিজের মধ্যে ধারণ করতেন না রাও। উপন্যাসের মাধ্যমে আত্মজীবনী লিখতে গিয়েও তিনি সমস্ত সত্য প্রকাশ করতে পারেননি। রাজীবের মৃত্যুর পর যখন সনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করার আলোচনা শুরু হয় দলের মধ্যে, তখন তিনি অর্জুন সিংহকে বলেছিলেন, গাঁধী পরিবার কি এ দেশের রেলগাড়ির ইঞ্জিন, যে কোনও ডিব্বার মুখে ইঞ্জিনটা লাগিয়ে দিলেই তা চলতে শুরু করবে? তবু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রতি সপ্তাহে কার্যত তিনি ১০ জনপথে সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। সম্পর্কের অবনতির পরও নিজের নাতনির বিয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে সনিয়ার কাছে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন। আবার তিনিই সনিয়াকে বলেছিলেন, তুমি যদি আমার মেয়ের মতো ভাবো নিজেকে, তবে বলব রাজনীতিতে এসো না কখনও।
বইটির প্রধান সীমাবদ্ধতা, পড়তে পড়তে বার বার মনে হয়েছে লেখক যেন গাঁধী-নেহরু পরিবার সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট। এ কথা সত্য, রাওয়ের দুই পুত্র রাজেশ্বর এবং প্রভাকর ওঁদের পরিবারের কাছে রাখা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর যাবতীয় চিঠি ও নোট লেখকের হাতে তুলে দেওয়ায় বইটি অনেক তথ্যসমৃদ্ধ হয়েছে। অতীতে যা ছিল গুজব, তা এত বছর পর সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই, তবু বই পড়ার শেষে অতৃপ্তি থেকে যায়।
তিনশো পাতার পরও যদি বলি শেষ হয়ে হইল না শেষ, তবে আপাত ভাবে মনে হয় এ কেমনতর সমালোচনা? এই কাহিনিতে দিল্লির দরবার আছে, আছে বিস্তর ঘটনাবলি ও নানা ধরনের বৈঠকের তালিকা। কিন্তু রাওয়ের মতো স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির রাজনৈতিক দর্শনের বৃহৎ প্রেক্ষাপটটি স্পর্শ করতে কি কোথাও খামতি থেকে গেল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy