মুখোমুখি: ইউরোপ সফরে আলোচনারত রবীন্দ্রনাথ ও রোমাঁ রোল্যাঁ। উপস্থিত প্রশান্তচন্দ্র ও নির্মলকুমারী মহলানবিশ।
বিশ্বযুদ্ধ যে শিক্ষা আমাদের দিল, আমরা তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি, লোকে তাদের ঘৃণা ও ক্রোধকেই জিইয়ে রাখতে চাচ্ছে, পৃথিবীকে পুনরায় ভয় দেখাচ্ছে দলবদ্ধ হিংস্রতা দিয়ে: এই সব ভেবে আমার মন যখন বিষাদে মগ্ন, তখনই আপনার চিঠি এসে আমার মনকে আশায় উজ্জীবিত করে তুলল।— আজ থেকে ঠিক একশো বছর তিন মাস আগে, ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রোমাঁ রোল্যাঁকে। তাঁদের মধ্যে চিঠির বিনিময় শুরু হয় তখন থেকেই। এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, ভাল সময়েই সুযোগ পেয়েছি— রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজ়ম’ বইয়ের শতবর্ষ নিয়ে অনেক কথা হলেও এই দুই চিন্তাবিদের পত্রসম্পর্কের শতবর্ষ নিয়ে তত কিছু শুনিনি এখনও। অথচ গুরুত্বে ও প্রাসঙ্গিকতায় জাতীয়তাবাদ-বিষয়ক প্রবন্ধগুলির থেকে খুব পিছিয়ে নেই এই চিঠির সম্ভারও।
সত্যিই, ভাল সময়ে পড়ার সৌভাগ্য হল চিঠিগুলি। ‘ঘৃণা ও ক্রোধ’, ‘দলবদ্ধ হিংস্রতা’-র বিস্ফোরণ একশো বছর পর আজ আবার আমাদের চার দিকে যে ভাবে দেখছি, তার অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ ও রোমাঁ রোল্যাঁর চিন্তা যেন দ্বিগুণ অর্থময় ঠেকল। এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য চিন্ময় গুহ-র বইটির। সরাসরি ফরাসি ভাষা থেকে রোল্যাঁর চিঠি অনুবাদ করে এই বই আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। এক বর্ণও ইংরেজি জানতেন না রোল্যাঁ। তাঁর চিঠি এলে রবীন্দ্রনাথকে তা অনুবাদ করে শোনাতেন কবির ছাত্র কালিদাস নাগ। পরবর্তী কালে এ বিষয়ে যত আলোচনা লেখালেখি, সবই ইংরেজি-অনুবাদে-পড়া ফরাসি চিঠির উপর নির্ভর করে। এই প্রথম, মূল ভাষা থেকে ফরাসি চিঠির অনুবাদ ও টীকা-সহ সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ হাতে পেলাম আমরা।
যে বাক্যটি উদ্ধৃত করলাম, তার ভেতরের মেজাজখানি ঘুরে ঘুরে এসেছে প্রথম দিকের সব পত্রালাপেই, যেগুলির পরিপ্রেক্ষিত ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসতাণ্ডব। যুদ্ধের গোড়া থেকেই দুই দেশের দুই চিন্তাবিদ পরস্পরের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। দেশ ও জাতির নামে কুৎসিত শক্তিপ্রদর্শন কী ভাবে সাধারণ মানুষের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে, দেখে শিউরে উঠছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একটি অরাজনৈতিক শান্তি-প্রয়াসী সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন রোমাঁ রোল্যাঁ ও তাঁর সমমনস্ক ইউরোপীয় বন্ধুরা। ভাবছিলেন, ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার একটা সংযোগ তৈরি করা দরকার। সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথকে রোল্যাঁর প্রথম সরাসরি যোগাযোগ, ১৯১৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ রাজি হন ‘অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে’। অনুমতি চান কোনও ভারতীয় পত্রিকায় রোল্যাঁর চিঠি ও ঘোষণাপত্রটি ছাপার জন্য। ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার জুলাই ১৯১৯ সংখ্যায় তা ছাপা হয়। প্রসঙ্গত, ভারত থেকে এক জনেরই স্বাক্ষর ছিল তাতে: রবীন্দ্রনাথ। ক্রমে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। প্রথম তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২১-এর এপ্রিলে। ভারতের অসহযোগ আন্দোলন, গাঁধীর রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি: বহু বিষয়ে তাঁদের মতবিনিময় হয়, ১৯১৯-১৯৪০ সময়কালের মধ্যে ৪৬টি চিঠি-টেলিগ্রাম লেখেন তাঁরা। অনেক মিল ছিল বয়সে কাছাকাছি দুই জনের মধ্যে। এক জন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরোধিতা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হন। আর এক জন যুদ্ধের উন্মাদনাকে সমর্থন না করে, এবং জার্মানদের প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা প্রকাশের দায়ে ‘রেনিগেড’ আর ‘ট্রেটর’ অভিধা পান। এক জন ভাবেন ‘কোলাহল তো বারণ হল, এ বার কথা কানে কানে’, আর এক জন লেখেন ‘‘আই কুড নো লঙ্গার বেয়ার দ্য মর্টাল অ্যান্ড মেটেরিয়াল অ্যাটমসফিয়ার অব প্যারিস... আই থিঙ্ক আই হ্যাভ নাও গেনড্ দ্য রাইট টু রিটায়ার ফ্রম দ্য সোয়ার্ম অব মেন টু দ্য হার্ট অব ম্যান।’’
ব্রিজিং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট/ রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড রোমাঁ রোল্যাঁ করেসপন্ডেন্স (১৯১৯-১৯৪০)
সম্পাদক: চিন্ময় গুহ
৯৯৫.০০, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
এই সময়পর্ব জুড়ে রবীন্দ্রনাথ কী করছিলেন, কী ভাবছিলেন, তার ধারণা আমাদের আছে। কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের এই জরুরি ঘটনাবহুল সময়পর্বে, ইউরোপীয় লিবারাল এলিট-মহল থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেওয়া রোল্যাঁ কী করছিলেন, কী ভাবছিলেন, কোন দ্বন্দ্বে দীর্ণ হচ্ছিলেন, তা আমরা বিশেষ জানার সুযোগ পাইনি। চিন্ময়ের বইয়ের অসাধারণ ভূমিকায় রয়েছে এই জরুরি ইতিহাস-প্রেক্ষিত। অতিশয়োক্তি হবে না যদি বলি, পত্রগুচ্ছ সম্পাদন করতে গিয়ে এত তথ্যঋদ্ধ অথচ সুলিখিত ভূমিকা-প্রবন্ধ কম সম্পাদকই লিখে উঠেছেন।
দ্বন্দ্বের সূত্রে আসি একটি জরুরি প্রসঙ্গে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ যাত্রায় ঘটেছিল সেই বিতর্কিত ইতালি-সফর, যখন মুসোলিনির ব্যক্তিত্বে ও প্রশাসনে কিছুটা মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রোল্যাঁর সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর মতান্তর হয়। মনান্তরও। পাশাপাশি, রোল্যাঁর মধ্যে তখন আরও একটি অন্তর্দ্বন্দ্ব। যতটা ভেতর থেকে তিনি তাঁর বন্ধুকে চেনার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁর অন্য ফ্যাসিবিরোধী সহচররা তা পাননি। ফলে এক দিকে তিনি রবীন্দ্রনাথকে মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের বিপদ বোঝাতে গিয়ে অসফল হয়ে হতাশ বোধ করছেন। অন্য দিকে আবার রবীন্দ্রনাথের উপর রেগে-ওঠা ফ্যাসিবিরোধীদের (যেমন, দুহামেল) আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথের এই অপারগতা ঠিক কোনখান থেকে আসছে। কালিদাস নাগের কাছে লেখা চিঠিতে রোল্যাঁর এই দীর্ণতার পরিচয় স্পষ্ট। ‘‘(দুহামেল) ডিড নট ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড টেগোর, অ্যান্ড রিঅ্যাক্টেড এগেনস্ট হিজ অ্যাটিটিউড উইথ অ্যান এক্সেসিভ রিজিডিটি’’...। তাঁর উপলব্ধি ‘‘গুড হি ইজ়, প্রোফাউন্ডলি; গুডনেস রেডিয়েটস ফ্রম হিজ় হোল বিয়িং’’ তিনি অন্যদের বুঝিয়ে উঠতে পারেন না। আবার, দুই মাসের মধ্যেই মার্সেল মার্টিনে-কে লেখেন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর হতাশার কথা, ‘‘আমাদের আর্তনাদ যেন এঁদের কানে পৌঁছয় না, এঁরা কেবল হাসেন। ভাবটা যেন, এত সামান্য বিষয়ে এত হইচই! কে মুসোলিনি? এশীয়দের কাছে যেন সব ইউরোপীয়ই কমবেশি এক-এক জন মুসোলিনি!’’ অন্যদের কাছে লেখা রোল্যাঁর এই চিঠিপত্রগুলি চিন্ময়ের বইয়ের ‘নোটস’-এর মধ্যে ধরা রয়েছে। রয়েছে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠিও। ভূমিকার মতো টীকাও এই বইয়ের বিরাট সম্পদ। আর একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ, রবীন্দ্রনাথ ও রোল্যাঁর মধ্যে তিনটি কথোপকথন। এর মধ্যে ১৯২৬ সালের ২৫ জুনের কথোপকথনে পড়ি ইউরোপের মানুষের কাছে ফ্যাসিবাদী শাসনের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে রোল্যাঁর জোরালো মত: এই গ্রহণযোগ্যতার ফলেই, তাঁর মতে, ‘‘ইন রিয়েলিটি ওনলি আ স্মল গ্রুপ অব ফ্যাসিস্টস, ভেরি আর্ডেন্ট, ভেরি সিনসিয়ার, হ্যাভ গট পাওয়ার।’’
আর তাই, অন্যত্র এই বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে আর এক রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ মার্টিন কাম্পশেন-এর মন্তব্য যে ‘‘রবীন্দ্রনাথ আর রোল্যাঁ দুই জনেরই আদর্শবাদিতার ধরনটা আজকের দিনে ফাঁপা মনে হয়’’— এর ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তে এসেই এই আলোচনা শেষ করতে চাই। চিন্ময় গুহ-র সৌজন্যে আর এক বার দুই চিন্তাবিদের কথা পড়তে গিয়ে মনে হল, তাঁদের আদর্শবাদিতা, সংশয় ও প্রত্যয় একই রকম প্রাসঙ্গিক আজও।
স্বাভাবিক। নানা অর্থেই যে একশো বছর পিছিয়ে গিয়েছি আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy