নোবেল পাওয়ার পাঁচ বছর বাদে স্বদেশে ফিরলেন মারিও ভার্গাস জোসা। ২০১৩ সালে ইংরেজিতে বেরিয়েছিল তাঁর ড্রিম অব কেল্ট। আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী রজার ক্যাসমেন্টকে নিয়ে লেখা সেই উপন্যাস তুলে ধরেছিল গত শতাব্দীতে কঙ্গো থেকে ব্রাজিল, আয়ারল্যান্ড সর্বত্র ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার। এ বার ইংরেজিতে অনূদিত হল তাঁর নতুন উপন্যাস দ্য ডিসক্রিট হিরো। এখানে তিনি ফিরে গিয়েছেন স্বদেশে, পেরুতে। এমনকী পিউরা নামে যে মরু-শহরে তাঁর শৈশব কেটেছিল, সেই শহরও ফিরে এল বারংবার। সার্জেন্ট লিথুমা পিউরার থানায় পোস্টিং পেয়েছে। তার ছোটবেলা কেটেছে এখানেই। এখন শহর আর চেনা যায় না। যেখানে ঝোপঝাড়, ফাঁকা মাঠ ছিল, সেখানে এখন বহুতল বাড়ি, শপিং মল আর মাল্টিপ্লেক্স। চার দিকে উন্নয়নের ব্যস্ততা। শহরে লরি, বাস, ট্যাক্সির পরিবহণ-ব্যবসায়ী ফেলিসিতো ইয়ানাকি। উপন্যাসের শুরুতেই তাঁর দরজায় চিঠি, ‘আপনার ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে আমাদের মাসে ৫০০ ডলার করে দেবেন। অন্যথা বিপদ অনিবার্য।’ ফেলিসিতো নতজানু হন না। তাঁর অফিসে এক রাতে আগুন লাগে। অপহৃত হয় তাঁর রক্ষিতা। থানায় বসে লিথুমা ভাবে, ‘আগে উন্নয়ন ছিল না, শহরে এত তোলাবাজ আর মাফিয়াও ছিল না। উন্নয়ন মানেই তা হলে প্রগতি নয়।’
উপন্যাসে নায়ক দু’জন। পিউরার ফেলিসিতো ইয়ানাকি, আর লিমা-র আইনজীবী রিগোবার্তো মানচু। ছেলে আলফোনসো আর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী লুক্রেসিয়াকে নিয়ে রিগোবার্তোর সংসার। রিগোবার্তো ঠিক করেছেন, অচিরে অবসর নিয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে এক মাসের ইউরোপ সফরে যাবেন। আর এক বার খুঁটিয়ে দেখবেন টিশিয়ান, ভেলাসকেজের আঁকা ছবি। কিন্তু তাঁর উপরওয়ালা ইসমায়েলের দুই ছেলে সমান গুন্ডা। ইসমায়েল ছেলেদের ওপর রেগে বৃদ্ধ বয়সে আর এক জনকে বিয়ে করেছেন, কোম্পানির শেয়ার বহুজাতিক সংস্থাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে সেই গুন্ডারা বাড়ি বয়ে এসে রিগোবার্তোকে হুমকি দিতে থাকে। রিগোবার্তোও হার মানার পাত্র নন। ইউরোপীয় ছবি ও সাহিত্যে তিনি আগের মতোই বুঁদ হয়েই থাকেন। ‘সভ্যতা কোনও বিশ্বব্যাপী তরঙ্গ নয়। সভ্যতা মানে, তোমার চারপাশে বর্বরতার ঢেউ, তারই মধ্যে তোমাকে গড়ে তুলতে হবে তোমার বই, ছবি, রুচি নিয়ে নিজস্ব দুর্গ। চারপাশের জলোচ্ছ্বাসে এতটুকু আঁচড় পরবে না তাতে,’ ভাবেন রিগোবার্তো। তখনই পেরু থেকে পশ্চিমবঙ্গ একাকার হয়ে যায় পাঠকের কাছে। তোমার চারপাশে উন্নয়নের নামে সিন্ডিকেট, তোলাবাজি ইত্যাদি বর্বর ঢেউ থাকবেই। তুমি সেখানে গা না ভাসিয়ে তৈরি করো নিজস্ব দুর্গ। সাধে তাঁর মানপত্রে নোবেল কমিটি লিখেছিল, ‘ক্ষমতায় মত্ত দুনিয়াতেও ব্যক্তি যে ভাবে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করে, তার বয়ানই ফুটে ওঠে ভার্গাস জোসার লেখায়!’
নতুন উপন্যাসে থ্রিলারের বুনটে দুই নায়ক পাশাপাশি। একটি অধ্যায় ফেলিসিতোকে নিয়ে, পরেই রিগোবার্তো। ভার্গাস জোসা এই উপন্যাসে শুধু স্বদেশে ফিরলেন না, ফিরলেন পুরনো চরিত্রদের কাছেও। তাঁর গ্রিন হাউস উপন্যাসেই ছিল পিউরা শহরের সার্জেন্ট লিথুমা। পেরুতে তখন একনায়কতন্ত্র। রিগোবার্তো মানচুও তাঁর ইন প্রেজ অব স্টেপমাদার আর নোটবুকস অব রিগোবার্তো মানচু দুই উপন্যাসেরই চরিত্র। দুটিতেই রিগোবার্তো রতিবিলাসের গল্প বলে স্ত্রী লুক্রেসিয়াকে চেতিয়ে তোলেন। আর সৎমা লুক্রেসিয়া য়খন স্নান করে, কিশোর ফোনচিতো লুকিয়ে দেখে। তার রূপমুগ্ধতা বদলে যায় কামনায়, সৎমাকে শুভরাত্রি জানানোর চুম্বন রূপান্তরিত হয়ে যায় উদগ্র কামবাসনায়।
নতুন উপন্যাসে সৎমায়ের প্রতি আকর্ষণ নেই, আছে বাবার রক্ষিতাকে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেল। পিউরা শহরে ফেলিসিতো ইয়ানাকির রক্ষিতা ম্যাবেল জানত না, তার প্রেমিক আসলে ফেলিসিতোর ছেলে। জানার পরেও ফেরার উপায় নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে পুত্রপ্রতিমের সঙ্গে শরীরী খেলায় জড়িয়ে পড়ে। ভার্গাস জোসা এর আগে বহু বার বলেছেন, শরীরী প্রেম আর রোমান্টিক প্রেম আলাদা। দুটোকে গুলিয়ে না ফেলাই ভাল। তাঁর আন্ট হুলিয়া ও স্ক্রিপ্টরাইটার উপন্যাসেই ছিল মাসির সঙ্গে প্রেম।
৭৯ বছর বয়সেও তোলাবাজি, থ্রিলার, যৌনতার মোড়কে তিনি নিয়ে এলেন পেরু তথা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের ট্রাজেডি। উপন্যাসের শেষে রিগোবার্তোকে ফোনচিতো জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, তুমি ইউরোপীয় উপন্যাস, পেন্টিং ভালবাসো। তা হলে ইউরোপেই থেকে গেলে না কেন?’ রিগোবার্তো জানান, লন্ডন বা প্যারিসে পাকাপাকি থাকলে সভ্যতার প্রতি তাঁর এই আকর্ষণ থাকত না। রোজকার বাস, ট্রাম, চাকরি, হাটবাজার, দৈনন্দিনতার জাঁতাকলে পড়ে গেলে সিস্টিন চ্যাপেল দেখা হত না, ফ্লবেয়ারের উপন্যাস পড়তেও কুঁড়েমি ধরত। ভার্গাস জোসা ফের বুঝিয়ে দিলেন, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্ব না থাকলে ইউরোপীয় সভ্যতা অর্থহীন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy